কাক-জ্যোৎস্না by বাণী বসু Kak Jyotsna By Bani Basu

কাক-জ্যোৎস্না by বাণী বসু Kak Jyotsna By Bani Basu
কাক-জ্যোৎস্না by বাণী বসু Kak Jyotsna By Bani Basu

বাণী বসুর Kak Jyotsna কাক-জ্যোৎস্না পড়ুন এখান থেকে।

কাক-জ্যোৎস্না by বাণী বসু Kak Jyotsna By Bani Basu
কাক-জ্যোৎস্না by বাণী বসু Kak Jyotsna By Bani Basu

Kak Jyotsna কাক-জ্যোৎস্না পড়ুন

এই পাখিটিকে বোধহয় কেউ পছন্দ করে না। কেউ না। পাখি বলে মনেই হয় না এটাকে। জমাদার পাখি তো জমাদারই। জঞ্জাল সাফ করতেই পয়দা হয়েছে। পাখি কখনও নয়। ‘পাখি’ শব্দটার মধ্যে কেমন পাখি পাখি ভাব আছে না একটা? আহা আহা করে মন! আয়রে পাখি ন্যাজঝোলা, / খেতে দেবো ঝাল ছোলা, খাবি দাকি কলকলাবি / খোকনকে নিয়ে বেড়াতে যাবি!
আদর করে প্রতিশ্রুতির বোল বানাও, যেন শিশুও যে, পাখিও সে। শিশুতে পাখিতে, শিশুর আদরে পাখির আদরে এক হয়ে যায়।

পাখি আচমকা উড়ে যায়? ডানার তলায় লুকোনো রঙের সওগাত দিয়ে যায়। যদি কাছের ডালে এসে বসে? ডাল দুলবে আবেশে, আয়েসে, ছন্দে, আনন্দে। মাছরাঙা-টাঙার মতো শাঁ-আঁ-আঁৎ করে যদি এক লপ্তে ঝাঁপ দিয়ে চলে যায় এতটা ? তবে রোদ্দুরে নীলা, রোদ্দুরে চুনি, রোদ্দুরে পান্না। তাতা থই থই / তাতা থই থই, তাতা……
পাখি, আহা পাখি রে!
আয় বেনেবউ, বসন্ত বৌরি…. ময়ূর ময়ূর… পান কৌড়ি !
মরি মরি!

রূপের বাহার যার নেই তার দ্যাখো নামের বাহার! ভঙ্গির বাহার!
টপাস টপাস করে ডিগবাজি খাচ্ছে ডাহুক জলের ওপর? ব্যাপারটা হল শিকার ধরা। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। কিন্তু কেমন একটা আস্ত ছেলে ভুলোনো কমেডি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কিংবা ছড়া। ছড়ার ছন্দ।
টিপাস টপাস গপাক গপাক।
আর ঘুঘু? কী অসামান্য ওর ধূসর কোমলিমা! ওর মৃদু ময়ূরকণ্ঠী কণ্ঠ, পেলব রেখায় আঁকা সুগোল মুণ্ড, ওর টলটলে ফোঁটা-চোখ!

পঞ্চকন্যা pdf – নবনীতা দেবসেন Panchakanna pdf – Nabanita Debsen

ডাকটা! ডাকটা! ঘুঘুর ডাক!
তুমি বসে আছো। তোমার ভেতরে ভালো খবর, পানাহারে বেশ তৃপ্ত তুমি, আপনজন পাশে বসে রয়েছে। মুহূর্তে সব লুপ্ত হয়ে যাবে গোধূলি সন্ধির আবছায়ায়। না না, সে নেই। কোনও দিনও ছিল না। স্বপ্নে ছিল হয়তো। তার বেশি কোথাও নয়। পাওয়া তোমার হয়নি নটরাজ। কোন সুদূর, অনাগত আগামীর দিনে-রাতে পাওয়া তোমার অনাসন্ন হয়ে এলিয়ে আছে।
কঃ! খবঃ!
জানলার পাটের ওপর ছরকুটে পায়ে দাঁড়িয়ে, চোখ টেরিয়ে, ঘাড় বেঁকিয়ে ডাকছে কাকটা।
ওরে কাক, এখানে তো কাঁটা-পোঁটা-তেল পটকা ওই সব কুৎসিত আমিষগুলো থাকে না, থাকে না। এখানে বই, এখানে খাতা, এখানে কলম। এসব তুমি বুঝবে না বাপা!

ওহ্, তাই বল্। চুরির তালে? এই স্নিগ্ধ স্লিম নীল জটারটার দিকে চোখ পড়েছে তাহলে? না ওই তন্বী শুভ্রা পেপার কাটার? কোনটা তোর নোংরা বাসায় নিয়ে যেতে চাস?
হুশ, হুশ, হু-উশ্!
বেশ একটা আমেজ এসেছিল, চলে গেল ঝপ করে। ফিউজ। নটরাজ ফিউজ । নটরাজ সিন্হা বেকার। তিন বছর হল। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ? হয়েছে, হয়েছে, কার্ড হয়েছে। সি.এস.সি? আবেদন গেছে। খবর নেই। কোনও খবর নেই। দৈনিক কাগজ দেখে বিজ্ঞাপনের জবাব? প্রচুর, প্রচুর। পোস্ট আপিসের ফলাও কারবারটা নটরাজ সিন্হার জন্যেই চলছে। সর্ববৃহৎ কাস্টমার, পোস্ট আপিসের।

আত্মীয়-প্রতিবেশীদের মাথায় স্বভাবতই ঝুড়ি। ছোট্ট বড়। রাস্তায় ঘাটে, বাসে ট্রামে দেখা হলেই হন্তদন্ত হয়ে ঝুড়ি নামিয়ে দিচ্ছে। উপদেশের ঝুড়ি।
যাবে!
—আরে কম্প্যুটার শেখ, কম্প্যুটার শেখ। কিছু না হোক হাতখরচটা উঠে
—কেটারিং। এখন কেটারিং টেকনলজির যুগ। একটু মন দিয়ে লেগে থাক লাগে তাক না লাগে তুক!
– তোর তো বেশ লেখার হাত ছিল নট। একটা ছোটখাটো কাগজ দিয়ে কেরিয়ার আরম্ভ করতে পারতিস ! ছুঁচ হয়ে ঢুকতিস আর ফাল হয়ে বেরোতি! বুঝলি তো?

উচ্চস্তরের গাম্ভীর্য বিকীর্ণ করতে করতে ওই চলে যাচ্ছে শৌভিক। সদ্য সদ্য চাকরি পেয়েছে। আফটার শেভের গন্ধ ভুরভুর করছে। নটরাজের থেকে দু বছরের জুনিয়র। বাপী! রথতলার বাপী! ইয়ুথ ক্লাবে সবচেয়ে বেশিক্ষণ থাকত, ফাই- ফরমাশ খাটত। আজকাল আসে না, খাটে না, চলার ছাঁদ বদলে গেছে। ও-ও পেয়ে গেছে। এমন কি রেমির বোন রিয়া, সে সর্বক্ষণ ফেউয়ের মতো পেছনে লেগে থাকত? সে-ও হাত উল্টে কব্জি ঘড়ি দেখে বলছে – “ওহ্, সময় নেই নটদা, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলি…..।’

ইতিমধ্যে বাড়ির অভিভাবক দাদা বলছে কঃ, খবঃ। অফিসে বেরোতে বলছে অফিস থেকে ফিরে বলছে, চান করে মাথা মুছতে মুছতে, খেয়ে দেয়ে আঁচাতে আঁচাতে, ঘুম পেলে হাই তুলতে তুলতে, চোখ টেরিয়ে, ঘাড় বেঁকিয়ে, ছরকুটে হয়ে দাঁড়িয়ে, গলার ভেতর থেকে অচেনাতর, অচেনাতম গমক বার করে বলছে ক্কঃ বলছে খবঃ। অর্থাৎ খুব খুব খারাপ। আর দাদার শ্রীমতী বউদি? বউদি মুখ ফুটে কিছু বলছে না অবশ্য। ভাতের পাশে ডাল, ডালের পাশে থোড়, থোড়ের পাশে বড়ি, বড়ির পাশে খাড়া – অক্লান্ত নিয়মানুগত্যে সাজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে দুবেলা। থালার পাশে এক চিমটি ছাই। দেখতে পাচ্ছে নটরাজ। তৃতীয় চঞ্চু দিয়ে। দূর দূর ছেই ছেই, শুনতে পাচ্ছে তৃতীয় কর্ণ দিয়ে। চা-পাউরুটি টোস্ট নিয়ে সকালে সাত তাড়াতাড়ি দরজার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে বউদি রোজ। কিছু বলছে না।

চুপচাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে সড়সড় করে চলে যাচ্ছে তেঁতুলে বিছে। বলছে না কিছু। কিন্তু তার হয়ে জানলার পাটে বসে থাকা ওই কাক না কাকিনী, শকুনি না গৃধিনীটা বলে দিচ্ছে।
খ্যা খ্যা খ্যা খ্যা।
সন্ধে। আলো জ্বলে। ওপরেও আলো। নীচেও আলো। জড় আলো, যার ব্যবস্থা মাইকেল ফ্যারাডে করেছিলেন। আর চেতন আলো, যার ব্যবস্থা করেছে বা করেছেন অজ্ঞেয় ঈশ্বর স্বয়ং। বাচ্চাদের মিস। আলো যাচ্ছে ঘরের বাইরের সরু বারান্দা দিয়ে, শুক-সারীকে পড়াতে। দাদার ছেলে-মেয়ে। আলো যাচ্ছে, পরদা তুমি উড়ে যাও, কপাট তুমি খুলে যাও, চশমার লেনস তুমি টেলিস্কোপের লেনস হয়ে যাও। হলুদ ডুরে শাড়ি ঝলকে গেল, চমকে গেল। ক্ষুরধার বারান্দা-পথে বিজুরি আখর।

গেছে, গেছে। পরদা উড়ে দরজার মাথায় লটকে গেছে। খোলা কপাট। চৌকাঠে আলো। চোখে সোনালি ফ্রেম। পরো না আলো, ও ফ্রেম পরো না। নাকের দু পাশে ডোব-ডোব গর্ত হয়ে যাবে। শেল পরো আলো, সাধারণ শেল।
-এ কি? এমন করে চুপচাপ বসে আছেন কেন ?
-পা নেই।
-পা নেই? কী হল ? মচকেছেন?

উদ্বেগ, স্নেহ, শঙ্কা। বাঃ! এভাবেই হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে শামুক এগিয়ে যায় । হেসে ফেলেছে। —ওহ্, পা মানে দাঁড়ানোর পা, পারেনও বটে, সে তো হবে! শিগগিরই হয়ে যাবে।
–বলছেন?
-বলব না কেন? সবারই তো হয়!
লাখে লাখে শিক্ষিত বেকার। সবারই তো হয়, বললেই হল! —হয়ে যায় দেখি তো! অন্তত যাদের হয়, তাদের দলে আপনি –বাঃ। প্রফেসি? না উইশফুল থিংকিং?
—দুই-ই।
—ধন্যবাদ। সুক্রিয়া। আজকাল হিন্দিটা বেশি চলছে।

চলে যাচ্ছে আলো। আবার সব ফিউজ করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। বউদির ঘরে শুক-সারীর পড়ার টেবিলে আলো জ্বালতে চলে যাচ্ছে।
আধা–ফরসা রঙটা। ভালো খেতে টেতে পেলে, দু চার টিউব ক্রিম-টিম মাখতে ফাখতে পেলে এই রঙেই মার্বেলের গ্লেজ দেবে। অতএব ক্রিম মাখে আলো। খেতে পায়। জামতাড়ার বাংলোর হাতায় দুটো বেতের চেয়ারে দুজনে বসে থাকে। নীল-গোলাপি ম্যাকসির লেসের পাড় আলোর মার্বেল পায়ের পাতা ছুঁয়ে চুপটি করে শুয়ে আছে। বেয়ারা ফ্রায়েড চিকেন আর চিকিত চিকিত করে কাটা আনারসের চাকতি রেখে গেল। কোথায় যেন এই কম্বিনেশনটার কথা শোনা গেছিল! পালিশ করা আঙুলে একটাই লাল-কমলা পাথর। কী ওটা? কী আর! পাথর নয়, প্রবাল। সমুদ্রের তলায় থাকে। মাঝে মাঝে উঠে আসে আলোরা সাজবে বলে।

ফিগার আঁকড়ে ধরে থাকে, কী যেন বলে ওই শাড়িকে ? ধনেখালির মোড়ক ছাড়িয়ে সেই যে কী যেন বলে শাড়ি স্বপ্নরঙিন, নেশায় মেশা সে উন্মত্ততা আলোর অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে দিচ্ছে নটরাজ। বেগুনি না গোলাপি কি বলে এই রঙদের? এরা কোনও চেনা-জানা নামের খাঁচায় ধরা পড়তে চায় না। বনের পাখি, এসব রঙ, এসব শাড়ি, বলে—খাঁচায় ধরা নাহি দিব। বলে – কেবলি বনগান গাব। তাই মোটা কালো বিনোদ বেণী ঢেউ খেলিয়ে খেলিয়ে এলিয়ে যাচ্ছে। কাঁধ পিঠ সমস্ত ঢেকে চেয়ারের আশে পাশে পেছনে সামনে লুটিয়ে যাচ্ছে রাজকন্যের মেঘবরণ কেশ। ঝড়ের দোলা লাগল মেয়ের আলুথালু বেশ গো, আলুথালু….।

ছুটছে আলো, ছুটছে। ঝড়ই তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। দুরন্ত বাসনার ঝড়। কার বাসনা? কার আর? নটরাজের।
আলোর মুখের কাট গ্রীসিয়ান। স্লিম, মডেলমার্কা আজকালকার রমণী নয়। চিরকালের। দীর্ঘ, কিন্তু অতি-দীর্ঘ নয়। সুডৌল। চোখের তারা দুটো সামান্য ওপর

দিকে দাঁড়াও আলো! হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। এথিনা, গ্রীক দেবী এথিনা।
এথিনা রান্নাঘরের ফোড়নগন্ধী ইঁদুরে অন্ধকারে পিঁড়ি পেতে বসে ডেঙ্গর ডাঁটা চিবোচ্ছে। ভাবা যায়? লুঙ্গি, গামছা, দাঁত মাজনের লাল পাউডার, পোড়া কড়া, পোড়া চাটু, ডাল-ঝোল তেল ব্যাড়বেড়ে হাতা-চামচ, টিনের দরজা, ধরা জল খরচের কিপটে আওয়াজ, ধপাস ধপ ধপাস ধপ, কাঁথাকানি কাচিতং, ধরে গেল, হাফ লিটার সবে ধন মাদার ডেয়ারি ধরে গেল। ধর ধর ছোট খোকাটাকে ধর, যাঃ মুখে পুরে দিল। জ্যান্ত আরশুলাটাকে মুখের ভেতর…. ম্যাগো ! খোল। খোল মুখ! ভ্যা-অ্যাঁ-অ্যাঁ। ভাবা যায়?

এথিনা, তোমাকে আমি নিয়ে যাব তোমার স্ববেদীতে। আক্রোপলিস। বেশি নয়, একটি ভক্ত একান্ত থাকবে তোমার। তুমি শুধু বীরাঙ্গনা মুদ্রায় দাঁড়িয়ে প্রেমকরুণ শুভদৃষ্টিটা তার দিকে পাঠিও। আরও থাকবে ভক্ত। মনুষ্য ও দেবগণ। কিন্তু তারা বাহ্য। তারা তোমার ভঙ্গি দেখতে পাবে। অঙ্গ দেখতে পাবে না। দেখতে পাবে ঘুরে ঘুরে চূড়াকার কেশের বাহার, দেখতে পাবে না চোখের নিভৃত নজর কিংবা তুমি ওড়ো, আলো ওড়ো। তোমায় আমি ওড়ার পোশাক পরিয়ে দিলুম। বেশি দূর উড়ান দিতে হবে না, ময়ূর আমার। বেলে পাথরের স্থাপত্যের পটভূমিটা খুঁজে পেতে যা দেরি। তারপর পেখম মেলে দাঁড়াও। ঝর ঝর ঝর ঝর আওয়াজ তুলে নাচো, ময়ূর নাচো। বাঁচো।

—আপনি এখনও ওইভাবেই বসে? পা খুঁজে পাননি?
–ধ্যান করছি।
-বাঃ ধ্যান খুব ভালো জিনিস। কিন্তু ট্যুইশানি আরও ভালো। হাতে আছে কটা। ভালো টাকা দেবে। করবেন?
-তো আপনি করছেন না কেন ?
—আমি স্পেশালাইজ করেছি বাচ্চাদের লাইনে।
–তা এরা কি বাচ্চার বাপ?
——উঃ, পারেনও। বাপ না হোক, দাদা-দিদি। বি.এ, হনস, এম.এ., আপনার তো প্রচুর নোটস আছে!
-সে সব নোটস আমি একজন ছাড়া কাউকে দেবো না।
–দিতে যাবেন কেন? ব্যবহার করবেন।
– সেই একজন যে কে জিজ্ঞেস করলেন না তো!
—জানি। আমার পরীক্ষার পড়া করার সময় নেই। সকালে তিনটে, সন্ধেয় দুটো রোজ। জোড়া জোড়া বাচ্চা সব। কখন পড়ি বলুন?

হুম্। পাখি উড়ে গেল।
কিন্তু, কী বারতা রেখে গেল ও? বি.এ. অনার্স, এম.এ., ছাত্র-ছাত্রী? ভালো টাকা? সত্যিই তো? প্রচুর ভালো নোটস আছে। রয়ে গেছে। চাকরি যখন হচ্ছে না, উপার্জন করতে দোষ কী? এটা কেন এতদিন মাথায় আসেনি?
অতঃপর নটরাজ দিনের পাখি। রাতের পাখি। পুরাতন সাইকেলটা কাজে লাগছে, কাঁহা কাঁহা মুলুকে চলে যাচ্ছে নটরাজ। মাস গেলে পকেটে করকরে কাঁচা নোট। মাস গেলে বউদির হাতে সেভেন হানড্রেড থোক।
দাদা মুখ ধুচ্ছে। —খি?

বিশেষ কিছু নয় দাদা, টিউশানি।
বউদি বলল তা হোক। লক্ষ্মীর আবার জাত কী? মা সদাই মা।
আপন খাঁচায় ফিরে এসে এবার নটরাজের খি-খি করার পালা। হাতের নোটগুলো সাজায় আর হাসে, -মা? অ্যা? তোরা শেষ পর্যন্ত মা বনে গেলি? যা ব্বাবা।

ক্রমশ দশ হাজারি হয়ে তবে দম নেয় নটরাজ। সেবন্তীর বাড়ি জনা দশ একত্রে পড়ে। নিয়াজ হাসানের বাড়ি আরও দশ। রাজিন্দর সুরানার ঘরটা আরও বড়। ওদের সব ঘরই হলঘর। ওখানে একসঙ্গে বারো জন। আর নটরাজের মাটি ভাপাবার সময় নেই। কে বলল খ, কে বলল খা, শোনার সময় নেই। লাইব্রেরি যাচ্ছে রেগুলার। জেরক্স করছে তাড়া তাড়া। বিতরণ হবে। মোটর সাইকেল কিনেছে, লাল হেলমেট, কোচিং যাবে। ফেল্ট পেনের সেট। খাতা কারেকশন করবে। নটরাজ একাই একখানা চলমান ইউনিভার্সিটি।
ভালো উপরিও আছে প্রফেশনে। রেজাল্ট বেরোলে উপহার আসতে থাকে নানান কিসিমের। চিত্রাংশু দিয়ে গেল ‘মিথস অ্যাণ্ড লেজেণ্ডস’, সুমনা এনেছে বিদেশি কলম, মাইকেল জ্যাকসন নিয়ে হাজির সুশোভন, মিতারা দশজনে মিলে কিনে এনেছে এনসাইক্লোপিডিয়া ছ-ভল্যুম। সুরানা রবীন্দ্র রচনাবলী রাজসংস্করণ।

ফুরফুরে চুল সাবধানে আঁচড়ে তাম্রলিপ্ত জিনস আর ক্রিম টি শার্ট পরিধান করে অতএব নটরাজ সেবন্তীর বাবার বাড়ি যায়। শ্রেষ্ঠ উপহারটি তিনিই দেবেন। দশহাজারি টিউটরের লালচে গাল, কালচে চুল, চকচকে খোলনলচে, ধুন্ধুমার মোটর সাইকেল, কথাবার্তায় সাবলীল দখল সেবন্তীর মতো সেবন্তীর বাবাকেও টানে। নামি বিজ্ঞাপন কোম্পানির দামি চাকরি তাঁরই সৌজন্যে হাঁকড়ায় নটরাজ। এবং শেহনাই বাজে।

নটরাজ সিনহা, যে একদিন নিজের পা খুঁজে পাচ্ছিল না, বাম্পার ড্র-এর ফার্স্ট প্রাইজখানাই সে পেয়ে গেছে লটারিতে। সে এখন শ্বশুর প্রদত্ত সুবিশাল যোধপুরী ফ্ল্যাটে থাকে। মামাশ্বশুর প্রদত্ত কনটেসা হাঁকায়। ঘরে ঘরে অত্যাবশ্যক ভোগ্যপণ্য শীতাতপ নিয়ন্তাগুলি পিসি শাশুড়ি মাসি শাশুড়িরা যুক্তি করে উপহার দিয়েছেন। সেইখানে চিনে মিস্ত্রির তৈরি সেগুন কাঠের ফার্নিচারে অঙ্গ রেখে অফিসান্ত কাজকর্ম সাঙ্গ করেন বাদশাহ। চেহারায় আরও চেকনাই। চুলে আরও গ্লেজ। চলনে আরও উড়ান। বলনে আরও পালিশ।

কোনও কোনও উইক-এণ্ডে বাদশা-বেগম সামাজিক হয়ে যান। বেলিয়াঘাটার পুরনো পাড়ায় যান। পুরনো বাড়ির চটা ওঠা ফাটা-চাতালে দুটি চাতক পক্ষী। চাতক? না গায়ক?
দাদা ডাকেন—কুহুঃ
বউদি ডাকেন—পিউ কাঁহা।
প্লেটে খাবার সাজাতে সাজাতে ডাকেন, খাবার তুলতে তুলতে ডাকেন, চা করতে করতে ডাকেন, সেই একই বউদি, যিনি অসামান্য প্রতিভায় টাকাকে ‘মা’ বলেছিলেন। পাড়ার জ্যাঠামশাই এসে যান। এসে চেঁচিয়ে বলেন—তিনি বরাবর জানতেন নট এলেমদার ছেলে। খাটো গলায় আবার বলেন — অন্তত হাজার পাঁচেক যদি….. বাড়িটা বড্ড আটকে গেল কি না….।

পাড়ার ঝগড়াটি ধনেশগুলো কী মন্ত্রে সব শিস দেওয়া বুলবুল-দোয়েল হয়ে গেছে। গেরস্থ পায়রাগুলো যারা নিজের নিয়ে থাকত, কদাচ গণ্ডির বাইরে পা ফেলত না, তারা সব কুতূহলী শালিখ হয়ে কদম কদম বেঢ়ে আসছে। নটরাজের অভিমুখে।
শুক-সারীকে ব্যাটবল নিয়ে মাঠ থেকে ফিরতে দেখে দপ করে মনে পড়ে গেল।
-তোরা আজকাল টিউটরের কাছে পড়িস না?
— পড়ি তো! টিউটোরিয়্যাল হোমে!

বউদি বলল -এক-এক সাবজেক্টের এক-এক টিচার রাখবার সঙ্গতি নেই ভাই আমাদের। অগত্যা টিউটোরিয়াল।
কোথাও কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়া নেই। কারুর মনে কোনও সন্দেহ ঘুণাক্ষরেও দানা বাঁধেনি। তবু… তবু জিজ্ঞেস করা গেল না। কেমন বাধো বাধো ঠেকল।
বউদি নিজেই কী ভেবে বলল – তা ছাড়া আলোকে দিয়ে হায়ার ক্লাসটা ঠিক হয় না। ওর তো দাদাটি আবার মারা গিয়ে বসে আছে। বাপের সংসার, দাদার সংসার সমস্ত ওর ঘাড়ে। অগুনতি টিউশানি করে।

দেখা হবার কথা নয়। অগুনতি টিউশানি করে যখন। তবু একদিন দেখা হয়ে গেল। বাই-পাস ধরে এসে বিজন সেতু দিয়ে গড়গড়িয়ে নেমেছে কনটেসাটা, বালিগঞ্জ স্টেশনের মুখে দু নম্বর থেকে নেমে এলো আলো। মোটা ফ্রেমের চশমা। পুরু কাচের ওধারে চোখ গলে গেছে। শিটোনো। কেমন কালিঝুলি মাখা। শাড়িটা যেন বড্ডই বড় হয়েছে। কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে এসে অর্ধেক আলোকে ঢেকে দিয়েছে। কেমন উড়োখুড়ো।
-এ কি আলো ? এখানে? চিনতে পারো?
চশমাটা বারবার ঠিক করে অবশেষে ঘাড় ঝাঁকিয়ে এক চোখে তাকিয়ে রইল আলো।

বলল—কঃ।
—আমি নটরাজ। নটরাজ সিনহা।
কঃ, কঃ, হফ।
-এ কি? এত কাশছ? ওষুধ খাও!
—খাই তো! চলি, খুব দেরি হয়ে গেছে।

আলো আঁটসাঁট করে বড় কাপড়টা জড়িয়ে পরেছে। চটিটাও বোধহয় বড়। কেমন ঘষড়াতে ঘষড়াতে চলে গেল।
অনেক রাতে সেবন্তী ঘুমে, বাড়ির কাজের লোকগুলি ঘুমে, সেবন্তীর ছেলে ঘুমে। কা! কা! কা! বিস্মিত, ব্যথিত, বিপন্ন ডাকাডাকি চরাচরে। ঘুম চটে যায় নটরাজের। জানলা থেকে ফিকে জোছনার প্রপাত দৃষ্ট হয়। অগত্যা নিশি-ডাকে বারান্দায়। সৌর প্রকৃতির যাদুদণ্ড জোছনার গায়ে ভোরালো আলো-আঁধারি ছুইয়ে দিয়েছে। আর, বুঝি দুখনিশি ভোর—এই বিভ্রমে পাগলের মতো ডেকে ডেকে ফিরছে কাকেরা। সেই কাকই তো? ছরকুটে পা….. কালিঝুলি….. উড়োখুড়ো….? কা? কা? কা?
কাকের গলায় এমন আর্দ্র, সুদূর, মন-শূন্য করা জিজ্ঞাসা আগে কখনও শোনেনি সে। কাক না ঘুঘু! তফাত করা যায় না।

সমাপ্ত

download bangla books pdf

Be the first to comment

Leave a Reply