গঙ্গাধরের বিয়ে – অরিজিত ভট্টাচার্য Gongadharer Biye by Arijit Bhattacharyay

গঙ্গাধরের বিয়ে - অরিজিত ভট্টাচার্য Gongadharer Biye by Arijit Bhattacharyay
গঙ্গাধরের বিয়ে - অরিজিত ভট্টাচার্য Gongadharer Biye by Arijit Bhattacharyay

অরিজিত ভট্টাচার্য ভয়ংকর হরর গল্প গঙ্গাধরের বিয়ে পড়ুন। গঙ্গাধরের বিয়ে গল্পটি হরোর ও থ্রিলার গল্পের ধারণাই পাল্টে দিবে।

গঙ্গাধরের বিয়ে - অরিজিত ভট্টাচার্য Gongadharer Biye by Arijit Bhattacharyay
গঙ্গাধরের বিয়ে – অরিজিত ভট্টাচার্য

গঙ্গাধরের বিয়ে কাহিনী সংক্ষেপঃ

বিত্তশালী বিরাট চক্কোত্তি পরিবারের হেড গঙ্গাধরের আজ হঠাৎ করেই নাভিশ্বাস উঠেছে। এই মাঝরাতে সব্বাই ছুটে এসে ভিড় করেছে গঙ্গাধরের ঘরে। মরার আগে উনি এক ভীষণ জরুরি ও গোপন কথা বলে যেতে চান! কী এমন গোপন কথা যা বাড়ির সকলকে একসঙ্গেই বলতে হবে? গঙ্গাধরের বউয়ের বয়স ষোলোর পর আর বাড়েনি কেন?

গঙ্গাধরের বিয়ে কাহিনী পড়ুনঃ

বিত্তশালী বিরাট চক্কোত্তি পরিবারে এই রাতবিরেতে আজ ভীষণ হুলুস্থুল কাণ্ড। এই বাড়ির, থুড়ি এই বিরাট চক্কোত্তি পরিবারের সবথেকে প্রবীণ মানুষ, যার থেকে এই বিশাল পরিবারের সকলে শাখা-প্রশাখার মতোন এখনও বেড়ে চলেছে, সেই শাখার মূল কাণ্ড, সেই গঙ্গাধরের আজ হঠাৎ করেই নাভিশ্বাস উঠেছে। যদিও ওনার বয়েস এখন নব্বই ছাড়িয়ে গেছে, তবুও পরিবারের সবথেকে প্রবীণ মানুষ বলে এই মাঝরাতে যে যেখানে ছিল সব্বাই ছুটে এসে ভিড় করেছে ঘরের ভেতরে।

গ্রেভ ইয়ার্ড শিফ্ট – সৌম্য সাহা Grave Yard Shift pdf by Soumya Saha

বাড়ির সকলে একসঙ্গে ছোটাছুটি করে ওনার ঘরে আসার আরও একটা জব্বর কারণ আছে বই কি। কথায় বলে, মৃতপ্রায় মানুষের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে হয়। এই বাড়ির সকলের কাছে ওনার কী একটা ভীষণ জরুরি বক্তব্য রয়েছে। আর সেটা উনি বাড়ির সকলকে একসঙ্গেই বলতে চান, এটাই নাকি ওনার শেষ ইচ্ছে।

দেখ কাণ্ড, এতক্ষণ ধরে বকর বকর করছি, অথচ আমার পরিচয়টাই আপনাদের কাউকে বলা হয়নি। আমি হলাম এই চক্কোত্তি পরিবারেরই নবীন সদস্য, নাম সমরেশ চক্কোত্তি, পেশায় ডাক্তার।

এই বিশাল বিত্তশালী পরিবারের কাণ্ডারি গঙ্গাধর চক্কোত্তি ওনার বাবার ছোটো আর নড়বড়ে ব্যবসাকে বিয়ের পর পরই বুদ্ধি, খাটুনি আর কৌশল দিয়েই সমৃদ্ধ করে তোলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। যদিও ওনার সকল নিন্দুকরা বলে, পরিবারের এই বিরাট উন্নতির সামনের দিকে গঙ্গাধরের নাম এবং মুখ থাকলেও এত সব কিছুর পেছনে আছে ওনার স্ত্রী।

আমি পড়াশোনার জন্য অনেক ছোটোবেলায় কলকাতায় চলে গেছিলাম। ওখানেই প্রথমে হোস্টেলে থেকে পড়তাম, তারপর স্কুল পাশ করে কলকাতায় যখন ডাক্তারি পড়ছি সেইসময় একদিন গঙ্গাধরদাদুর একটা চিঠি পেলাম । তাতে কয়েকটা লাইন লেখা- “এই বুড়ো বয়েসে রাতবিরেতে কিছু হলে যাব কই বাছা? তার থেকে বাপু তাড়াতাড়ি পাশ-টাশ করে ঝটাপটি তুমি এখানেই চলে এইসো, বাড়ির আর পাঁচজনের মতোন তুমিও থেকো এইখানে। আশীর্বাদ নিয়ো। ইতি তোমার দাদু।”

ব্যস!

তো যেটা বলছিলুম। এই বাড়ির অমন বিপদের সময় না জেনেই আমি কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলাম, তাই আমি এখন আপনাদের যা বলছি তার প্রায় পুরোটাই অন্যদের টুকরো-টুকরো কথা জুড়ে বলছি।

যা-ই হোক, সেই রাতে গঙ্গাধরদাদুর হঠাৎ করেই ভীষণ নাভিশ্বাস ওঠায় বাড়ির সকলে যে যেখানে ছিল সকলেই ওনার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে। এখন এই পরিবারের সব বুদ্ধিমান মানুষরা ভাবলে (পরিবারের বুদ্ধিমান বলতে কাদের বলছি তা আপনাদের মতোন বুদ্ধিমানদের নিশ্চয়ই ভেঙে বলতে হবে না) মৃত্যুর দোর-গোড়ায় এসে কোনো মানুষ মোটেই মিথ্যা কথা বলেন না, বরং বাড়ির সকলের মঙ্গলের জন্য অনেক আশীর্বাদ (এটা বলতে দামি অলংকার, টাকা পয়সা মায় কী গুপ্তধনও হতে পারে) করে যান, যদিও এটা ওনাদের প্রায় সকলেরই শোনা কথা। ঠিক সেই কারণেই এখন ঘরে তিল ধারণের জায়গা নেই।

দেবী মা – ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় Devi Maa by Tridibendra Narayan Chattapadhyay

এই অবস্থায় কেউ-কেউ মাথায় পাখার হাওয়া দিচ্ছে (যদিও ওনার মাথার ওপরে বনবন করে ইলেকট্রিক পাখা ঘুরছে), কেউ পা টিপে দিচ্ছে, কেউ আবার নতুন কেনা ধুতি নিয়ে কপালের একফোঁটা ঘাম হলেই মুছে দেওয়ার জন্য ওঁত পেতে বসে আছে, কেউ মুখের সামনে কাঁসার গেলাসে লবঙ্গ, এলাচ আর মিছরি ভেজানো জল বার বার করে এগিয়ে দিচ্ছে (যে ব্যক্তির ঘন ঘন নাভিশ্বাস উঠছে সে ওই জল খাবে কীভাবে তা ঈশ্বরই জানেন), কেউ কেউ আবার ভীষণ মনযোগ সহকারে বৃদ্ধের মুখের একেবারে কাছে নিজের কানটা প্রায় ঠেকিয়ে রেখেছে, যাতে ওনার বলা শেষ কোনো কথাই যেন অধরা নাথাকে। সবাই যখন যে যার মতোন করে সেবা করছেন, ঠিক তখনই বৃদ্ধের ঠোঁট দুটো সামান্য কেঁপে উঠল আর সেটা দেখে ওখানে উপস্থিত সকলের মধ্যেই একটা উত্তেজনা হঠাৎ করে জেগে উঠল।

একজন হাতুড়ে ডাক্তারকে কোথা থেকে জোগাড় করে আনা হয়েছে ওই সময়। সে মাঝে মাঝেই ওনার বাঁ-হাতের নাড়ি টিপে দেখছে। মানে ওটাই বোধহয় ওনার একমাত্র কাজ আর কী! এইখানে আর একটা কথা বলে রাখা ভালো। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যতদিন এখানে ছিলাম ততদিন দেখেছি, দাদু কিন্তু ওনার বউ, মানে আমার দিদা অন্তপ্রাণ। তো সে তো অনেকেই হয়ে থাকেন। কিন্তু দাদুর কারণটা আমরা সকলেই বুঝতাম। কীভাবে? না না তেমন কঠিন নয়। আমার দিদার বয়স বাড়ে না। উঁহু! চমকানোর কিছু নেই। এটা কিন্তু সত্যি। দিদাকে দেখলে এখনও সেই ষোড়শী মনে হয়। ছোটোবেলায় আমারও অবাক লাগত বটে, কিন্তু এখন আমার ডাক্তারি বুদ্ধিতে মনে হয় এটা একরকমের অসুখ, এতে বাইরে থেকে কোনো রকমের পরিবর্তন হয় না ঠিকই কিন্তু ভেতর ভেতর বয়স বেড়েই চলে।

দিদার ব্যপারটাও বোধকরি অনেকটা তেমনি। তাই দাদুও সবসময় দিদার ওপরে গদগদ থাকতেন। এক মুহূর্ত ওনাকে ছাড়া চলে না দাদুর। এবারে আসল ঘটনায় ফিরে আসি। বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করার পর দাদু মুখ তুলে প্রথম চোখ পিট পিট করে মাথার ওপরের পাখার দিকে একবার তাকালেন, তারপর একবার নিজের ডান দিকে, বাঁ দিকে আর পায়ের নীচের দিকে তাকালেন যেন কাউকে খুঁজছেন। কিন্তু মুখের ভাব দেখে মনে হল, উনি যেন এই জন-সমাগমটায় প্রীত হয়েছেন। তারপর অনেক কষ্টে একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে মুখ খুললেন-“আজ আমি মৃত্যুশয্যায়। আমি বুঝতে পারছি এই পৃথিবীতে আমার আর বেশি সময় অবশিষ্ট নেই। তাই আজ তোমাদের সকলকে একটা কথা আমি বলতে চাই। যদিও এই কথাটা আমি গতকালই জানতে পেরেছি।” বলে উনি একবার চুপ করলেন।

অমনি ঘরের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন শুরু হল। সে কী! গতকাল এমন কী জানতে পেরেছেন উনি? তাহলে কি গুপ্তধনের হদিশ পেয়েছেন নাকি?
আমার বাবা একটু দেরিতে আসায় সামনের দিকে জায়গা পায়নি, তাই উনি একটু পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

দাদুর কথা শেষ হতেই বোধকরি বাড়ির সকলের উদ্দেশে বললে, “আরে মা কই গেল? মা কে দেখছি না যে? মা এলেই তো বাবা সুস্থ হয়ে উঠবেন আবার।”
আবার ঘরে মৃদু গুঞ্জন শুরু হল। তার মধ্যেই কেউ একজন একটু গলা তুলে বললে, “মায়ের ঘর ভেতর থেকে বন্ধ দেখলুম। ডেকেও যে কোনো সাড়া পেলুম না..”

এই কথা শেষ করার আগেই দাদুর আবার ঠোঁট ফাঁক হতেই ঘরের সকলে চুপ। যেন মন্ত্রবলে সকলকেই নিমেষে চুপ করে দেওয়া হল। হাজার হোক, ওনার কথা শোনা দরকার বই কি। বৃদ্ধ এবারে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “এখন আমি যা বলব তার সূত্রপাত আমার বিয়ের দিন থেকে। আজ ভাবি, আমি যদি ওইদিন বিবাহ না করতাম তাহলে আজ আমার এই দশা হত না। আর আমার কপালেরও বলিহারি, এই ভীষণ রহস্যের উন্মোচন হল কিনা আমার মৃত্যুর ঠিক আগের দিন। হা ঈশ্বর। গতজন্মের কোন্ পাপের সাজা তুমি আমায় দিলে?”

বৃদ্ধের জ্যেষ্ঠপুত্র রাজকুমারের বয়স হয়েছে। উনিও এই ঘরে উপস্থিত। উনি ওনার বাবার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সব কিছু লক্ষ করছিলেন কিন্তু এবারে বাবার কথার মাঝেই নিজের গলা পরিষ্কার করে প্রশ্ন করলেন, “বাবা! অমন অলুক্ষণে কথা বলো না। তুমি মারা যাবে কেন! মা-কে ডাকব নাকি? ”
বৃদ্ধের তখন আবার শ্বাসকষ্ট উঠছে ওই কথা শুনে। সেই অবস্থাতেই উনি বড়ো ছেলের দিকে তাকালেন, সেই তাকানোয় ভর্ৎসনার জন্য যা যা শব্দ হয় তা অনুমান করা যায় স্পষ্ট, কিন্তু ওনার মুখ থেকে শুধু বেরোল-“হতভাগা। তোর মায়ের নাম আমার সামনে উচ্চারণ করলে আমি তোকে ত্যাজ্যপুত্র করব বলে দিলুম।”

বড়োছেলে কাঁচুমাচু মুখে একটু পিছিয়ে যেতেই বৃদ্ধ আবার মুখ খুললেন। বললেন, “সেইদিন আমার বাবার সঙ্গে বেশ একচোট রাগারাগি হয়ে গেল। বাবার ইচ্ছে, পড়াশুনা আমার শেষ, এবার আমায় এখুনি বিয়ে করতে হবে। কিন্তু আমার তখন রক্ত টগবগ করে ফুটছে। এই সময় বিয়ে করা মানেই একগাদা দায়িত্ব, ঝামেলা, বউয়ের মুখ ঝামটা। সারাটা দিন এটা করো ওটা আনো, আমি ওই, তুমি সেই, ওনার বাপের বাড়ি, আমার শ্বশুরবাড়ি, কান্নাকাটি, বাচ্চা-কাচ্চা, ধুর ধুর! কোথায় এখন আমার নিজের মতোন কাটানোর সময়, কত কিছু দেখার ইচ্ছে, দেশের কাজে লাগার ইচ্ছে, তা না! খালি বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে!

“কিন্তু কথায় আছে, ‘কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কী।’ আমারও ছিল না। তাই তো একরকম জোর করেই আমার বিয়ে ঠিক হল নবগ্রামের এক মেয়ে যশোদার সঙ্গে। মেয়েটি ষোড়শী। কথা নাকি আগে থেকেই ঠিক করা। আমার বাবা শুধুমাত্র আমার পড়া শেষ করার অপেক্ষায় ছিলেন এতদিন। এই কথা শুনে রাগে আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। এত করে বলা সত্ত্বেও আমার কথা কেউ শুনলে না! বেশ। আমার শরীরেও যদি এই চক্কোত্তি বংশের রক্ত থাকে তাহলে আমিও বিয়ে করব না এই মনস্থির করলাম।

“বিয়ের ঠিক আগের রাতেই চুপিসারে আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব ঠিক করেছিলাম। তখন কিন্তু অনেকেই এমনভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেত। কিন্তু বরাত মন্দ, ওই রাতেই আমার এমন এক রাক্ষুসে ঘুম ধরল যে চোখ খুলল একেবারে সকাল ন-টায় বাবার ডাকে। কী কপাল!”

বাড়ির সব সদস্যরা এতক্ষণ ধরে ওনার থেকে কোনো মূল্যবান জিনিসের খবর শোনার জন্য বসে ছিল একভাবে। (এখানে একটু ছোটো করে বলে রাখি, এই পরিবার তো বটেই, কিন্তু বাইরের বহু মানুষের মধ্যেও কানাঘুষো চলে যে, এই চক্কোত্তি পরিবারে নাকি সত্যি সত্যিই গুপ্তধন রয়েছে। আর তার হদিশ নাকি রয়েছে একমাত্র এই গঙ্গাধর চক্কোত্তির কাছেই। সেই গুপ্তধনেই নাকি এত বড়ো ব্যবসা ওদের।) এখনও পর্যন্ত সেই ব্যাপারে কিছুই শুনতে না-পাওয়ায় অনেকেই বেশ অধৈর্য হয়ে উঠেছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এর মাঝেই বৃদ্ধের মেজোছেলে নবকুমার দাদুর বলা ঘটনাটা একটু ত্বরান্বিত করার জন্য বলল, “আপনি কি তাহলে বিয়েটা করলেন বাবা।”

গরম তেল ভরতি কড়াইতে কয়েক ছিটে জল পড়লে যেমন আওয়াজ হয়, নবকুমারের কথাতেও বৃদ্ধের মুখের অভিব্যক্তি যেন তেমনটাই হল। বৃদ্ধ মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “যতসব অপগণ্ড, বিয়ে না করলে তোমাদের মতোন এমন রামছাগল এল কোত্থেকে!” জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন হয়, নবকুমারের মুখটাও যেন তেমনটাই কুঁচকে গেল।

“সময় মতোন আর জায়গা মতোই শেষমেশ আমার বাবার পছন্দের মেয়ের সঙ্গে বিয়েটা হয়েই গেল। শ্বশুরবাড়ি থেকে দুপুর থাকতেই একটা গোরুরগাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম আমার বাড়ির দিকে। বাঙালবাড়ির নিয়ম, বিয়ে করে সন্ধ্যার পর বউ নিয়ে বাড়ি ঢুকতে হয়। আমরাও সেই নিয়ম মেনেই রওনা দিয়েছি। এদিকে মনের ভেতর হাজার রকমের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে, ঠিক করলাম তো বিয়েটা করে? আবার মনে হচ্ছে, বিয়ে হলেই আদৌ কী সব আনন্দ মাটি হয়? যদি আমার বউটা সবার থেকে একটু আলাদা হয়? এইসব কথা ভাবতে ভাবতে আর সেইসব সম্ভাবনার জন্য আমার কী কী করা উচিত তা ভাবতে ভাবতেই আমরা একটা ছোট্ট মতোন জঙ্গলের ভেতর এসে পড়লাম।

আমাদের গ্রামে ঢোকার আগে এই ছোটো জঙ্গলের ভেতর দিয়েই যেতে হয়। যদিও কারওর মুখে এই জায়গার কোনো বদনাম শুনিনি। আমি নিজে এর আগেও অনেকবার এই জায়গা দিয়েই রাতবিরেতে ফিরেছি। কোনোরকম অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এইবারে হল।”

এত পর্যন্ত বলেই বৃদ্ধ আবার চুপ করলেন। মাথার কাছে ওনার মেজোবউ পাখার বাতাস করছিল। বৃদ্ধ থামতেই বাতাসের জোরটা আরও একটু যেন বেড়ে গেল। মাথার ঘামের বিন্দুগুলো আঁচলে খুঁট দিয়ে মুছতে মুছতে মেজোবউ “কী হল বাবা? গুপ্তধন পেলেন?”
বললে,

পাখার বাতাসে বৃদ্ধের চোখটা আরামে একটু বুজে আসছিল, কিন্তু এই প্রশ্নে তা আবার দ্বিগুণ বড়ো হয়ে গেল। মেজোবউ-এর দিকে একবার তাকিয়ে উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তা একরকম গুপ্তধনই বটে বউমা। বলছি সবটা। ওই ছোটো মতোন জঙ্গলে ছোটো-বড়ো অনেক গাছ-গাছাড়ি আছে।

তবে খানকয়েক বড়ো গাছও আছে বই কি। সেইরকম একটা বিরাট ঝাঁকরা ষাঁড়া গাছের নীচেই আমাদের গোরুর গাড়িটা হঠাৎ একটা গর্তে পড়ে এক বিকট শব্দে আটকে গেল। গাড়োয়ান যতই গোরুগুলোকে চাবুক মারে গোরুগুলো শুধু ডাকই ছাড়ে কিন্তু একচুলও নড়ে না। এদিকে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে আমি নামলাম এই ভেবে যদি ওজন কমে তাহলে হয়তো একটা সুরাহা হলেও নাকি ব্যাঙেও লাথি মারে। আমার ক্ষেত্রেও তাই-ই হল। আমি নামতেই গাড়োয়ান বললে, ‘অ দাবাবু! যা বুচিছি, এ গাড়ি পিছে থেকে না ঠেইললে আর এক পা-ও এগুবে-নি। তা আপনি যখন নামলেনই তাহলে একটু কোমর বেঁধে পিছে থেকে একখান ঠেলা দ্যান দেখি।’

“সাহসের বলিহারি। আমায় কিনা বলে গাড়ি ঠেলতে? একে চক্কোত্তি, তার ওপর আমি বিয়ে করে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরছি, তাকে কিনা এক মুখ্যু বলছে গাড়ি ঠেলতে? রাগে আমার গা রি রি করে জ্বললেও দেখলাম ক্রমে রাত বেড়েই চলেছে। এখানে ভূতের ভয় না থাকুক, চোর-ডাকাত তো আসতেই পারে। সঙ্গে আবার বিয়ে করা বউ রয়েছে। অগত্যা, আমিও দাঁতে দাঁত চেপে ঠেলা লাগালাম। তখন আমার জোয়ান বয়স। গায়ে তখন পাঁচ হাতির বল। আমার এই বল নিয়ে গর্ব ছিল সেসময়। সেই আমিও এক চুলও নড়াতে পারলুম না ভাবো। এদিকে তখন নতুন বউ-এর সামনে ঘামে ভিজে একেবারে গলদঘর্ম অবস্থা, তখন গাড়ির ভেতর থেকে বউ বলল, ‘আমিও ঠেলব নাকি আপনার সঙ্গে? তাহলে যদি উপায় হয়।”

“বোঝো কাণ্ড! চক্কোত্তি বাড়ির বউ নাকি গোরুরগাড়ি ঠেলবে! কিন্তু না ঠেললেই যে নয়। তাই হাজার রাগ হলেও আমি বললাম, ‘বলছ যখন তখন আমি আর না বলি কীভাবে। হাজার হোক তুমি আমার বিয়ে করা বউ।’ কিন্তু তখনই আসল সমস্যাটা হল।”
“কী হল দাদু?” জিজ্ঞেস করল ওনার দশ বছরের নাতি ভোমরা, “তখন কি ভূত এল ?”

নাতির এই প্রশ্নে বৃদ্ধ যেন কেঁপে উঠলেন একবার। কিন্তু সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বলতে লাগলেন, “এদিকে আমরা যখন ওই গাড়ি নিয়ে ফ্যাসাদে পড়েছি ঠিক তখনই ওই ষাঁড়া গাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল একটা পেতনি সদ্য বিবাহ হয়েছিল তার, কিন্তু কপালে সুখ আসার আগেই গোখরো সাপের এক ছোবলে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায় আর পেতনি হয়ে এই গাছের ওপরেই মনমরা হয়ে বসে ছিল গত দু-দিন যাবৎ।

এতটাই মন খারাপ ছিল যে এই দু-দিনে কাউকে ভয় পর্যন্ত দেখায়নি সে। কিন্তু যেই মুহূর্তে আমার বউ গোরুর গাড়ি থেকে নামে, ওই সময়ই আমার বউয়ের মাথাটা কীভাবে যেন সেই পেতনির পায়ের বুড়ো আঙুলে ঠোকা লেগে গেল। আর ঠোকা লাগা মাত্র সমস্ত রাগ এসে পড়ল আমার বউ-এর ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সেই পেতনি গাছ থেকে সোজা আমার বউয়ের ঘাড়ের ওপরে এসে চাপল।”

এতক্ষণ ধরে সকলে চুপ করে সেই বৃদ্ধের কথা শুনছিল ভীষণ মনোযোগ সহকারে। কিন্তু এই কথা শোনার পর সকলেই একসঙ্গে চিৎকার করে বলল, “সে কী? পেতনি? মানে ইয়ে মানে…”
ভোমরা তার দাদুর একটু কাছে এগিয়ে বলল, “দিদা কী তাহলে ভূত নাকি ?”
এই প্রশ্নেই দাদুর চোখ আর ঠোঁটদুটো একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু চোখদুটো আধবোজা হয়ে রইল। ওখানে উপস্থিত সেই হাতুড়ে ডাক্তার দাদুর নাড়ি টিপে একবার ঢোক গিলে বললেন, “উনি জ্ঞান হারিয়েছেন মনে হয়।”

এদিকে চক্কোত্তিবাড়ির সকলেই যখন ওই বৃদ্ধের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে ঠিক সেই সময় এই বাড়িরই উঠোনের পাশের বিরাট তেঁতুল গাছের মগডালে উঠে বসেছে বৃদ্ধের বিয়ে করা বউয়ের ঘাড়ে চেপে বসে থাকা সেই পেতনি। ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছের মগডালে বসে ওই বৃদ্ধের ঘরের দিকে একবার করে তাকাচ্ছে আর তা নিয়ে হুঁ হুঁ করে অনবরত কেঁদে চলেছে সেই পেতনি। হাজার হোক এত বছর সংসার করার পর একটা মায়া পড়ে গেছে। আর সবথেকে বড়ো কথা এই পেতনিও যে গঙ্গাধরকে ভালোবেসে ফেলেছে।

আসলে পেতনির দুঃখ পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বই কি। এই যে বৃদ্ধের আজ এই মরণাপন্ন অবস্থা তার জন্য পরোক্ষভাবে কিন্তু এই পেতনিই দায়ি। কেন? হ্যাঁ সেটাই তো এবারে বলছি আপনাদের।
সেই ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত সেই বউয়ের ঘাড়ে বসেই গঙ্গাধরের গোটা সংসার সামলে এসেছে এই পেতনি একেবারে ঘরের লক্ষ্মীর মতোন। কিন্তু হাজার হলেও সে হল গিয়ে পেতনি। তাই গঙ্গাধরের বয়স বাড়লেও তার বয়স ওই একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকত।

গঙ্গাধর প্রথম দিকে একটু সন্দেহ প্রকাশ করলেও পরের দিকে গঙ্গাধরের মনে কিন্তু খুব গর্ব হত। মনে ভাবত যে, কোন্ আশ্চর্য উপায়ে তার বউয়ের বয়সটা ওই একই সময়ে থমকে গেছে। তাতে গঙ্গাধরের তার বউ-এর প্রতি আদর এবং ভালোবাসা দুটো আরও বেড়ে উঠত প্রতিদিন। এত দূর অব্দি সব ঠিকই ছিল, কিন্তু হঠাৎ পেতনির মনে আবার যে কীসের ভূত চাপল কে জানে। এতদিন পর তার হঠাৎ মনে হল, এইবারে গঙ্গাধরকে সত্যি কথাটা বলে দেওয়াটা দরকার। বোধ করি পেতনির বিবেকের দংশন হয়েছিল। তো যা-ই হোক, গতকাল রাত্রে খাওয়ার পর গঙ্গাধর যখন বিছানায় শুয়ে ছিল, তখন প্রতি রাতের মতোই গঙ্গাধরের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ওনার গিন্নি বললেন, “শুনছো! তোমায় আজ একটা গোপন কথা বলতে চাই। বলব?”

“হ্যাঁ বলো না কী বলবে! এত বছর পরেও তোমার সঙ্গে আমার যে কোনো গোপন কথা থাকতে পারে এটা শুনেই কেমন যেন হচ্ছে মনের ভেতর।” ফোকলা দাঁতে মুচকি হেসে বলল গঙ্গাধর।
“সবসময় ঠাট্টা ভালো লাগে না বাপু। যা বলচি মন দিয়ে শোনো। তুমি যাকে আমি মনে করে সুখে আছো তা কিন্তু আমি নই গো।”
“যাহঃ। কী যে বলো না তুমি!”
“একেবারে সত্যি বলছি গো। এত বছর ধরে বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। আজকে বলেই ফেললুম।” গঙ্গাধর একটু ঢোঁক গিলে বলল, “কী বলচ বউ ? তুমি তবে কে শুনি?”

“আমি মানুষ নই গো! মনে আছে, সেই বিয়ের দিন রাত্রিবেলা ফেরার সময় তোমার গোরুর গাড়ির চাকাটা মাটিতে আটকে গেছিল। তুমি কত চেষ্টা করছিলে সেটাকে ঠেলে তোলার জন্য কিন্তু কিছুতেই পারছিলে না ! তারপর তোমার সদ্য বিয়ে করা বউ ভেতর থেকে নামল। আর তারপরেই…”
“তুমি…. তুমি এসব জানলে কীভাবে গিন্নি? আমি তো লোকলজ্জার ভয়ে এই কথা কাউকেই বলিনি! আমার বাবাকেই বলিনি।”
“আমি যে ওখানেই ছিলাম গো।”
“ওখানে আবার কোথায় ?”

“যেখানে তোমার গোরুর গাড়িটা রাস্তার গর্তে পড়ে আটকে গেছিল ঠিক তার পাশেই একটা ঝাকড়া ষাঁড়া গাছের মগডালে বসে আমি পা ঝুলিয়ে মনের দুঃখে কাঁদছিলাম গো।”
গঙ্গাধরের তখন গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে। তবুও শুকিয়ে যাওয়া গলায় তোতলাতে তোতলাতে গঙ্গাধর জিজ্ঞেস করল, “কে… কে…. কেন ? কাঁদছিলে কেন?”
“ওমা কাঁদবোনি। দু-দিন আগেই তো আমি সাপের কামড়ে মারা গেলুম। আমারও যে নতুন বে হয়েছিল, কিন্তু সুখের মুখ দেখার আগেই আমি মরে পেতনি হলুম।”

“তারপর?” গঙ্গাধর প্রশ্ন করে।
“তারপর আর কী। আমি তোমার বিয়ে করা বউ-এর ঘাড়ে চাপলাম। ভেবেছিলাম তোমার বউয়ের ঘাড়টা মটকে দিয়েই চলে যাব। কিন্তু তোমায় দেখে আমি আবার প্রেমে পড়লুম। তাইতো এত বছর তোমার সঙ্গে ঘর সংসার করলাম। আজকে এই কথাগুলো তোমাকে বলতে পেরে আমার মনটা এখন যে কী হালকা লাগছে।”
গঙ্গাধরের মনে এখনও ভীষণ খটকা রয়েছে। সে তাও একটু জোর গলাতেই বলল, “আমি বিশ্বাস করি না তোমার কথা। তুমি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছ। এই বুড়ো বয়সে আমায় ভয় দেখাচ্ছ কেন গিন্নি? ”
“বটে, বানিয়ে বলছি! আচ্ছা তুমি কেমন মানুষ গা?”
“না আমার তাও বিশ্বাস হয় নে।”

“হয় নে ! হয় নে। তবে এই এত্ত বছরে তোমার শ্বশুরবাড়ির কেউ এল না কেন! এই এত বছরে আমি কি একবারও আমার বাপের বাড়িতে আর পা দিয়েছি?”
গঙ্গাধর একটু লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বললে, “সে তো তুমি আমায় এত্ত ভালোবাসো তাই আর আমায় ছেড়ে থাকতে পারোনি। আমি কি আর তা বুঝি না গিন্নি ? ”

গঙ্গাধরকে বোঝাতে গিয়ে পেতনির একেবারে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে কিন্তু তা-ও যতটা সম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে বললে, “আরে সে তো আছেই, কিন্তু… আচ্ছা শোনো, আরও আছে। আচ্ছা তোমার মনে পড়ে, তোমাদের বাড়িতে একদিন রাতে ডাকাত পড়েছিল। কিন্তু বাড়িতে ডাকাত চুরি করার আগেই ওরা সকলে কী যেন দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল! মনে পড়ে সেই কথা ?”
গঙ্গাধর চোখ কুঁচকে সেদিনটার কথা ভেবে বলল, “সে তো বন্দুকের ভয়ে। আমাদের পরিবারের বন্দুকের কথা জানতে পেরেই বোধহয় পালিয়েছিল।”

“আরে ধুর! না গো না। সেইদিন আমি ওই রাতের অন্ধকারে নিজের আসল চেহারায় এইসা ভয় দেখিয়েছি যে ওরা আর কোনোদিন ডাকাতি করতে বেরোবে না। এছাড়া এমন আরও আছে। এই এতগুলো বছর তো আর এমনি এমনি কাটেনি আমার এখানে। তোমার এই যে বিরাট ব্যাবসা, তার জন্য খরচ-পত্র সব কোথা থেকে পেলে?”

গঙ্গাধর এবারে মিন মিন করে বলল, “আমার বাপ ঠাকুরদার সম্পত্তি ভেঙেই তো করলাম সব।”
“কী মিথ্যেবাদী গো তুমি! তোমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকের ভাঙা পাঁচিলের নীচে যে তিনটে মোহর ভরা কলশি পেলে

সেটা কি আগে ওখানে ছিল নাকি? ওটা আমিই ওখানে রেখে এসে তারপর তোমায় বলেছিলুম মনে নেই তোমার ?” গঙ্গাধর এতক্ষণে বিছানা থেকে উঠে বসেছে। একবার আড় চোখে পাশে বসে থাকা বউকে দেখছে আবার অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন বিড়বিড় করে বলছে। এবারে গঙ্গাধর বেশ জোরের সঙ্গেই ফোকলা দাঁতে বলল, “আমি তাও মানি না যে তুমি ভূত। ভূত কি এত বছর ধরে মানুষের সঙ্গে থাকতে পারে? নাকি ভূতের গলা একেবারে মানুষের মতোন হয়? আমি জানি, ওরা সব্বাই খোনা স্বরে কথা বলে, কারণ ওদের নাকটাই তো থাকে না। এইটা যে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। না না গিন্নি, তুমি আমার সঙ্গে মশকরা করছ। এ একেবারেই সম্ভব নয়। আমার দিব্যি খেয়ে বলো, যে তুমি এসব ইচ্ছে করে বলছ!”

এইবারে সেই পেতনি তার শেষ অস্ত্রটা প্রয়োগ করল। বলল, “একেই তো ভালোবাসা বলে গা। আমি যে ওই দিন থেকেই খুব ভালোবাসি তোমায়। তোমার সঙ্গে ঘর করার জন্য আমি সবটা কষ্ট হলেও অভ্যাস করেছি যাতে কেউ বুঝতে না পারে। আচ্ছা সে সব না হয় বাদই দিলাম। তাও তুমি এটা বলো তো, তোমার ওই ষাট বছর আগের বিয়ে করা বউ-এর চেহারা এখানো একইরকম থাকে কীভাবে? এও কি সম্ভব?”

এই কথায় গঙ্গাধরের বোধ করি একটু চৈতন্য হল । মনের মধ্যে এবারে এক অদ্ভুত দোলাচলে দুলছে গঙ্গাধর। একবার মনে হচ্ছে তার বউয়ের কথাই সত্যি, আবার মন বলছে, না গঙ্গাধরই ঠিক। তাও আবারও চোখদুটো বড়ো করে বউকে বলল, “তুমি এক নম্বরের মিথ্যাবাদী। নইলে এমন করে কেউ মশকরা করে? লজ্জা করে না তোমার? এতগুলো ছেলেপিলে নাতি-নাতনি মেয়ে-জামাই এসব শুনলে তো এবারে ছি ছি করবে। কী মিথ্যুক গো তুমি! কী মিথ্যুক!” এতক্ষণ ঠান্ডা মাথায় কথা শুনলেও গঙ্গাধরের এই শেষ কথায় পেতনির ভীষণ রাগ হল গঙ্গাধরের ওপরে। একে যেচে সমস্ত সত্যি কথা বলতে আসল সে, উলটে সেই তাকেই নাকি বলছে মিথ্যাবাদী?

এই জন্যই সকলে মিথ্যাটাই ভালোবাসে। ভীষণ রাগে গঙ্গাধরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই নাকি। আমি মিথ্যুক? আচ্ছা। দেখ তবে।” বলেই গঙ্গাধরের সামনেই ওই ষোড়শীর দেহ ছেড়ে একেবারে নিজের আসল রূপে যেই না এল অমনি বৃদ্ধ গঙ্গাধর ভয়াল ভয়ংকর কালো মিশমিশে পেতনির চেহারা মুখ, লাল ভাঁটার মতোন চোখ আর সাদা ধবধবে মুলোর মতোন দাঁত দেখে ভয়ে, আতঙ্কে তৎক্ষণাৎ মূর্ছা গেল। তারপরে যখন ওনার জ্ঞান হল তখন গঙ্গাধরের দুই চোখের নীচে কালি, সারা শরীর দুর্বল, হাত-পায়ে আর জোর নেই। ওই অবস্থাতেই উনি কোনোরকমে ওনার এক চাকরকে দিয়ে বাড়ির সবাইকে ডেকে পাঠালেন কী একটা জরুরি কথা সকলকে বলার জন্য।

********†**************

এদিকে ভোমরা যেই গঙ্গাধরকে ওনার বউ-এর কথা জিজ্ঞেস করেছে তখনই সেই পেতনির ভয়ংকর চেহারা ওনার চোখের সামনে আবারও ভেসে উঠল। একে বয়সের ভার তার ওপরে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কা আর ওনার দুর্বল হৃদয় নিতে পারেনি। প্রথমবারের অমন চেহারা দেখেই ওনার হৃদয় ভীষণ রকমের স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল, এখন আবার ভোমরার কথায় হৃদয়ের স্পন্দন একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গেল। গঙ্গাধরের জ্ঞান হারানোর মিনিট দশেকের মধ্যেই হাতুড়ে ডাক্তার ওনার হাত ছেড়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘ “উনি এইমাত্র অমৃতলোকে পাড়ি দিলেন।”

এইবারে বাড়ির সকল সদস্যদের মধ্যে এক ভীষণ কান্নার রোল উঠল। এখনকার দিনে লোকসংখ্যার অভাব না কি পাষাণ হৃদয়ের জন্য পাশের বাড়ির কেউ পরলোকগমন করলেও তা বোঝা দুষ্কর হয়ে ওঠে। কিন্তু আগেকার সময় তা একেবারেই অন্যরকম ছিল। পাড়ার কেউ মারা গেলে তার খবর কান্নার শব্দেই পরিষ্কার ঠাওর করা যেত। যা-ই হোক, গঙ্গাধরের মৃত্যুতে যেমন কষ্ট হওয়ার কথা, তার থেকেও বোধকরি তিনগুণ বেশি কষ্ট পেয়েছে বাড়ির সকলে। তার একমাত্র কারণ, মৃত্যুর আগে উনি গুপ্তধনের কোনো হদিশ না বলেই চলে গেলেন।

বাড়ির সবথেকে প্রবীণ চাকর রামদুলাল গঙ্গাধরের খাটের পাশের মেঝেতে কাটা পাঁঠার মতোন শুয়ে নানা রকমের প্রলাপ বকতে শুরু করল। যতদিন ধরে এখানে কাজ করেছে তার মধ্যে কত টাকা নিজের ট্যাঁকে গুঁজেছে, আরও কী কী অপরাধ করেছে এই সব কিছুর ফিরিস্তি দিতে লাগল। তারপর ওর শেষ হলে ওর দেখা দেখি পরেরজন ওই একই কাজ শুরু করল। কী অদ্ভুত! যে মানুষটা মারা গেছে তার সামনে এসব বলে কী যে লাভ হচ্ছে কে জানে।

এদিকে সময় বয়ে চলেছে। এর পর এই মৃতদেহ আর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। কিন্তু সেদিকে কারুর কোনো ইস নেই বরং সকলে মিলে কী যেন একটা বুদ্ধি আঁটছে একজোট হয়ে। দাদুর ছোটোছেলে নন্দলাল জন্মের পর থেকেই ভীষণভাবে মা ভক্ত। তাই ওনার বাবার শরীর খারাপ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু তবুও ওই ঘরে সে উপস্থিত ছিল। এবারে তার বাবা মারা যেতেই ভয়ংকরভাবে কান্না জুড়ে সে বলল, “মা কই গেল আমার? এখানে কারুর কোনো আক্কেল নেই দেখছি।” তারপর রামদুলালকে জোর গলায় বললে, “মাকে এখুনি নিয়ে আয় তো এই ঘরে।”

ওকে বললেও যেন ঠিক শান্তি পেল না মনে। তাই রাম দুলালের পেছনে নন্দলালও ছুট লাগাল মায়ের ঘরের দিকে।

হাজারবার ডাকার পরেও যখন দিদার ঘরের দরজা খুলল না ততক্ষণে বাড়ির সকলে যারা দাদুর ঘরে ছিল এতক্ষণ তারা সকলেই দরজার বাইরে এসে ভিড় করেছে। এবারে সেই ভিড়ের অনেকটা পেছন থেকে বড়োজেঠু গলা উঁচু করে বলল, “গতিক ভালো ঠেকছে না হে। এবারে দরজাটা ভেঙে ফেলা দরকার যে! এই দুলাল … বলতেই রামদুলাল আরও তিন চারজন মিলে একসঙ্গে ধাক্কা দিতেই ‘দড়াম’ করে দরজা ভাঙার আওয়াজ উঠল।

সব্বাই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেই দেখলে, পরিপাটি করে সাজানো সাদা ধবধবে বিছানার ওপরে দিদা পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু এই ঘুম চিরশান্তির। ইহলকের আর কারও এই ঘুম ভাঙানোর ক্ষমতা নেই। কিন্তু একী! বিছানায় যিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন তার মুখাবয়ব দিদার মতোন হলেও এতদিন যে রূপে সকলেই দিদাকে দেখে এসেছে তার থেকে ভীষণ রকমের আলাদা লাগছে।

মাথার চুলগুলো একেবারে চুন সাদা হয়ে গেছে, হাতের, মুখের আর কপালের চামড়াগুলো বয়সের ভারে যেরকম কুঁচকে যায় ঠিক তেমন কুঁচকে রয়েছে, যেন এক পলকেই দিদার বয়স এক ধাক্কায় ষাট বছর বেড়ে গেছে। দিদার এই চেহারা দেখে ওখানে উপস্থিত সকলেই ভুলে গেল যে ওদের কাঁদা উচিত, না ভয় পাওয়া উচিত। তাও নন্দলাল আবেগের বশে একবার, “ও মা গোওও” বলেও চুপ করে গেল।

বাড়ির সকলের বোধহয় একটা শেষ আশা ছিল যে, গঙ্গাধরের থেকে গুপ্তধনের সন্ধান না পাওয়া গেলেও হয়তো ওনার বউ-এর থেকে পাওয়া যাবে। তা এখন সে গুড়ে বালি হওয়ায় সকলের মধ্যে কেমন যেন একটা গা-ছাড়া ভাব দেখা দিয়েছে এতক্ষণে।

এদিকে বাড়ির উঠোনের তেঁতুল গাছে বসে পেতনি বাড়ির ভেতরের সমস্তটা লক্ষ্য করেছিল খুব মন দিয়ে। কিন্তু যখন গঙ্গাধর এর শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল তখন আর সে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। বারংবার নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে অঝোরে কাঁদতে শুরু করল। যদিও বাড়ির সবার বিলাপের শব্দের সঙ্গে এই শব্দ মিলে যাওয়ায় কেউ তেমন বুঝতে পারেনি।

পঞ্চকন্যা pdf – নবনীতা দেবসেন Panchakanna pdf – Nabanita Debsen

বাড়ির উঠোনে দু-জনের দেহ একসঙ্গে রাখা হয়েছে। তাতে ফুল-মালা দেওয়া হয়েছে। মাথার আর পায়ের দিকে গন্ধ-ধূপ ধরানো হয়েছে। ঢাকা দেওয়া সাদা চাদরের ওপরে দামি সুগন্ধী আতরের শিশি একবারে উপুড় করে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির সমস্ত চাকর-বাকররা একটু দূরে মাটিতে বসে তখনও অনবরত কেঁদে চলেছে কিন্তু কান্নার দমকটা যেন আগের থেকে কিছুটা কম। বাড়ির সকল সদস্যদের মুখ গোমড়া। তার কারণ বোধকরি গুপ্তধন হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।

বাড়ির যখন এই পরিস্থিতি ঠিক তখনই আমরা এই বাড়িতে এসে ঢুকলাম। আমরা বলতে, মানে ইয়ে, প্রথমে বলছিলাম না, যে আমি না জেনেই কলকাতা থেকে রওনা হয়েছিলাম, তার কারণ আমি বিয়ে করেছি। বউকে নিয়ে আমি কাউকে কিছু না জানিয়েই এসেছি। জানালে হাঙ্গামা একটু বেশি হয় বইকি।
যা-ই হোক, বাড়িতে পা দিয়েই দেখি বাড়ির উঠোনে দুটো খাটিয়ায় দুটো মৃতদেহ, গলায় আর পায়ে ফুলের মালা দিয়ে সাজানো। খাটিয়ার দু-পাশ থেকে গন্ধ-ধূপ জ্বলছে। স্বপ্ৰশ্ন দৃষ্টিতে ওই ভিড়ের মধ্যে বাবাকে খুঁজে ওনার সামনে এসে বললাম, “বাবা! কী হয়েছে? এরা কারা? ”
বাবা প্রথমে একটু চমকে উঠল, তারপর আমায় বুকে জড়িয়ে বললে, “ওরে তুই এসেছিস বাবা! দেখ দেখ তোর দাদু-দিদা যে চলে গেল আমাদের ছেড়ে দাঁড়া তোর মাকে ডাকি। ওগো শুনছ… দেখ তোমার ছেলে এসেছে…”

বাবা-মায়ের আর বাড়ির প্রায় সকলের খাতির-যত্নের ফাঁকে ফাঁকে আমি শুনছিলাম এই দাদুর বলে যাওয়া সব টুকরো টুকরো ঘটনা যেগুলো, একসঙ্গে এতক্ষণ ধরে বললাম আপনাদের। এর মধ্যে আমিও বলে দিয়েছি যে আমি বিয়ে করেছি আর বউকেও সঙ্গে এনেছি। দেখলাম বাবা মা বটেই, বাড়ির কেউই তেমন আপত্তি করল না।
বউকে দেখে শুধু আমার মা একবার বলেছিল, “মা এভাবে চুল খোলা রেখো না। এইসময় অনেক বাজে হাওয়া লাগতে পারে।” যদিও বউ আমার খাস কলকাতার। এইসব মানে না।

যাই হোক, সকলের খাতির-যত্নের আধিক্যে আমি বুঝতেও পারিনি আরও একজন সবার অলক্ষ্যে আমায় নজর করে চলেছে। সে আর কেউ না। সে হল এই বাড়ির উঠোনের একপাশের বিরাট তেঁতুল গাছের ডালে বসে থাকা সেই পেতনি। বৃদ্ধ গঙ্গাধর মারা যাওয়ার পরে যে ওই ডালে বসেই দুঃখে মাথা খুঁড়ে মরছিল সেই পেতনি আমায় দেখে যেন নড়ে চড়ে বসে সেই প্রথম থেকে আমায় লক্ষ করে চলেছে আর মাঝে মাঝেই মুলোর মতোন দাঁত বের করে আর লম্বা বাঁশের মতোন দু-হাত জড়ো করে নিজের কপালে কার উদ্দেশে প্রণাম করছে। কারণটা পরে বুঝেছিলাম দাদুর একটা অল্প বয়সের ছবি দেখে। এখন আমায় যেমনটা দেখতে, ওই অল্পবয়সি দাদুকেও ঠিক অমনি দেখতে। চেহারা, উচ্চতা এমনকি গায়ের রং পর্যন্ত হুবহু এক। দাদুর সেই ছবি দেখে আমিও কম অবাক হইনি।

দাদু-দিদার দেহ দাহ করার পর সেই রাতে আমরা বাড়ির সকলেই ওই উঠোনে মাদুর পেতে বসে গপ্পো করছি, তখন আরও একটা ঘটনা ঘটল। আমার বউ কলকাতার আধুনিকতাতেই বড়ো হয়েছে। তাই গ্রাম্য রীতিনীতি সম্পর্কে একেবারেই ওয়াকিবহাল নয়। তা ছাড়া শ্বশুরমশাইয়ের থেকে শুনেছিলাম ছোটো থেকেই ভীষণ ডানপিটে স্বভাবের। শরীরে ভয় নামক বস্তুটা একেবারেই নেই।

এই বাড়িতে আসার পর আমার মা একবার বলেছিল, বউমা চুল খুলে রেখো না। কিন্তু সে কথা শোনেনি। যথারীতি খোলা চুলেই সে মাদুরে বসে গল্পো শুনছিল।

হঠাৎই এক অদ্ভুত ধুলোর ঝড় উঠল। এই একটু আগে পর্যন্ত জ্যোৎস্নার ফুটফুটে আলোয় চারদিক ঝলমল করছিল আর পলক ফেলতেই বাড়ির সমস্ত গাছগুলোকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে ঝড় উঠল। আমরা সকলে তড়িঘড়ি করে ভেতর বাড়ির দিকে উঠছি, এমন সময় আমার বউ বলে উঠল, “ওই গাছটার নীচে মাথায় ঘোমটা দেওয়া ও কে গো?” কিন্তু আমাদের কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই যেন কীসের টানে সে ওই তেঁতুল গাছের দিকে দৌড় দিল।

আমরা সকলে যখন বাড়ির উঠানে পৌঁছানো মাত্র আচমকা যেমন ঝড়টা উঠেছিল, ঠিক তেমনি আবার আচমকা থেমেও গেল। সাধারণত গ্রামে এভাবে ঝড় খুবই কম ওঠে বা ওঠে না বললেই চলে। আকস্মিক ঝড়টায় আমরা সবাই একটু চমকে গেছিলাম বই কি। আমরা যখন এই ঝড় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি ঠিক তখনই ওই তেঁতুল গাছের নীচের থেকে একটা চিৎকার শুনে আমার বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠল, কারণ ওই গলার স্বরটা আমি ভালোমতোই চিনি।

আমরা সকলেই প্রায় দৌড়ে যখন তেঁতুল গাছের কাছে পৌঁছালাম, দেখলাম আমার বউ ওই গাছের নীচেই অচৈতন্য হয়ে শুয়ে আছে।

*********************

প্রায় দু-বছর পরের বৈশাখ মাসের এক দুপুর। গ্রামের মাঝে একটা চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। হাসপাতালের গেটের একপাশে কালো মার্বেলে সাদা পাথর দিয়ে খোদাই করা আছে একটা নাম, “যশোদা আরোগ্য নিকেতন”। এই গ্রামের, শুধু এই গ্রামের নয় আশেপাশের যে ক-টা গ্রাম রয়েছে সেই সব গ্রামের মানুষদের এখানে একেবারেই স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার এখানকার ডাক্তার অর্থাৎ আমি সেই চিকিৎসার ভার গ্রহণ করেছি।

যদিও এইসব করার কোনো পরিকল্পনাই আমি কলকাতা থেকে নিয়ে আসিনি, তবুও ওই সেই রাতের আকস্মিক ঝড় ওঠার পর থেকেই আমাদের জীবন, বিশেষ করে আমার, এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। তবে এখানে বলে রাখি, এই হাসপাতাল নির্মাণ বা তার পরিকল্পনা বা খরচপাতি কোনোটাই কিন্তু আমার নয়। সবটাই আমার সহধর্মিনীর। এই বিরাট স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালানোর জন্য যে বিপুল খরচ হয়েছে তার সবটাই কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে জোগাড় করেছে আমার বউ। কিন্তু কী উপায়ে সম্ভব হয়েছে তা আমার কাছে এখনও অজানা। আর এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নাম যে কেন আমার দিদার নামে তা-ও আমার কাছে বড়োই অদ্ভুত বিষয়। তবে আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি বোধহয়।

একদিন সকালে আমি কী একটা দরকারে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ডাকার জন্য একটু কাছে যেতেই মনে হল ভেতর থেকে কারা যেন কথা বলছে তার মধ্যে একটা কন্ঠস্বর আমার বউয়ের কিন্তু অন্যটি একেবারেই অচেনা। মনে হল সেই গলার স্বর একটু খোনা আর নাকে কথা বলছে।

নাকি স্বরের মহিলাটি যেন ভীষণ রেগে রয়েছে। সেইভাবেই বলছে, “বাপরে বাপ। কী দস্যি মেয়ে রে বাবা! এমনটা আগে বুঝলে….”

আমার বউ, “আগে বুঝলে কী করতে শুনি?”

“কী আবার। আমি ভেতরেই আসতাম না কোনোদিন।

ভেবেছিলাম ভগবান আমার ওপর আবার মুখ তুলে চেয়েছে। কিন্তু হায় হায় হায় হায়…”

আমার বউ হেসে বলল, “যেমন কর্ম করেছ, তেমন ফল তো পাবেই। তুমি আমায় কব্জা করতে এসেছিলে। এবার বোঝো কেমন লাগে।”

নাকি স্বর, “ওরে হতভাগি। আমার এতদিনের লুকিয়ে রাখা সোনার মোহরগুলো সব এভাবে বিলিয়ে দিলি কেন। এগুলো যে এই পরিবারের সম্পদ।”

“যা করেছি বেশ করেছি। এই টাকা আগলে রাখার থেকে যাতে এই টাকায় পাঁচজন ভালো থাকে সেটাই ভালো।” “তা বলে আমার আনা টাকা দিবি? কী দস্যি কী দস্যি!” “হ্যাঁ দেব তো। আরও যা যা আছে সব দেব। আর তুমি কিছু করতেও পারবে না।”

“বটে। আমি আবার বেরিয়ে যাব তোর ভেতর থেকে। তারপর দেখ কী করি তোর।”

“তাও যে হবে না। আমি এখানকার নাম করা গুণিনের থেকে এই তাবিজ নিয়ে এসেছি যাতে তুমি ইচ্ছে মতোন বেরিয়ে যেতে না পারো। কিন্তু সেটা কোথায় রেখেছি তা তোমায় বলব না।”

“বজ্জাত মেয়ে। হায় হায়.. আমার কী হবে এখন। আমায় ছেড়ে দে সোনা লক্ষ্মী মেয়ে।”

“একদম নয়। এতদিন তুমি এই সংসারে ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছ নিজের ইচ্ছে মতো, এবার তা আমি করাবো তোমাকে দিয়ে। বলে সে খিল খিল করে হাসতে লাগল।”

শেষে নাকি স্বর বলল, “হতভাগী, প্রথমে তোর বরকে দেখে ভেবেছিলুম আমার স্বামী ফিরে এসেছে আবার। কিন্তু এই দু-বছরে আমার ভুল ভেঙেছে। হাজার হোক, এর বাবা যে আমারই ছেলে। এ যে আমারই নাতি। আর তুই আমার নাত বউ। আমি এমনিই চলে যাব রে। তোদের কোন ক্ষতি আর করবনি। লক্ষ্মী মা আমার, এইবারে আমায় ছেড়ে দে….”

আমি কিছুই তেমন বুঝতে না পারলেও একটা খটকা ছিল আমার মনে। সেদিন দরজা খুলে তেমন কাউকেই দেখেনি। পরে একদিন সময় করে আমার বউকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওই দিনের শোনা ঘটনাটা। তারপরে বউ আমাকে সবটা খুলে বলেছে। কী বলেছে? উছ। তা আমি বলব না। বলার আগে দিব্যি করিয়েছে যে, আমি কাউকে না বলি। আপনারাই বরং বুদ্ধি করে ভেবে বের করুন।

সমাপ্ত

Read bangla books pdf

Be the first to comment

Leave a Reply