দেবী মা – ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় Devi Maa by Tridibendra Narayan Chattapadhyay

দেবী মা - ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় Devi Maa by Tridibendra Narayan Chattapadhyay
দেবী মা - ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় Devi Maa by Tridibendra Narayan Chattapadhyay

ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ভয়ংকর হরর গল্প Devi Maa দেবী মা পড়ুন এখান থেকে। দেবী মা Devi Maa গল্পটি বিভা ভূত ভুতুম উৎসব সংখ্যা ১৪৩০ (২০২৩) পিডিএফ Biva Bhut Bhutum Utsav Sankhya 1430 pdf থেকে নেওয়া হয়েছে।

দেবী মা - ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় Devi Maa by Tridibendra Narayan Chattapadhyay
দেবী মা Devi Maa cover

Devi Maa কাহিনী সংক্ষেপঃ

এক ক্ষয়িষ্ণু গ্রাম… এক অসহায় ডাক্তার… রাজনীতির ঘেরাটোপ… হঠাৎ ডাকাত পড়ল গ্রামে, গ্রামবাসীদের মারে আধমরা ডাকাতদের সারিয়ে তোলার দায়িত্ব বর্তাল ডাক্তারের উপর… তারপর? ডাক্তার কী পারবে তাদের বাঁচাতে?

গ্রেভ ইয়ার্ড শিফ্ট – সৌম্য সাহা Grave Yard Shift pdf by Soumya Saha

Devi Maa দেবী মা সম্পূর্ণ গল্পঃ

প্রদীপ কখনো মাটিতে রাখা উচিত নয়। বিশেষ করে অনুষ্ঠানবাড়িতে। একটু অসাবধান হলেই শাড়িতে আগুন লেগে যেতে পারে। বুস্টের মা-র অবস্থাটা দেখলি তো?”
“মাসিমা কেমন আছেন?”
“হাসপাতালের ডাক্তার তো বলছেন, বেঁচে যাবেন।” “যাক বাবা, ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরে এলে হয়। আমার বউদির কাকিমা তো মারাই গেলেন। অবশ্য উনি অনেকটা পুড়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার বলেছিল থার্ড ডিগ্রি বার্ন। তাও আবার অনেকটা।”

কথা চলছিল কানাইয়ের চায়ের দোকানে। আমাদের মফস্সল শহরটায় এটা একটা বড়ো ল্যান্ডমার্ক। রোজ বিকেলে বেশ জমাটি আড্ডা বসে। আজকে হঠাৎ পুড়ে যাওয়া নিয়ে কথা উঠেছে।
আমাদের নজর গেল রাস্তায়। ডাক্তার বিশ্বরূপ মল্লিক সান্ধ্য বাজার থেকে ফিরছেন। ইনি এক বিচিত্র মানুষ। সারাজীবন সরকারি হাসপাতালে চাকরি করে রিটায়ার করার পর, এখন এই ছোট্ট শহরে এসে বাসা বেঁধেছেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না, কোনোদিনই করেননি। তবে কেউ খুব বিপদে পড়লে বিনা পয়সায় সাহায্য করে থাকেন। বাড়িতে বউদি আছেন। এক মেয়ে, সে-ও ডাক্তার, বিয়ে হয়ে এখন পুনেতে আছে।
ডাক্তার মল্লিক বেশ আড্ডাবাজ স্বভাবের। আমরা চায়ের দোকান থেকে ওঁকে ডাক দিলাম। উনি আসতে অসিতের জ্ঞানতৃষ্ণা জেগে উঠল।

“আচ্ছা ডাক্তারবাবু, শরীরের কত অংশ পুড়ে গেলে লোকে মারা যায়?”
ডাক্তারবাবু আসতেই কানাইদা একটা চিনি ছাড়া সাদা চা ওঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। একটা চুমুক দিয়ে উনি বললেন, “ওরকমভাবে তো বলা যায় না। কোথায় পুড়েছে, কত গভীর পুড়েছে, কতটা পুড়েছে—এ সব কিছু হিসেব করে বলতে হবে।”

ব্রতীন খুব বোদ্ধার মতো বলল, “তা তো বটেই। সব কিছুরই একটা সায়েন্স আছে তো।”
ডাক্তারবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “সায়েন্স থাকলেও জীবনমৃত্যুর ব্যাপারটা বোঝা অত সহজ না।”
অসিত বলল, “আপনি নিজে এত বড়ো ডাক্তার হয়ে এই কথা বলছেন?”
“যে-কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তারই এ কথাটা স্বীকার করবে। উপরওয়ালার ইচ্ছা না-থাকলে কেউ মরেও না, বাঁচেও না।” “আপনি ভগবানে বিশ্বাস করেন?”

“ভগবান বলতে তুমি কী বুঝিয়েছ, আমি জানি না । কিন্তু কাউকে বাঁচানো ডাক্তারের ক্ষমতার বাইরে। সে অন্য কারও ইচ্ছায় বাঁচে মরে। তাকেই আমি উপরওয়ালা বলছি। আমরা যতটা সম্ভব রোগীকে সাহায্য করতে পারি, এইমাত্র।”
রক্তিম এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল, বলল, “একটা উদাহরণ দিতে পারেন?”
ডাক্তার মল্লিকের মুখে একটা ছায়া খেলে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন উনি অন্যমনষ্ক হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, “সে তো বিরাট গল্প, এখন বলা যাবে না।” “কেন যাবে না? আপনার বাজার না হয় কানাইদার ছেলেটা বাড়িতে দিয়ে আসবে।”
চারদিকে সমর্থনের ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ আওয়াজ উঠল। কিছুটা বাদানুবাদের পরে ডাক্তারবাবু হাল ছেড়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে পড়লেন।
গল্প শুরু হল।

**************************************”

সে অনেকদিন আগের কথা, মোবাইল, কম্পিউটার কিছুই তখন ছিল না। আমি তখন নদিয়ার জেলা হাসপাতাল থেকে সুন্দরবনের কাছে, একটা অজ পাড়াগাঁয়ের হেল্থ সেন্টারে বদলি হয়েছি। খানিকটা পানিশমেন্ট পোস্টিংই বলতে পারো। এক বড়ো নেতার কথা না শোনার ফল। হেল্থ সেন্টারে গোটা সাতেক বেড। লোকনাথ বলে একটা অপদার্থ কম্পাউন্ডার, আর গায়ত্রী বলে একজন হাফ ট্রেন্ড নার্স, তার আবার ভয়ানক মেজাজ, এই আমার সম্বল। দু-জনেই ক্যানিং থেকে ডেলি যাওয়া-আসা করত। আর আমি একা নিজের কোয়ার্টারে বাসর জাগিয়ে বসে থাকতাম।

বুঝতেই পারছ, হেল্থ সেন্টারে চিকিৎসা কেমন হত! সব রোগীকেই ক্যানিংয়ের হাসপাতালে রেফার করে দিতাম। খালি একটা ফ্রিজে কতকগুলি অ্যান্টি স্নেক ভেনাম এনে রেখেছিলাম। সাপে কাটা রুগি হলে একটা করে ঠুসে দিয়ে তারপর ক্যানিং পাঠাতাম। গ্রামের সবাই জানত হেল্থ সেন্টারের অবস্থা কীরকম, কাজেই কেউই বিশেষ কিছু বলত
না।

যে গ্রামটায় ছিলাম, তার নাম হল বদ্যিপাড়া। এককালে নাকি সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল, চারপাশে নানা বাড়ির ধ্বংসাবশেষ, পুরোনো মজা ঘাট-বাঁধানো পুকুর, ইত্যাদিতে সে কথা বোঝা যেত। এখন কিছু জেলে থাকে। আর বাকিরা চাষি, যদিও নোনা জলের কারণে চাষ ভালো হত না। লোকজন গরিব হলে কী হয়, রাজনীতির চর্চা সেখানে খুবই হত।
আমার বাড়ি তখন বারুইপুরে, আর মেয়েটার বয়স সবে বছর দেড়েক। বাড়িতে মা, বাবা দু-জনেই সক্ষম ছিলেন। কাজেই বউ-মেয়েকে বাড়িতেই রেখে এসেছিলাম। মাঝে মাঝে সপ্তাহের শেষে বাড়ি পালিয়ে আসতাম। সেই এক-দু-দিন লোকনাথ থেকে যেত।

বদ্যিপাড়ার পাশের গ্রাম মাজুরিতে ছিল পুলিশথানা। থানার বড়োবাবুর সঙ্গে আমার খানিকটা হৃদ্যতা হয়েছিল। এক শুক্রবার রাতে বাড়ি ফিরেছি। পরদিন সকালে থানার বড়োবাবু ফোন করলেন, ওদিকে নাকি সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে। বদ্যিপাড়ায় রাতে ডাকাত পড়েছিল। গ্রামের লোকেদের সঙ্গে ডাকাতদের সাংঘাতিক মারামারি হয়। গ্রামের বেশ কিছু লোক হতাহত হয়। জনাপাঁচেক ডাকাত একটা বাড়ির মধ্যে আটকে পড়েছিল। গ্রামের লোকেরা সেই বাড়িতে আগুন দিয়ে দেয়। এখন সেই পাঁচজন ডাকাত ভয়ংকরভাবে পুড়ে গেছে। পুলিশ কোনোভাবে তাদের আমার হেল্থ সেন্টারে নিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু সেখান থেকে আর সদরে নিয়ে আসতে পারছে না। কারণ গ্রামের লোকেরা প্রচণ্ড বাধা দিচ্ছে। ওদিকে পুলিশের উপর পলিটিক্যাল প্রেশার আছে, ওই ডাকাতদের বাঁচানোর চেষ্টা করতে। এখন আমি যদি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অকুস্থলে পৌঁছোতে না পারি, তাহলে বড়োবাবুরও বিপদ আর আমারও বিপদ।

বড়োবাবু আরও বললেন যে আমি যেন বদ্যিপাড়ায় ঢোকার চেষ্টা না করে সরাসরি মাজুরি থানায় যাই। সেখান থেকে পুলিশ এসকর্ট করে আমাকে হেল্থ সেন্টারে নিয়ে যাবে। বুঝলাম পরিস্থিতি খুব গোলমেলে। অবিলম্বে আবার রওনা দিলাম।

মাজুরি থানায় পৌঁছে শুনি ডাকাতির কথা বলা হলেও আসলে এটা রাজনৈতিক লড়াই। আমাদের বদ্যিপাড়া হল একটা পার্টির সমর্থকে ভরা। তারা অন্য পার্টির সমর্থকদের গ্রামছাড়া করেছে। এদের টাইট দেবার জন্য রুলিং পার্টি গুন্ডা পাঠিয়েছিল। তারপরে তো এই কাণ্ড। গোটা বদ্যিপাড়া রাগে, উত্তেজনায় ফুঁসছে। তারা হেল্থ সেন্টার ঘিরে রেখেছে। ইতিমধ্যে টিভি চ্যানেলরাও এসে পড়েছে। এখন যে পাঁচজন হেল্থ সেন্টারে রয়েছে, তারা যতক্ষণ না মরছে, তাদের বার করা সম্ভব নয়।

বড়োবাবুর মুখে এই সমস্ত কথা শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। বললাম, “এ তো মহাজ্বালা। বার্ন পেশেন্টদের খুব সাবধানে রাখতে হয়। নানারকম অ্যান্টিবায়োটিক লাগে, যাতে পোড়া ঘায়ের উপর সেকেন্ডারি ইনফেকশন না হয়। এসব কি সদর ছাড়া হয় নাকি?” বড়োবাবু হাসলেন। বড়ো দুঃখের হাসি। বললেন, ” নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে বলে মনে হয় না। আমি ডাক্তার নই বটে, কিন্তু এসব অ্যাক্সিডেন্ট তো কম দেখিনি। হারামজাদারা যা পোড়া পুড়েছে, আপনার কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। আজ বা কালের মধ্যেই সব সাফ হয়ে যাবে।”

“ওসব প্রবল প্রতিরোধ ডিঙিয়ে আমায় হেল্থ সেন্টারে ঢোকানো হল। পেশেন্ট পাঁচটাকে দেখে বুঝলাম, বড়োবাবুর অভিজ্ঞ চোখ ঠিকই ধরেছে। প্রায় সেভেন্টি পার্সেন্ট থার্ড ডিগ্রি বার্ন। বাঁচানো শিবেরও অসাধ্য।
যা হোক, ওষুধবিশুধের একটা লিস্ট বানিয়ে বড়োবাবুকে ধরিয়ে দিলাম। যা পারেন, নিয়ে আসবেন’খন। আমার কম্পাউন্ডার আর নার্স দু-জনেই পালিয়েছে। একটি মাঝবয়েসি বউকে দেখলাম গুন্ডাগুলির আশপাশে ঘুরঘুর করতে। একে বোধহয় পুলিশ অন্য কোনো জায়গা থেকে জোগাড় করেছে। যা হোক, মুখে একটু জল-টল দিতে পারলেই যথেষ্ট।

আমি আদা-জল খেয়ে পেশেন্টদের চিকিৎসা শুরু করলাম। আমাদের ডাক্তারদের নিয়ম হল কখনও হাল না ছাড়া। যে পেশেন্ট মরবেই, তারও আরোগ্যসাধনের চেষ্টাও সমান গুরুত্ব দিয়েই করতে হবে। এই পেশেন্টগুলোকে প্রথমেই পরিষ্কার জায়গায় রাখতে হবে। তারপরে ঘায়ের উপরে অ্যান্টিসেপটিক মলম দিয়ে সেটা ঢেকে রাখতে হবে। বউটিকে বললাম ঘরটাকে খুব ভালো করে মুছতে। অনেকখানি ডেটল ছিল, বললাম, “বালতির জলে ডেটল দিয়ে দাও।”

ঘণ্টা দেড়েক বাদে থানা থেকে এক কনস্টেবল এসে আমাকে লিস্টের ওষুধগুলো দিয়ে গেল। ইতিমধ্যে সব ক-জনের হাতে চ্যানেল করে ফেলেছি। লোকনাথ বা আরতি থাকলে এই কাজটা অন্তত আমাকে করতে হত না। এরপর . সব ক-জনের ড্রিপ চালু করে দিলাম। তবে এসব করেও যে খুব একটা সুবিধা কিছু হবে তা মনে হচ্ছে না। কাল বা পরত রাত থেকেই এক-এক করে পটোল তুলবে মনে হয় ইতিমধ্যে বউটি ঘর মুছে রান্না করে ফেলেছে। বুঝলাম, এইজন্যই তাকে রাখা হয়েছে। ভাত, ডাল, আলুভাজা-এই হল খাদ্য। কিন্তু মানতেই হবে, খাবারের স্বাদ বড়ো ভালো হয়েছে। ঘর পরিষ্কারের কাজটাও খুব পরিপাটি করে করা হয়েছে। খেতে খেতেই লক্ষ করলাম, একটি পেশেন্ট হেঁচকি তুলছে। তাড়াতাড়ি একটা ইনজেকশন রেডি করে ফুঁড়ে দিলাম।

সারা বিকেল, সন্ধ্যা, রাত্তির এই ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট চালিয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে বড়োবাবু একবার এসে খবর দিয়ে গেলেন, আশপাশের অবস্থা সুবিধার না। আরও লোক জমা হচ্ছে। এরা যে রাতে হেল্থ সেন্টার আক্রমণ করবে না, তার গ্যারান্টি দেয়া যাচ্ছে না। সদর থেকে আরও আর্মড পুলিশ আসছে।

রাত কাটল। আবার সকাল সন্ধ্যা রাত্রি পার হল। পেশেন্টদের অবস্থা একই রকম। বউটিকে দেখলাম, খুব যত্ন করে পেশেন্টদের মুখে একটু করে জল দিয়ে মুখের ভিতরটা ভিজিয়ে দিচ্ছে, অ্যান্টিসেপটিক মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। মন দিয়ে ঘর পরিষ্কার করছে। আর আমি পাগলের মতো এই বেড থেকে ওই বেডে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি।

এইভাবে তিনদিন কাটল। এখন পর্যন্ত একটি পেশেন্টও কিন্তু মরেনি। খুবই আশ্চর্য কথা বলতে হবে। বড়োবাবু ক্রমশ নার্ভাস হয়ে পড়ছেন। বাইরের লোকেরা নাকি ভেবেছিল, এমনিতেই ওরা মরে যাবে, তাই খুব ঝামেলা করেনি। কিন্তু এবার তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। সদর থেকে অল্প ক-জন আর্মড পুলিশ পাঠিয়েছে। তাদের পক্ষে শদুয়েক মারমুখী জনতা সামলানো কতটা সম্ভব হবে, কে জানে। সব মিলিয়ে অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। বড়োবাবু রাতে এখানে থেকে যাবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু ওদিকে আবার একটা ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। সন্ধ্যাবেলা আমাকে সাবধান করে দিয়ে বড়োবাবু চলে গেলেন। বারবার বলে গেলেন, “যদি বাইরের লোকজন হেল্থ সেন্টারের ভিতরে ঢুকে পড়ে, কোনোমতেই কিন্তু বাধা দেবার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনিও মারা পড়বেন। ল-অ্যান্ড-অর্ডার দেখা আপনার কাজ নয়।” বুঝলাম, চাণক্য-শ্লোকে যে পড়েছিলাম ‘আত্মনং সতত রক্ষেত্’—এটা এখানেও খাটবে।

বাইরের গোলমাল বাড়ছিল। নানারকম স্লোগান শোনা যাচ্ছিল। রাত সাড়ে দশটায় চ্যাঁচামেচি তুঙ্গে উঠল। বুঝলাম, সংকট সময় এসে গেছে। হঠাৎ দেখি, বউটি বাইরের দিকে যাচ্ছে। কাজের চাপে নামটাও জানা হয়নি। বললাম, “ও মেয়ে, ওদিকে যেয়ো না। এখনই মারামারি শুরু হবে।” বউটি আমার দিকে তাকিয়ে ভীষণ কনফিডেন্স নিয়ে বলল, “নিশ্চিত্তি থাকেন ডাক্তারবাবা, কিছু হবে না।” তখন খেয়াল করিনি, পরে মনে হয়েছিল, বউটির সারা গা যেন কীরকম জ্বলজ্বল করছিল!

আমি কিছু বলার বা করার আগেই বউটি দরজা খুলে বাইরে দাঁড়াল। ভয়ানক মার মার চিৎকার উঠল। তার পরেই বেশ কয়েকটা আর্তচিৎকার, “এ কী! এ তো দেবী মা!” তারপরেই ‘পালা, পালা’ রব উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সমস্ত গোলমাল ভ্যানিশ!
আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মিনিট পাঁচেক পর কৌতূহল আর সামলাতে না পেরে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকালাম।
চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। কেউ কোথাও নেই। না পুলিশ, না বিক্ষুব্ধ জনগণ, না সেই বউটি। এক্কেবারে শুনশান। আমার কেন জানি না গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি দরজা বন্ধ করে ভিতরে ফিরে গেলাম।

সেই রাত্রে কিছুতেই চোখ থেকে ঘুম দূরে রাখতে পারলাম না। একটানা ঘুমে সারারাত কেটে গেল। কেন জানি না মনের মধ্যে একটা চূড়ান্ত নিশ্চিন্ত বোধ অনুভব করছিলাম। ঘুম ভাঙল বড়োবাবুর ডাকে।
বড়োবাবু অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসেছেন। পাঁচজনকেই অ্যাম্বুলেন্সে চড়িয়ে সোজা কলকাতা রওনা করে দেওয়া হল। আমাকে বড়োবাবু ছাড়লেন না। সোজা নিয়ে তুললেন তাঁর কোয়ার্টারে। ওঁর স্ত্রী চা, লুচি, আলুর চচ্চড়ি মুখের সামনে ধরলেন। আমি বারবার জানতে চাইছিলাম, ব্যাপারটা ঠিক কী হল। উনি খালি হাসেন আর বলেন, “এসব আমাদের গেঁয়োদের ব্যাপার, পরে বলছি।”
আমি একসময় জেদ ধরে বললাম, “আমায় সব খুলে না বললে, এই রইল আপনার চা, লুচি। আমি চললাম।” বড়োবাবুর স্ত্রী বললেন, “আমি বলছি। আচ্ছা ডাক্তারবাবু, ও বলছিল, ওই ডাকাতগুলো খুব বাজেভাবেই পুড়ে গিয়েছিল; সত্যি?”

“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”
“অথচ একজনও মরেনি। এটা অদ্ভুত না?” “অদ্ভুত মানে! ডাক্তারি বিজ্ঞানের দিক থেকে মিরাল বলতে হয়।”
“আসলে কাল রাতে সবাই মা-কে দেখেছিল। তিনি ওদের রক্ষা করছিলেন। এরপরে আর কার সাহস হবে ওদের গায়ে হাত দেবার ?”
“মা! কে মা?”

“উনি এই আশপাশের অনেকগুলো গাঁয়ের রক্ষাকর্ত্রী দেবী। বদ্যিপাড়ায় ওঁর থান আছে।”
“বাজে কথা। ও তো একটা গ্রাম্য বউ, এ ক-দিন আমার কাজকর্ম করে দিয়েছিল। তবে অবসর সময়ে রোগীর সেবাও করছিল। তাকে দেখেই তো লোকজন পালাল।”
বড়োবাবু বললেন, “কী বলছেন ডাক্তারবাবু? ওই ভয়ানক অবস্থায় কোনো বউ হেল্থ সেন্টারের ভিতরে কাজ করার সাহস করবে? আপনি তো একাই ছিলেন।”

“মানে! দু-বেলা আমার রান্না করে খাওয়াল কে? পরিপাটি করে ঘর পরিষ্কার করল কে? রোগীদের সেবা করছিল কে?” বড়োবাবুর স্ত্রী হঠাৎ আকাশে চোখ তুলে হাত জোড় করে বলে উঠলেন, “জয় মা, জয় মা!” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ডাক্তারবাবু, আপনি ধন্য, আপনাকে চোখের দেখা দেখতে পাওয়াও ভাগ্যের কথা। রোগের সঙ্গে আপনার লড়াই দেখে মা আপনাকে কৃপা করেছিলেন, তাই তিন দিন ধরে আপনাকে সম্ভানজ্ঞানে পালন করে গেছেন।”

আমার সমস্ত গুলিয়ে যাচ্ছিল। বললাম, “ওই বউটি মানুষ নয়? দেবী ? ”
“তা না হলে পাঁচটা ওরকম ভয়ংকর পোড়া রোগীই বেঁচে গেল কী করে? বলুন ?”
আমার আর কিছুই বলার ছিল না। রাজ্যের হাবিজাবি শুনে মাথা এলোমেলো হয়ে, পাগল হতে আর সামান্যই বাকি ছিল। অকারণ কথা না বাড়িয়ে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম।

পরদিন যখন লোকনাথ আর গায়ত্রী ফিরে এল, তখন অন্তত তিন-চার দিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসব, ঠিক করলাম। সেদিন বিকেলে হেল্থ সেন্টারে এক বুড়ো এসে উপস্থিত। বুড়োর পিঠে একটা কার্বাংকল অপারেশন করার কথা। সদরে রেফার করার কথা লিখে দিচ্ছিলাম। বুড়ো হঠাৎ বলল, “আপনিই করে দেন না। হাজার হোক, আপনার উপর দেবী মা-র কৃপা আছে।”
আমি বললাম, “এই দেবী মা শুনে শুনে পাগল হবার জোগাড়। ব্যাপারটা কী, কেউ ঠিক করে বলবে?”
বুড়ো গুছিয়ে বসে বলল, “শোনেন তবে ডাক্তারবাবু, অনেকদিন আগে…”

বুড়োর গল্পটা নিজের ভাষায় বলছি।
বহু, বহুদিন আগে ইংরেজ আমলের প্রথমদিকে, এই বদ্যিপাড়া একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। এখানকার ভূস্বামী ছিলেন একটি বৈদ্য পরিবার। তবে তাদের বংশে চিকিৎসাবিদ্যাচর্চার কোনো স্থান ছিল না। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময় জমিদারি ছিল দুই শরিকে বিভক্ত। বড়ো তরফে বিষ্ণুপদ সেন আর ছোটো তরফে পার্থসখা সেন।

পার্থসখা বিপত্নীক হবার পর তাঁর আবার বিবাহ হয়
খুলনার একটি বিখ্যাত কিন্তু দরিদ্র বৈদ্য পরিবারের কন্যার সঙ্গে। এই কন্যার পিতাকে সবাই ধন্বন্তরি বলত। মেয়েটিও বাবার সান্নিধ্যে অনেকটাই কবিরাজি চিকিৎসা আয়ত্ত করে ফেলেছিল। কিন্তু বিয়ের বছর দেড়েকের মধ্যেই সর্বনাশ হল। পার্থসখা সর্পাঘাতে মারা গেলেন।

বিষ্ণুপদ দেখলেন বিষয়সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার এক চমৎকার সুযোগ উপস্থিত। তিনি চারদিকে ঘোষণা করে দিলেন যে পার্থসখার স্ত্রী স্বামীর চিতায় সতী হতে চেয়েছেন। তখনও লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ নিষিদ্ধ করেননি। তখনকার দিনে যেমন হত, প্রবল ধোঁয়া, ঢাকঢোল বাজিয়ে আফিমের নেশায় আচ্ছন্ন মেয়েটিকে চিতায় তুলে দেবার বন্দোবস্ত পাকা। কিন্তু গোল বাধালেন স্থানীয় সাহেব কালেক্টর। তিনি এসে সরাসরি বললেন, “এ তো খুন করা হচ্ছে!”

বিষ্ণুপদর অনুগত লোকজন, লাঠিয়াল কম ছিল না। তারা প্রবল প্রতিবাদ জানাল। বলল, ‘ “এটা আমাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে!”
সাহেবও ছাড়ার পাত্র নন। বললেন, “মেয়েটির সম্মতি ছাড়া তাকে সতী করা যায় না।”
বিষ্ণুপদ হইচই করে বললেন, “বউমার সম্মতি না থাকলে কি আর এত বড়ো একটা কাণ্ড করতে পারি? আমি কত করে বারণ করলাম, কিন্তু তিনি একেবারেই গোঁ ধরে বসেছেন। এখন যদি মায়ার বসে তাঁকে সহমরণে বাধা দিই তাহলে তো মহাপাপ হবে।”

সাহেব বললেন, “বেশ, আমি তোমার বউমাকে নিজে প্রশ্ন করতে চাই।”
সাহেব কথা বলবে ঘরের বউয়ের সঙ্গে? সবার প্রবল আপত্তি। কিন্তু সাহেবের সাফ কথা, “আমি যতক্ষণ না নিজের কানে সম্মতির কথা শুনছি, আমি সতীদাহ হতে দেব না।”
সাহেবের হাতে বন্দুক, সঙ্গে সড়কিধারী পাইক। ফলে সাহেবের জেদ বজায় রইল। সতীকে সাহেব প্রশ্ন করলেন, “তুমি সতী হতে চাও?”
আফিমের ঘোরের মধ্যেও স্পষ্ট গলায় উত্তর এল, “না।” “এরা তোমায় জোর করে পুড়িয়ে মারতে চাইছে?” “হ্যাঁ।”

এইবার সাহেব মারাত্মক খেপে গেলেন। পাইকদের বললেন চিতা নিবিয়ে মড়াটা কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিতে। সাপে কাটা মানুষকে তখন তা-ই করা হত। তারপর বিষ্ণুপদ আর তার প্রধান সমর্থকদের নিজের কাছারিতে বেঁধে নিয়ে গেলেন। বললেন, “তোমরা জঘন্য খুনে বদমাশ! তোমাদের ফাঁসি দেওয়াই উচিত ছিল। তবে আমি দয়া করে তোমাদের ডান হাত কবজি থেকে কেটে ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু মনে রেখো, আবার যদি ওই মহিলার উপর কোনো আক্রমণ হয়, তাহলে বাড়িসুদ্ধ জ্যাস্ত পুড়িয়ে মারব! আমার নাম পাগলা ডেভিডসন। আমি যা বলি তা-ই করি।”
বিষ্ণুপদ ডান হাত হারিয়ে বউমাকে অভিশাপ দিতে দিতে ফিরে এলেন। কিন্তু সাহেবের ভয়ে আর কিছু করতে সাহস পেলেন না। প্রতিহিংসা নেবার কথা মনে রেখে, স্রেফ গুমরে মরতে থাকলেন।

সেকালে এত বড়ো কাণ্ডের পর বিধবা বউটির যাবার কোনো জায়গা থাকার কথা নয়। বাপের বাড়ির দরজাও তার কাছে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য মেয়েটির মনের জোর। সে শ্মশানের ধারে ডোমপাড়ায় একটা ঝুপড়ি বানিয়ে বাস করতে শুরু করল। ডোমের মেয়েরা তাকে দয়া করে অখাদ্য-কুখাদ্য যা দিত, তাতেই সে ক্ষুন্নিবৃত্তি করত।

কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, ডোমপাড়ার একটি বউয়ের সন্তান হবার সময়ে প্রচণ্ড সমস্যা হচ্ছিল, নিশ্চিত মারাই যেত। কিন্তু বৈদ্য বংশের এই মেয়েটির চিকিৎসা ও শুশ্রূষায় মা ও সন্তান দু-জনেই বহাল তবিয়তে বেঁচে রইল। কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটি আশপাশের সমস্ত অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের চিকিৎসা আরম্ভ করল। চিকিৎসক হিসাবে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। সবাই তাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করতে শুরু করল। মেয়েটির স্বামীর দেহ দাহ হয়নি বলে মেয়েটি সধবার বেশেই থাকত। এইভাবে বছর পাঁচেক কেটে গেল।

এমন সময়ে একদিন খবর এল, পাগলা ডেভিডসন বদলি হয়ে গেছে। কিন্তু নতুন কালেক্টরকে সে বলে গেছে বদ্যিপাড়ার বিষ্ণুপদ সেনের দিকে নজর রাখার কথা। আর ডোম, মালো ইত্যাদি অন্ত্যজরাও তখন এই বৈদ্য-কন্যাকে প্রচণ্ড ভক্তি করে। তাদের মধ্যে থাকা এই মেয়েটির কোনো ক্ষতি করা অত সহজ নয়। বিষ্ণুপদ এক জটিল মতলব পাকিয়ে তুললেন।

সে সময়ের বিখ্যাত ডাকাত ছিল যশোরের নদে ডাকাত। বিষ্ণুপদ অনেক পরিশ্রম করে এই নদে ডাকাতের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে নিজের বউমাকে হত্যা করার সুপারি দিলেন। অর্থের অঙ্ক অবিশ্বাস্যরকম বেশি। নদে ডাকাত লোভে পড়ে নারীহত্যার পাপ করতে রাজি হয়ে গেল ।

এক অমাবস্যার রাতে হা রে রে রে করে ডোমপাড়ায় ডাকাত পড়ল। কপর্দকশূন্য ডোমেদের বাড়ি যে কেউ ডাকাতি করতে পারে, সেটা কেউই ভেবে উঠতে পারেনি। সব ক-টা বাড়িতে ডাকাতরা আগুন লাগিয়ে দিল। তারপর গোলমালের মাঝে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেল। তারপর কিছু দূরে গিয়ে মেয়েটিকে তারা হত্যা করল। প্রমাণ লোপাটের জন্য দেহটিকে গাঙের জলে ভাসিয়ে দেয়া হল।
ডাকাতদের এ পর্যন্ত কেউ বাধা দেয়নি। কিন্তু যখন তারা সব কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছে, তখন দ্যাখে, শয়ে শয়ে মশাল নিয়ে কারা যেন তেড়ে আসছে। আসলে যখন ডোমেরা দেখল যে ডাকাতরা বৈদ্য-কন্যাকে তুলে নিয়ে গেছে, তখন পাড়ায় পাড়ায় খবর পাঠিয়ে সবাই মিলে যে যা অস্ত্র পেল তা-ই নিয়ে তারা ডাকাতদের পেছনে তাড়া করেছিল।

এবারে লাগল সত্যিকারের যুদ্ধ। ডোমেরা প্রাণের ভয় ছেড়ে ডাকাতদের আক্রমণ করল। লাঠি আর সড়কিতে তারাও কম যায় না। সংখ্যায় তারা ডাকাতদের দশগুণ। কাজেই একসময় ডাকাতদলের একটা বড়ো অংশ মারা গেল, আর বাকিরা পালাল। স্বয়ং নদে ডাকাত মাথায় আর পায়ে সড়কির চোট খেয়ে এক বট গাছের তলায় পড়ে রইল। ডোমরা, মরে গেছে বলে, তাকে ফেলে গিয়েছিল, অবশ্য ডাকাত সর্দার বলে চিনতেও পারেনি।

অনেকক্ষণ পরে নদে ডাকাতের জ্ঞান ফিরে এল। রক্তক্ষরণে অতি দুর্বল। নিজের হাল দেখে সে বুঝতে পারল, সে আর দিনকয়েক মাত্র বাঁচবে। রক্তক্ষরণে না হলেও এতগুলো ঘা বিষিয়ে গিয়ে মৃত্যু অনিবার্য। বট গাছতলায় পড়ে সে নিকটাগত মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে লাগল।

এমন সময় সে দেখল, গাছের তলাটা আলো হয়ে উঠেছে। আর আলোর উৎস হল সেই মেয়েটি, যাকে সে কিছুক্ষণ আগে পাশবিকভাবে হত্যা করেছে। মেয়েটি নদে ডাকাতের মাথার কাছে এসে দাঁড়াল।
মৃত্যুপথযাত্রী নদের প্রাণে তখন আর ভয় কীসের? সে বলল, “শেষে তুইও এসে জুটলি পিশাচিনী? নে, কী করবি কর। আমার ঘাড় মটকা, আমার কলজে ছিঁড়ে কচকচ করে খা। যা পারিস, কর। তাতে যদি আমার পাপ কিছু কমে।” কিন্তু নদে অবাক হয়ে দেখল, এই উজ্জ্বল দেবীমূর্তি তার শরীরের বিকট বিকট ঘায়ে ঠান্ডা কী সব জিনিস লেপে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে ভোরের আলো ফুটল।

নদে বুঝতে পারছে, তার প্রবল জ্বর আসছে। কিন্তু দেবী তার সেবা করেই চলেছেন। মুখে জল দিচ্ছেন, মাথায় জলপটি দিচ্ছেন আর সারা গায়ের ঘাগুলোর পরিচর্যা করছেন। আস্তে আস্তে জ্বরের ঘোরে নদে অচৈতন্য হয়ে পড়ল।

দিন দুয়েক পরে আস্তে আস্তে নদের জ্বর নামল। শরীর অসম্ভব দুর্বল। মাথার কাছে সেই মাতৃমূর্তি বসে রয়েছেন। নদে চোখ খুলতে দেবী তার মুখে এক বাটি গরম দুধ ধরলেন। নদে আস্তে আস্তে দুধটুকু খেয়ে নিল। তারপর বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তোমাকে তো আমি দিন তিনেক আগেই খুন করেছি। তুমি কোথা থেকে এলে?”
দেবী উত্তর দিলেন, “ধরো, পরলোক থেকেই এসেছি।”

“কেন?”
“তোমার চিকিৎসা করার জন্য। না হলে তুমি বাঁচতে ?”

নদে ডাকাত সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে বলল, “সেটাই তো বুঝতে পারছি না, মা। আমি তোমায় হত্যা করলাম আর পরলোক থেকে তুমি আমাকে বাঁচাতে নেমে এলে? কেন?” “মা বলে যখন ডাকলে, তখন এটাও নিশ্চয়ই বোঝো যে মা সব সময় সন্তানকে বাঁচানোর চেষ্টাই করে।”
নদে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর তার দু-চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। হয়তো তার জীবনে এই প্রথমবার সে কাঁদল। বেশ কিছুক্ষণ পরে অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলল, “আমায় কেন বাঁচালে মা? আমি পাপী, মহাপাপী।”

“নিজে যদি মন থেকে বুঝে থাকো যে তুমি পাপ করেছ, তাহলে এবার নিজেকে পালটে ফ্যালো। আর পাপ কোরো না। বরং যা পুণ্য মনে হয় তা-ই করো। আমি এবারে চলে যাব। তুমি এখানেই থাকো। তোমার দলের দু-একজন এখনই এখানে এসে পড়বে। তাদের সঙ্গে যেয়ো। আর ভয় নেই। তুমি আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠবে।”

এর মাসখানেক পরে একদিন নদে ডাকাত বদ্যিপাড়া গ্রামের শ্মশানের ধারে ডোমপাড়ায় উপস্থিত হল, একা। ইতিমধ্যে সেখানে আর-একটা কাণ্ড হয়েছে। সেই রাতে ডাকাতের দলকে তাড়িয়ে ফিরে এসে ডোমেরা জমিদারবাড়ি আক্রমণ করে আগুন লাগিয়ে দেয়। কয়েকজন প্রাণে বাঁচলেও বিষ্ণুপদ সেন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান।
নদে ডাকাতকে দেখে কিন্তু ডোমরা তাকে আক্রমণ করে না। ডোমপাড়ার সর্দার তাকে সমাদরে বসায়। তারপর জানায়, পরপর কয়েক রাত দেবী মা তাকে স্বপ্নে জানিয়েছেন যে নদে এখানে আসছে। তার যেন কোনো ক্ষতি না করা হয়।

নদে তার পিঠের পুঁটলি খুলে একগাদা সোনার মোহর ঢেলে দেয়। এই তার সমস্ত সম্বল। সে জানায়, তার ইচ্ছা, এই বদ্যিপাড়ায় যেন দেবী মা-র একটা বিরাট মন্দির তৈরি হয়। মন্দির তৈরির উদ্যোগ যখন শুরু হল, তখন কর্মকর্তারা আবার মায়ের কাছ থেকে স্বপ্ন পেল যে দেবী মা মন্দির চান না। বরং এখানে যেন একটা বড়ো কবিরাজি টোল খোলা হয়, যাতে আশপাশের ছেলেরা কবিরাজি শিখতে পারে।

তা-ই হল। সেই থেকে এই গাঁয়ের নাম বদ্যিপাড়া। আগে অন্য নাম ছিল। টোল হবার পর নদে নিজের শারীরিক শ্রমে একটা ছোটো ঝোপড়া বানিয়ে সেখানে দেবী মা-র মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। বাকি জীবন সে সেখানেই পড়ে থাকত আর মায়ের মহিমার কথা প্রচার করত। কবিরাজি টোল কালক্রমে উঠে গেলেও দেবী মা-র ধান আজও আছে। আশপাশের গ্রামের রোগীরা আজও মায়ের কৃপা পেতে মায়ের ধানে হত্যে দেয়।
এই হল বদ্যিপাড়ার দেবী মায়ের গল্প।

ডাক্তার মল্লিক গল্প শেষ করে চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “হাসপাতালে সবাই আমায় ধন্বন্তরি বলত। কিন্তু আমি তো আমার দৌড় জানি। যে-কোনো সিরিয়াস পেশেন্ট দেখার আগে আমি মনে মনে দেবী মায়ের পায়ে একবার গড় করি। বলি, তোমার সন্তানকে তুমিই রক্ষা করো, মা। আমি নিমিত্তমাত্র।”
একবার আকাশের পানে নমস্কার করে ডাক্তার মল্লিক উঠে গেলেন।

সমাপ্ত

Download Bangla books pdf free

Be the first to comment

Leave a Reply