লাস্ট ফর ডেথ – জেমস হ্যাডলি চেজ Last for Death bangla by James Hadley Chase

লাস্ট ফর ডেথ - জেমস হ্যাডলি চেজ Last for Death bangla by James Hadley Chase
লাস্ট ফর ডেথ - জেমস হ্যাডলি চেজ Last for Death bangla by James Hadley Chase

জেমস হ্যাডলি চেজের অসাধারণ থ্রিলার গল্প লাস্ট ফর ডেথ Last for Death bangla পড়ুন এখান থেকেই।

লাস্ট ফর ডেথ - জেমস হ্যাডলি চেজ Last for Death bangla by James Hadley Chase
লাস্ট ফর ডেথ – জেমস হ্যাডলি চেজ Last for Death bangla by James Hadley Chase

থ্রিলার গল্প লাস্ট ফর ডেথ Last for Death bangla পড়ুন

পাগলাগারদ ক্রিকেট মাঠে পৌঁছলাম তখন চিফ মেডিক্যাল অফিসার করমর্দন করতে এগিয়ে এলেন। যখন আমি তল্পিতল্পা নিয়ে বাড়িতে উঠেছি। সেখানে তার সঙ্গে আমার আগেই দেখা হয়েছিল। আমি তাকে বললাম, ‘আমি ল্যাম্পটন টিমের হয়ে কেবল আপ রান লিখব। (আগের সপ্তাহে আমার একটা আঙুল ভেঙেছে উঁচু নীচু পিচে উইকেট রক্ষা করতে গিয়ে) তিনি বললেন সবকিছু শুনে, ‘ওহো আপনি একজন মজার সঙ্গী পাবেন তো তাহলে।’
আমি শুধোলুম, ‘অপর কে রান লিখবে।’

জবাব দিলেন ডাক্তার, ‘সবচাইতে বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন এই ক্রসলি পাগলাগারদের মধ্যে, খুব ভাল দাবা খেলেন, অনেক পড়াশুনা করেছেন লোকটি এবং লোকটির আরো অনেক গুণ রয়েছে। তাকেই এখানে পাঠানো হয়েছে মতিচ্ছন্নতার জন্য। তিনি নিজেকে একজন খুনী বলে মনে করেন এটি তার সব চাইতে গুরুতর মতিচ্ছন্নতা।
তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে দুটি পুরুষ এবং নারীকে খুন করেছেন একথা সকলকে বলে বেড়ান। তার আরো ধারণা তার আত্মা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এই মতিচ্ছন্নতা আরো হাস্যকর, এই কথাটির যে কী অর্থ তা কেউ জানে না। আমাদের মাসিক পত্রিকাটির সম্পাদনা করেছেন তিনি, বড়দিনের থিয়েটারে আমাদের রঙ্গমঞ্চের তত্ত্বাবধান করেন, তিনি কিছু মৌলিক যাদুর খেলাও দেখালেন সেদিন। তাকে আপনার ভাল লাগবে।

কেড pdf – জেমস হেডলি চেজ Cade pdf – James Hadley Chase

পরিচয় হল তার সঙ্গে। চল্লিশ-পঞ্চাশ বয়স হল তখন ক্রসলির। আমার কিছুটা অস্বস্তিবোধ হতে লাগল রান লিখিয়েদের বক্সে তার ঠিক পাশে বসে। আমার বড় বেশী কাছে রয়েছে তার লোমশ হাত দুটো। আমি ভয় করি না কোনো দৈহিক আক্রমণের। একটা আসাধারণ অলৌকিক শক্তির অধিকারী মানুষ যে আমার পাশে বসে রয়েছে সেটাই শুধু আমার মনে হয়েছে।
স্কোরিং বক্সটা বেশ গরম। বড় জানলা থাকা সত্ত্বেও ক্রসলি বলে উঠলেন, মাস্টারি গলায়, ‘আমাদের মত রোগীর আচরণ আরও বেশী অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে এ ধরনের ঝড়ো আবহাওয়ায়।

কোনো রোগী খেলছে কিনা সেটা আমি জানতে চাইলাম। ‘প্রথম জুটির এই দু’জন, দু’জন খেলছে। তিন বছর আগে ঢ্যাঙা ধরনের বি. সি. ব্রাউন হ্যান্ট দলের হয়ে খেলেছে। বেশ ভালোই খেলে আর অপরজন ক্লাবের হয়ে। সাধারণতঃ আমাদের হয়েই খেলে প্যাট স্লিংসবি-আপনি চেনেন তো অস্ট্রেলিয়ার এই ফাস্ট বোলারকে। কিন্তু তাকেও আমরা বসিয়ে দিয়েছি আজ। ব্যাটসম্যানের মাথা লক্ষ্য করেই সে হয়তো বল ছুঁড়ে বসবে এ ধরনের আবহাওয়ায়। সে অসম্ভব রকমের বদমেজাজী, তবে তাকে ঠিক পাগল বলা চলে না। তার কিছুই করতে পারে না ডাক্তাররা।

ডাক্তারের কথা তারপরই বলতে শুরু করে দিল ক্রসলি। ‘মনটা খুবই ভাল ডাক্তারের, ডাক্তার হিসাবে বেশ ভালই পড়াশুনা করেছেন এবং করেনও। তিনি মানসিক হাসপাতালের ডাক্তার। তিনি পড়াশুনা করেন বিষণ্ণ মনস্তত্ত্ব নিয়ে একেবারে গত পরশু পর্যন্ত তিনি সব খবরাখবর রাখেন আমার। খুব মজা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি পড়েন না জার্মান বা ফরাসী, আমি সবসময় কিছুটা এগিয়ে থাকি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারে; তাকে তো অপেক্ষা করতে হয় ইংরাজি অনুবাদের জন্য। আমি তাকে ব্যাখ্যা করতে বলি নতুন নতুন স্বপ্ন তৈরী করে। আমার রোগটা আসলে “anti Paternal
fination” বলে তার ধারণা।

ক্রসলি তারপরই জানতে চাইল, ‘তার একটা গল্পের দিকে আমি কান দিতে পারব কিনা স্কোর লিখতে লিখতে। তা পারব, আমি বলে উঠলাম। বেশ ঢিমে তালে চলছিল ক্রিকেট খেলাটা।
সে বলে উঠল, ‘আমার প্রতিটা কথাই সত্য, খুবই সত্য। আমি মাঝে মাঝে গল্পের চরিত্রগুলো এমনকী চরম পরিণতিগুলোকে পাল্টে দিই। গল্পটা নতুন অথবা সতা হয়ে ওঠে এই পরিবর্তনের ফলেই। গল্পটা অচিরেই একঘেয়ে ও মিথ্যা হয়ে যেত যদি একই ফর্মুলাকে ব্যবহার করতাম সবসময়। গল্পটাকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে চাই। প্রতিটি কথাই সত্য এর এবং এটি একটি সত্য গল্প। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই গল্পের লোকটিকে চিনি। ল্যাম্পটনের মানুষ এরা সকলেই।

আমি শুধু রান ও অতিরিক্ত রানের হিসাব রাখব। এটাই স্থির হল। ক্রসলি বোলিং-এর বিশ্লেষণ ছাড়াও পরস্পরের লেখা থেকে বাকিটা টুকে নেবে উইকেট পতনের পরে। গল্পটা বলা সম্ভব এই ব্যবস্থার ফলেই।
রিচার্ড র‍্যাচেলকে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই বলল, ‘একটা স্বপ্ন, কি অস্বাভাবিক।’ র‍্যাচেল বলে উঠল, ‘লক্ষ্মীটি তুমি তাড়াতাড়ি আমাকে বলবে, কারণ তোমাকে আমি বলতে চাই আমার স্বপ্নটাও।’

রিচার্ড বলে উঠল, ‘একজন খুব বুদ্ধিমান, (অনেকজন কি? কারণ মাঝে মাঝেই বদলে যাচ্ছিল চেহারাটা তার) লোকের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। পরিষ্কার মনে আছে যে যুক্তিগুলো দিয়েছিল সেই যুক্তিগুলি, সর্ব প্রথম স্বপ্নে শোনা কোন যুক্তিকে আমি স্মরণ করতে পারছি এই। এতই আলাদা আমার স্বপ্নগুলি জাগ্রত অবস্থা থেকে যে এটা বর্ণনা করতে গেলে আমাকে বলতে হয়, আমি চিন্তা করছি এবং বেঁচে আছি একটা গাছের মত বা একটা ঘণ্টার মত বা মধ্যবর্তী C এর মত বা পাঁচ পাউন্ড নোটের মত, আমি মানুষ যেন ছিলাম না কোনোদিনই।’

‘একই অবস্থা আরে আমারও তো’ র‍্যাচেল বলে উঠল। ‘আমি তো একটা পাথর হয়ে যাই, একথা মনে হয় ঘুমের মধ্যে। আমার মধ্যে তখন জেগে ওঠে পাথরের মতো স্বাভাবিক ক্ষুধা ও প্রতায়।’ এটি একটি প্রবাদবাক্য যে, ‘যদিও একটি পাথর বোধবিহীন হয় তবু একটি পাথরের মধ্যে নরনারীর চাইতেও বেশী বোধ, বেশী ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং বেশী আবেগ থাকতে পারে।
রবিবারের সকাল। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে তারা বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে সময়ের তোয়াক্কা না করে। তাদের প্রাতঃরাশও অপেক্ষা করতে পারে যেহেতু তাদের কোনো কাজ নেই। সেই সময় স্বামী বলে উঠল স্ত্রীকে, সেই লোকটি বা লোকগুলির সঙ্গে সে স্বপ্নের মধ্যে সেই বালিয়াড়িতে হাঁটছিল, সেই সময় বলে উঠল তাকে লোকগুলি বা লোকটি।’

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রহস্য উপন্যাস ও গল্প পিডিএফ (সকল খন্ড) Bishwer Shreshtha Upanyas O Chhoto Galpo Pdf All part

এখানকার যে বালিয়াড়িগুলি রয়েছে তা আমাদের কোনো দূরবর্তী পাহাড় শ্রেণীর সঙ্গে সংযুক্ত নয়, বা সম্মুখক্ত সমুদ্রের অংশ বা পিছনকার বালিয়াড়ির অংশও নয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ তারা নিজেরাই। যে কোনো মানুষ বাতাসের ঘ্রাণ থেকেই বুঝতে পারে যে সে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছে। সে অনন্তকাল ধরে অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকতে পারে যদি সে না খেয়ে, না কথা বলে, না পান করে, না ঘুমিয়ে বা কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই থাকতে পারে। মৃত্যু নেই এবং জীবন নেই এই বালিয়াড়ির মধ্যে। সবকিছুই ঘটতে পারে সেখানে।’
‘তাড়াতাড়ি বাজে কথা রেখে যুক্তিটা বল’ র‍্যাচেল বলে উঠল।

রিচার্ড জানাল, আমার গতিবিধি সম্পর্কে যুক্তিটা ছিল, সেটা মাথা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে তার তাড়া খেযে। লোকটি প্রথমে ছিল জাপানী এবং তারপর ইতালীয় এবং শেষ পর্যন্ত একটি ক্যাঙারু হয়ে গেল সেটা মনে আছে।

স্বপ্ন-কাহিনী তার স্ত্রীও তাকে পাল্টা শোনাল। ‘অনেক খরগোশ ছিল এরকম একটি বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে আমি হাঁটছিলাম। তার সঙ্গে মিলছে কি জীবন এবং মৃত্যু সম্পর্কে লোকটি যা বলছে। আমি দেখলাম হাতে হাত ধরে হেঁটে আসছ তুমি এবং সেই লোকটি, তোমাদের দু’জনের কাছ থেকে দৌড়ে সরে যাচ্ছি আমি, একটি কালো রুমাল বাঁধা তার মাথায়। আমার পিছনে দৌড়াতে লাগল সেও, জুতোর বলস খুলে গেল আমার, আমি কিন্তু অপেক্ষা করতে পারলাম না সেটা তুলে নেবার জন্য। সে উপুড় হয়ে বলসটা ভুলে নিয়ে পকেটে পুরল।’

স্বামী বলল, ‘তুমি কি করে বুঝলে লোকটি যে একই’ স্ত্রী বলে উঠল হেসে, ‘তার পরণে ছিল একটা নীল কোট যেটি ছিল ক্যাপ্টেন কুকের ছবির মতই এবং কালো ছিল তার মুখটা। বালিয়াড়ির ব্যাপার তো ছিল এটাও।’
স্ত্রীর গলায় চুম্বন করে স্বামী বলে উঠল, ‘আমরা একত্রে বাস করি। একত্রে ঘুমোই এবং একত্রে কথা বলি শুধু নয়, স্বপ্নও দেখি একত্রে।’
তারা হাসতে লাগল এই কথা বলার পর।

এরপর স্ত্রীর প্রাতঃরাশ স্বামী উঠে গিয়ে এনে দিল। স্ত্রী বলল, সাড়ে এগারোটা নাগাদ একটু বাইরে থেকে ঘুরে এস লক্ষ্মীটি, ঠিক একটায় ডিনার, সময়মত বাড়ি ফিরো এবং এমন কিছু নিয়ে এস ফিরবার সময় ভাবনাচিন্তা করতে পারি যা নিয়ে।
সকালবেলা বেশ গরম কারণ এটি মে মাসের মাঝামাঝি। স্বামী উপকুলের পথ ধরল জঙ্গল পার হয়ে। ল্যাম্পটন সেখান থেকে আধঘণ্টা হাঁটলেই। ক্রসলি শুধাল, ভাল চেনেন কি আপনি ল্যাম্পটন, ‘আমি এখানে শুধু ছুটি কাটাতে এবং বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে আসি।’

সে ল্যাম্পটন ছাড়িয়ে পাহাড়ের নীচে পুরনো গির্জাটায় পৌঁছে গেল অনেক হেঁটে এবং অনেক পথ ঘুরে। প্রার্থনা শেষ হয়ে গেছে সকালবেলাকার। গির্জা থেকে বেরিয়ে আসছে নরম ঘাসের উপর দিয়ে সকলে দুয়ে দুয়ে কিংবা তিনে তিনে। ছেলেমেয়ে খেলা করছে একদল। রেক্টর বাইরে বেরিয়ে এল এবং বলটা পকেটে পুরতে পুরতে বলল, তাদের মনে রাখা উচিত যে এটা রবিবার। এই বলে চলে গেল রেক্টর। তাকে ভেংচি কাটতে লাগল ছেলেমেয়েরা।

ইতিমধ্যে একটি লোক রিচার্ডের পাশে এসে বসার অনুমতি চাইল। এরপর আলাপ শুরু হল দু’জনের মধ্যে। এসেছিল লোকটি গির্জার কাছে। তাই নিয়ে কথা বলতে লাগল সে। সেখানে যা শুনে এসেছে। দেহকে আশ্রয় করে আত্মা বাস করে পরপর – কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে প্রচারের সেই বাণীকে। আত্মা মস্তিষ্ক, ফুসফুস, পাকস্থলী, হৃদপিণ্ড বা মন বা কল্পনা নয়, স্বতন্ত্র থাকে সে সবকিছুতেই। দেহের ভেতরে কেন থাকবে এটি দেহের বাইরে না থেকে। সে বলল, ‘আমরা তো কোনো সঠিক মুহূর্ত বলতে পারিনা জন্ম বা মৃত্যুর এবং এটি ঠিক কোনসময়ে হয়। জাপানে তো আমি গিয়েছি। জন্মমুহূর্তেই সেখানে একবছর গণনা করা হয় নবজাতকের। বালিয়াড়িতে ঘটতে হাঁটতে কথা বলি চলুন কারণ হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে আমি অনেক আরাম পাই, সম্প্রতি ইতালিতে একটি মৃত মানুষ – ‘

ভয় পেয়ে গেল রিচার্ড একথা শুনে। সে আরো ভয় পেল কালো রেশমী রুমাল দিয়ে লোকটিকে কপাল মুছতে দেখে। তাদের ছেলেমেয়েগুলো তাদের কানের কাছে বিকট চীৎকার করে উঠল হঠাৎ ঠিক সেই মুহূর্তেই এবং হেসে উঠল হো হো করে। ভীষণ রেগে গেল নবাগত লোকটি। মুখ খুলল গালাগালি দিতে, দাঁত বেরিয়ে গেল মাড়ি পর্যন্ত। চীৎকার করে পালিয়ে গেল তিনটি ছেলে। এলসি বলে থাকে তাবা ডাকছিল সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ভয় পেয়ে পড়ে গিয়ে। মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিল ডাক্তার কারণ সে কাছেই ছিল। মেয়েটি বলছে দু’জনেই শুনতে পেল, “শয়তানের মত ওর মুখটা লাগছে।’

হেসে উঠল আগন্তুক ভাল মানুষের মত, ‘আমি শয়তান ছিলাম না কিছুদিন আগেও। উত্তর অষ্ট্রেলিয়াতে ঘটনা ঘটেছিল। বিশ বছর কাটিয়েছি সেখানে কালো মানুষের সঙ্গে। যে মর্যাদা আমায় দিয়েছিল তারা সেখানে তর্জমা করলে ইংরাজী ভাষায় সেটা ‘Devil’ বা শয়তান হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৃটিশ নৌবাহিনীর একটা পোশাকও ইউনিফর্ম হিসাবে তারা আমায় দিয়েছিল। বালিয়াড়িতে হাঁটতে হাঁটতে চলুন আপনাকে পুরো গল্পটাই বলব। আমার হাঁটতে খুব ভাল লাগে বালিয়াড়িতে। আমার নাম চার্লস, আমি এজন্যই এসেছি এ শহরে।’
‘ধন্যবাদ’, রিচার্ড বলে উঠল। ‘আমাকে কিন্তু ডিনারে যোগ দিতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে।’

‘বাজে কথা রাখুন’, চার্লস বলে উঠল। একটু পরে খেলেও চলবে ডিনা, আমিও আপনার সঙ্গে ডিনারে বসতে পারি যদি আপনি বলেন, শুক্রবার থেকে আমি কিছু খাই নি। পয়সা কিছু নেই পকেটে।’ অস্বস্তিবোধ করতে লাগল রিচার্ড, ভয় পাচ্ছে সে চার্লসকে। ডিনারে যোগ দিতে বলার ইচ্ছাও তার নেই ঐ স্বপ্ন। বালিয়াড়ি এবং রুমালের কথা ভেবে, আবার শুক্রবার থেকে কিছু খায়নি বলছে, লোকটি কিন্তু বুদ্ধিমান এবং শান্তশিষ্ট। র‍্যাচেল তো হাসি-ঠাট্টা শুরু করে দেবে যদি সে জ:- পারে যে তাকে একবেলা খাওয়াতে অস্বীকার করছে। ঠাট্টা করে র‍্যাচেল তো রেগে গেলেই বলে ‘ফাদার মাদার ওয়ান হাউস’। ‘বেশ তো আসুন না ডিনারে’ সে বলে উঠল। ‘ছোটো মেয়েটি ফুঁপিয়ে কাঁদছে এখন, সান্ত্বনা দিন না একটু ওকে ইশারায় চার্লস মেয়েটিকে কাছে ডাকল।

একটি মাত্র কথা বলল তাকে ‘দুধ’ যা অস্ট্রেলিয়ার একটি যাদু শব্দ। চার্লসের হাঁটুর ওপর বসল এসি এবং তার ওয়েষ্ট কোটের বোতাম নিয়ে খেলা শুরু করে দিল। চার্লস তাকে নামিয়ে দিল পরে। ‘আপনার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে একটি’ একথা রিচার্ড বলে উঠল ।
চার্লস জবাব দিয়ে উঠল ‘আমি ভালবাসি ছেলেমেয়েদের। আমি চমকে উঠেছিলাম ওদের চীৎকার শুনে। আমি আনন্দিত এজনাই যে সেটা আমি করে ফেলিনি মুহূর্তের জন্য যা করার লোভ আমার হয়েছিল।’
রিচার্ড শুধাল ‘ঘটনাটা কি?’

চার্লস বলে উঠল, রিচার্ড বলে উঠল মনের মত খেলা পেত বলে তাদের ভালোই লাগত । চার্লস মন্তব্য করে আমি যদি চীকাৎকার করে উঠতাম তাহলে তারা সর্বদা পাগল হয়ে যেতো। ‘ড্রাগন জাতীয় কোন বিশেষ যাদুকর নিশ্চয় ছিল সে’ চার্লস বলে উঠল, ‘হ্যাঁ মিলে যাচ্ছে কারণ ক্যাঙারু জাতির অন্তর্ভুক্ত আমি।

তারা বাড়ি ফিরল একটার সময়। দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল র‍্যাচেল। তৈরী করাই ছিল ডিনার। রিচার্ড বলল, ‘ইনি মিঃ চার্লস র‍্যাচেল। আমি একে ডিনারে আমন্ত্রণ করেছি। মস্তবড় পর্যটক ইনি।’ র‍্যাচেল চোখের ওপর হাত রাখল রোদটাকে আড়াল করবার জন্য। চুমো খেল তার হাত ধরে চার্লস, র‍্যাচেল অবাক হয়ে গেল এই ঘটনায়।
ক্রসলি বলল, ‘আপনার ভাল লাগবে র‍্যাচেলকে। কারণ সে মাঝে মাঝে আসে। কিছু বলা হল চার্লসের সম্পর্কে, তাব মাঝারী বয়স, সে লম্বা, তার চুল পাকা, চোখ দুটি বড় বড় এবং উজ্জ্বল। যা কখনও হলুদ, বাদামী বা ধূসর। বিষয়বস্তু অনুসারে গলার স্বর বদলে যায় কথা বলার সময়। নখ সযত্ন রক্ষিত, হাত দুটি বাদামী এবং নীচের দিক লোমশ। রিচার্ড একজন শক্তিমান নয় কিন্তু ভাগ্যবান সঙ্গীত শিল্পী। ভাগ্যই তার শক্তি বলে মনে হয়।

একসঙ্গে বাসনপত্র ধুয়ে ফেলল রিচার্ড এবং চার্লস তাদের ডিনারের পরে। না হলে সম্ভবতঃ তারা মারাই যেত।’
বোকার মত একটু হাসি হাসল রিচার্ড। রিচার্ড ঠিক বুঝে ওঠেনি তার হাসা উচিত কিনা কারণ চার্লস এমন গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলল। সে বলে উঠল, ‘আমাকে একটু শোনান তো, সেটা আবার কিরকম চীৎকার। শোনান তো আমাকে একটু’-

‘ছোটরাই যে আমার চীৎকারে আঘাত পায় তা কিন্তু নয় চার্লস বলে উঠল। ‘ঘোর পাগল হয়ে যেতে পারে তা শুনে বড়রাও। মাটিতে আছড়ে পড়তে পারে এ শুনে অতি শক্তিমান মানুষও। যাদু চীৎকার একটা এটা। আমি এটা শিখেছি উত্তর দেশের প্রধান শয়তানের কাছ থেকে। এটাকে রপ্ত করেছি আঠারো বছর ধরে। মোট পাঁচবারের বেশী এটা ব্যবহার করিনি এই সময়ের মধ্যে। ‘ব্যাপারটা একটু দেখাবেন, রিচার্ড বলে উঠল।

‘আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথায় এটা আমি দেখছি’ চার্লস বলে উঠল। ‘ভয় দেখানো হুংকার কি আপনি আগে কখনও শোনেননি। ‘
রিচার্ড কিছুক্ষণ ভেবে নিল, তারপর বলে উঠল, ‘শত্রুপক্ষের সৈন্যরা শুনে ছুটে চলে যেত প্রাচীন আইরিশ যোদ্ধারা এমন বীরত্বব্যঞ্জক হুংকার দিত।’ আর ভয়ংকর হুংকার ছাড়ত ট্রয়ের মহাবীররা। হঠাৎ জোর চীৎকার শোনা যেত গ্রীসের জঙ্গলে। মানুষ ভয়ে পাগল হয়ে যেত বন্যদের প্যাকের সেই চীৎকার শুনে ইংরাজী “Panic” শব্দটা এসেছে এই উপকথা থেকেই। একটা হুংকারের কথা পড়েছি ‘মোবেনিজিয়ন’ এর লুড ও লালির গল্পেও। হুংকার শোনা যেত প্রতি মে ইজ্ এ। ভয়ে পুরুষদের মুখ শুকিয়ে যেত। ঢোক গিলে রিচার্ড বলল, ‘হুঙ্কারটা কি জোরালো না কর্কশ ধরনের? লোক পাগলই বা হয় কী করে, বা এটা কেমন ভাবেই হয়।

চুপ করে রইল চার্লস, রিচার্ড বলতে লাগল বোকার মত হেসে, ‘অদ্ভুত জিনিষ হল একটা শব্দ। আমি যখন কেম্ব্রিজে ছিলাম মনে পড়ে, সন্ধ্যাকালীন পাঠটা পড়াবার তখন কিসে একবার কলেজে পালা পড়েছিল। একটা আর্তনাদ শোনা গেল যখন সে দশটা শব্দও উচ্চারণ করেনি, সঙ্গে সঙ্গে ধুলোবালি, কাঠ ঝরতে শুরু করল এবং ক্যাচ-কোঁচ একটা শব্দ উঠল। সে পড়া না থামিয়ে দিলে ছাদটাই হয়তো ভেঙে পড়ত। বেহালায় একটা সুর বাজিয়ে আপনি মদের গ্লাসকে ভেঙে ফেলতে পারেন?’

জবাবে চার্লস বলল, ‘স্বরক্ষেপণ বা বায়ুর প্রকম্পনের ব্যাপার আমার হুংকারে নয়, এটা ঠিক বোঝানো যাবে না এমন একটা কিছু। একান্তই ক্ষতিকর এই হুংকার। নির্দিষ্ট কোন সরগমের স্কেলে এটা বাঁধা নয়। ভয়ের ব্যাপার এটা একান্তভাবেই। আপনাকে হুংকার শোনাতে আমি আপত্তি করতাম আমার নিজের কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে এটা বলাই বাহুল্য।
স্বভাববশতঃ রিচার্ড ভীতিপ্রবণ। সে আরো ঘাবড়ে গেল হুংকারের নতুন বিবরণ শুনে। বিছানায় শুয়ে থাকলে ভাল ছিল এটা তার মনে হল, চার্লস যদি দুই মহাদেশ জুড়ে থাকত তো সেটা তার পক্ষে আরো ভালা হত। আকর্ষণ আরও বাড়ছে তার।

রিচার্ড ভয় পেয়ে গেল আরো র‍্যাচেলকে সাহস করে সে বলতে পারল না। কালো রেশমী রুমাল বা বালিয়াড়িতে হাঁটতে যাবার ডাক। মাথাটা ঘুরিয়ে সে বলে উঠল, অনেক কিছুই জানে চার্লস, কিছু মনে যদি না কর তুমি। তাকে নিয়ে একটু বেড়াতে যাব কাল ভোরে। আমার খুব দরকারী প্রাতঃভ্রমণটা।

র‍্যাচেল বলল, ‘বেশ তো যাব আমি।’ আপত্তি করতে পারল না রিচার্ড। তার বেড়াতে যাবার কথাটা বলা ভুল হয়েছে এটা রিচার্ড বুঝল। সে বলে উঠল, ‘ভোর ছটায় ঠিক। এতে খুব খুশি হবে, চার্লস।
ঘুম থেকে উঠল রিচার্ড ঠিক ছ’টায়। ঘুমের ঘোর থাকায় র‍্যাচেল তাদের সঙ্গে যেতে পারল না কারণ তার মদের নেশা ছিল। চুম্বন করে বিদায় দিল স্বামীকে। চার্লসকে নিয়ে তার স্বামী বেরিয়ে পড়ল।

রিচার্ডের ভালো কাটেনি রাতটা। স্বপ্ন দেখেছে সে আজে বাজে। তার মনে হয়েছে সে যেন অনেক দূরে চলে গেছে র‍্যাচেলের কাছ থেকে। তাকে যেন কুরে কুরে খেয়েছে হুংকারের আতংক। তার শীত করছে খুব এবং খুব খিদেও পেয়েছে। তীব্র হাওয়া একটা বইছে সমুদ্র থেকে পাহাড়ের দিকে। বৃষ্টি হয়েছে কয়েক পশলা। তাই কথা নেই চার্লসের মুখে। সে দ্রুত হাঁটছে একটা ঘাস চিবোতে চিবোতে।

মাথাটা ঝিমঝিম করছে রিচার্ডের। চার্লসকে সে একমিনিট দাঁড়াতে বলল। সে বলল, ‘আমার বাঁদিকে চার্লসকে হঠাৎ হুংকারটা একসময় রিচার্ড শোনাতে বলল, সেটা না শোনা পর্যন্ত সে স্বস্তি পাচ্ছে না।
বাসন মোছা ন্যাকড়াটা হাতে নিয়ে চার্লস বলে উঠল, যেমন ইচ্ছা আপনার। আপনাকে তো আগেই আমি সাবধান করে দিয়েছি এ হুংকার সম্পর্কে। এমন একটা নির্জন স্থানে হুংকার করার ইচ্ছা হলে করতে হবে যেখানে কেউ হুংকার শুনতে পারবে না। দ্বিতীয় ডিগ্রীর হুংকারের ফল নিশ্চিত মৃত্যু তাই দ্বিতীয় ডিগ্রীর হুংকার করব না। প্রথম ডিগ্রী হুংকার আমি প্রথমে শোনাব সেটার ফলে কেবল আতঙ্ক হয়। আপনার দুই হাত দুই কানে চেপে ধরবেন যখনই আপনি থামাতে চাইবেন।’
রিচার্ড ‘ঠিক আছে’ এই কথা বলে উঠল।

দিইনি চার্লস বলে উঠল ‘আমি হুংকার দিচ্ছি নিছক কৌতূহল মেটাবার জন্য। আমি হুংকার দিয়েছি কালো বা সাদা যে কোনো শত্রুর হাতে জীবন বিপন্ন হলে তবেই । তখন হুংকার ছাড়ছিলাম যখন মরুভূমিতে একলা ছিলাম, তখন কেবলমাত্র খাদ্য ও পানীয়ের জন্য বাধ্য হয়ে হুংকার ছাড় ছিলাম।

রিচার্ড মনে মনে ভাবল, ‘আমি ভাগ্যবান তাই আমার ভাগ্য ভাল হবে অবশ্যই এ ব্যাপারে।’ চার্লসকে সে বলে উঠল, ‘ভয় পাচ্ছি না আমি।’
‘আমি কাল ভোরে অন্য কেউ ওঠার আগে বালিয়াড়িতে চলে গিয়ে হুংকার ছাড়ব’ ভয় পাবেন না আপনি তো বলছেনই।’
আসলে কিন্তু ভয় পেয়ে গেল রিচার্ড। যে র‍্যাচেল এই কারণে বলতে পারল না কথাটা তাই সে ভয় তার আরও বেড়ে গেল। এই কথাটা শুনলে র‍্যাচেল নিয়ে যেতে দেবে না অথবা নিজে সঙ্গে যাবে। এই ভয় ও ভীরুতা চিরকাল কষ্ট দেবে র‍্যাচেল। হুংকার যদি না শোনা যায় তাহলে আবার সঙ্গে গেলে ঠাট্টা করার একটা অজুহাত খুঁজে পাবে র‍্যাচেল আবার পাগলও হয়ে যেতে পারে হুংকার শোনা না গেলে। রিচার্ড এই কারণে কিছুই বলল না তাকে।

রাতটা কুটীরে থাকল চার্লস এবং অনেক রাত অবধি তারা গল্প করল দু’জনে। মদ খায় না র‍্যাচেল। তবে সেদিন দু-গ্লাস খেয়ে বকতে লাগল আজে বাজে। বলে উঠল, লক্ষ্মীটি তোমায় তো ভুলেই গেছি বলতে। সকালে যখন জুতো জোড়া পরতে গেলাম তখন দেখলাম বলস নেই এক জোড়া জুতোর। মিঃ চার্লসের পকেটেই বলস ছিল বলে আমার ধারণা। ঐ লোকটিকেই আমরা আবার স্বপ্নে দেখেছি। এটা আমার নিশ্চিত ধারণা। মোজার ভিতর দিয়ে পায়ে বিধছে ঘাসের ডগা। ভিজে উঠছে মোজা।

ন্যাড়া বালিয়াড়ির ওপর পৌঁছেছে এবার তারা। উঁচু ঢিবিটা থেকে চার্লস চারদিকে তাকাল। দু-মাইল বা তার বেশী দূর পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত। কাউকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। অন্যমনস্ক ভাবে কি যেন নাড়াচাড়া করছে চার্লস তার পকেট থেকে বার করে। অন্য আঙুলের ডগায় নিল এক আঙুলের ডগা থেকে, হাতের পিছনে নিয়ে গেল একটা আঙুল ও বুড়ো আঙুলে সেটাকে ধরে। এটা র‍্যাচেলের জুতোর বলস।

ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল, এবং বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল রিচার্ডের। বমি করার অবস্থা প্রায় তার। ঘাম হচ্ছে, আবার শীতে কাঁপছে। সমুদ্রের একটা খোলা জায়গায় তারা পৌঁছল সমুদ্রের ধারে। কিছু শেওলা ও সামান্য ঘাস জমেছে উঁচু তীরের উপর। পাথর ছড়িয়ে আছে চারদিকে, সমুদ্রের ঢেউয়ে অনেক বছর আগে পাথরগুলি এখানে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। চার্লস বলল, ‘আপনি কি প্রস্তুত?’
ঘাড় নাড়ল রিচার্ড।
একটা সাগর বালিয়াড়ির ঈগল উড়তে লাগল ডাকতে ডাকতে।
রিচার্ড শুকনো গলায় বলে উঠল, ‘সবুজ শেওলার উপর আপনি দাঁড়ান। একটু দূরে পাথরগুলোর উপর আমি দাঁড়াচ্ছি। আপনি হাত তুলবেন আমি হুংকার ছাড়লে আর সঙ্গে সঙ্গে থেমে যাবেন কানে আঙুল দিলেই।’

চার্লস শেওলার দিকে এগিয়ে এল বিশ পা হেঁটেই। রিচার্ড তার চওড়া পিঠ ও পকেট থেকে দেখতে পেল কালো রেশমী রুমাল তার মনে পড়ল এলসির ভয় পাওয়ার কথা স্বপ্নের কথা এবং জুতোর বক্লসের কথা। মানসিক দৃঢ়তা ভেঙে পড়ল তার, ভাঙা মোমবাতির দুটো টুকরো নিল এবং তারপর সে দুটি কানে গুঁজে দিল। চার্লস দেখতে পেল না সেটা।

সে ঘুরে দাঁড়াল এবং রিচার্ড হাত তুলে সংকেত জানাল তাকে। চার্লসের দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল এবং সামনে সে ঝুঁকল অদ্ভুত ভাবে। রিচার্ড আগে কখনও দেখেনি মানুষের মুখের এমন ভয়ার্ত দৃষ্টি। প্রস্তুত ছিল না এর জন্য সে। চার্লসের মোমের মত অনিশ্চিত নরম ও পরিবর্তনশীল মুখটা পাথরের মত কঠিন হয়ে গেল। মুখ প্রথমে সাদা, লাল হতে শুরু করল তারপর সবশেষে কালো হয়ে দমবন্ধ হবার উপক্রম হল। সম্পূর্ণ মুখটা ধীরে ধীরে খুলে গিয়ে অবশেষে উপুড় হয়ে পড়ে গেল রিচার্ড দুই হাতে কান চেপে ধরে।

তখন সে পাথরগুলোর ওপর একলা পড়ে আছে যখন তার জ্ঞান ফিরে এল। উঠে বসে ভাবতে লাগল সে যে কতক্ষণ পড়ে আছে। শরীরের চেয়ে বড় ধরনের কাপুনি ধরেছে বুকের মধ্যে, দুর্বল এবং অসুস্থ লাগছে খুব তার। ভাবতে সে কিছুই পারছে না। সে উঠতে গেল হাতের উপর ভর করে। একটা অন্য পাথরের চাইতে বড় পাথরের ওপর হাত পড়ল। অন্যমনস্কভাবে সে হাত বুলোতে লাগল পাথরের উপর। চিন্তা এল অনেকরকম মনে। জুতো তৈরী করার কথা মনে এলেও সে সেই কাজের কিছুই জানে না। তার পরিচিত বলে মনে হল এখন সবরকম মুচির কাজই। ‘আমি একজন মুচি’ একথা সে গলা খুলে বলতে পারত।

সংশোধনী করে সে বলল—আমি একজন সঙ্গীত শিল্পী। পাগল হয়ে যাচ্ছি কি আমি।’ ছুঁড়ে মারল সে পাথরটাকে। পাথরে লেগে সেটা ছিটকে পড়লো।
প্রশ্ন করল নিজেকেই, আমি একজন মুচি, আচ্ছা একথা কেন বললাম। এখন দেখছি কিছুই জানি না অথচ একটু আগে মনে হয়েছিল জুতো তৈরীর সবরকমই আমি জানি। কেন এভাবেই বেরিয়ে এলাম, র‍্যাচেলের কাছে ফিরে যাব এখনই।’

চোখে পড়ল তারপরই। বালির ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে শ’খানেক গজ দূরে চার্লস সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কানে হাত দিয়ে দেখল মোমের টুকরো দুটো কানের মধ্যে পড়ে আছে। এটাই প্রমাণ যে সে ভয় পেয়েছিল। একটা খরগোশ পড়ে কাতরাচ্ছে বালির উপর এবং একটা ঘূর্ণি উঠছে। রিচার্ড যেতেই ঘূর্ণিটা লেগে গেল আর মরে গেল খরগোসটা বিশ পা যাবার আগেই। বালির উপর দাঁড়িয়ে আছে পাখিটা বোকার মত। তাকে দেখে উড়ে না গিয়ে ধপ্ করে পড়ে মারা গেল।

রিচার্ড জানে না কেমন করে বাড়ি পৌঁছল। খিড়কীর দরজা খুলে হাতে পায় হামাগুড়ি দিয়ে কোতলার উঠে গেল বিবর্ণ মুখ এবং ভয়ে কাপতে কাপতে র‍্যাচেল বিছানায় বসে আছে।
সে বলে উঠল, ‘তুমি যে ফিরে এসেছ এটাই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। যদিও তুমি ফিরে এসেছ কিন্তু আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি এবং সেটা একটা দুঃস্বপ্ন। এত খারাপ ও ভয়ঙ্কর স্বপ্ন জীবনে দেখেনি। পাথর হয়ে গেছি আমি কিন্তু সহজ ও স্বাভাবিক অবস্থায় তুমি বসে রয়েছ। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না কিন্তু খুব ভয় পেয়ে গেছ তুমি। ভয়ঙ্কর কিছু তোমার বেলায় না ঘটে আমার বেলায় ঘটল। কিছুর জন্য যেন অপেক্ষা করে আছ তুমি। তোমাকে বলতে পারব না সেটা যে কি। আমার সবগুলি স্নায়ু একসঙ্গে যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠল।

আমাকে খান খান করে কেটে ফেলল একটা তীব্র অশুভ আলোর রেখা। তালগোল পাকিয়ে বেরিয়ে এল শরীরের ভিতরটা, ঘুমটা ভেঙে গিয়ে ধড়ফড় করতে লাগল এমন বুকটা যে শ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল। আমি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলাম বলে কি মনে হয় তোমার? তাতেও ঐরকম হয় একথা লোকে বলে। লক্ষ্মীটি তুমি ছিলে কোথায় এবং কোথায় মিঃ চার্লস?’
রিচার্ড হাত বাড়িয়ে দিল বিছানায় বসে। সে বলে উঠল ‘খুব একটা খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমারও। সমুদ্রের ধারে গিয়েছিলাম চার্লসের সঙ্গে। আমি মূর্ছিত হয়ে কতকগুলো পাথরের ওপর পড়ে গেলাম এগিয়ে গিয়ে সবচাইতে উঁচু বালির ঢিবির উপর উঠতে। ভয়ে ঘামে আমার সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে যখন আমার জ্ঞান ফিরে এল তখন দেখলাম। ঘটনাটা ঘটেছে সম্ভবতঃ আধঘণ্টা আগে। তাই বাড়ি ফিরে এলাম ছুটতে ছুটতে। এরবেশী সে কিছু বললনা র‍্যাচেলকে।

‘আমি অসুস্থ তোমার মতই’ র‍্যাচেল বলে উঠল। তাদের দু’জনের মধ্যে সমঝোতা আছে একটা যে রিচার্ডকে সুস্থ থাকতেই হবে র‍্যাচেল অসুস্থ হলে।
‘তুমি অসুস্থ নও’ একথা বলেই রিচার্ড মুর্ছা গেল।

র‍্যাচেল ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল তাকে কোনরকমে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে। গন্ধ নাকে এল কফি ও শুকরের মাংসের। র‍্যাচেল ভারী খুশী হল প্রাতঃরাশের ঝঞ্ঝাট এড়াতে পেরে।
তার ফলে বিচলিত হয়ে সে চার্লসকে ধন্যবাদ দিল এবং তাকে, লক্ষ্মী বলে সম্বোধন করল। গম্ভীর ভাবে চার্লস চুম্বন করে তার হাতটা চেপে ধরল। চার্লস ট্রেতে করে প্রাতঃরাশ নিয়ে হাজির হল। র‍্যাচেলের পছন্দ মতোই ট্রেম্পনি লাস্ট ফর ডেথ ফের হয়েছে ডমটাকে ভেজেছে দুদিকেই এবং কফিটাও কড়া হয়েছে।

র‍্যাচেল চার্লসের প্রেমে পড়ে গেল। সে অনেকবার প্রেমে পড়েছে, সেটা কিন্তু বিয়ের পর র‍্যাচেল এবং রিচার্ড এ ধরনের ঘটনা ঘটলে পরস্পরকে বলে দেয়। তাতে কোনো ইর্ষার সৃষ্টি হয় না যদিও মনের অবরুদ্ধ আবেগ প্রকাশিত হতে পারে। কারণ র‍্যাচেল বলে (পূর্ণ স্বাধীনতা আছে রিচার্ডের এ ব্যাপারে) ‘অমুকের প্রেমে পড়লেও আমি কেবল তোমাকেই ভালবাসি।’ যদিও অতীতে এরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে কিন্তু এবারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। সে রিচার্ডকে আর ভালবাসে না তাই চার্লসের প্রেমে যে সে পড়েছে তা রিচার্ডকে বলতে পারল না। রিচার্ডকে মুখে বলে ‘অলস অকর্মন্য’ এবং সে ঘৃণা কবে রিচার্ডকে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকার জন্য। রিচার্ড উঠে বসল দুপুর নাগাদ, শোবার ঘরেই ঘুরতে লাগল। র‍্যাচেল এসে তাকে বিছানায় পাঠিয়ে দিয়ে গেল শেষ পর্যন্ত।

র‍্যাচেলকে সাহায্য করে চার্লস, সব রান্না অবধি করে দেয়। রিচার্ডকে যেহেতু ওপরে উঠতে বলা হয়নি তাই সে ওপরে ওঠে না। রিচার্ড চার্লসকে ফেলে পালিয়ে এসেছে বলে র‍্যাচেল লজ্জা পেয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। চার্লস বলেছে সে এটাকে অপমান বলে মনে করেনি। তার কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছে এই সকালটা। বাতাসে কি এক অদ্ভুত শক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল যখন তারা বালিয়াড়িতে গিয়ে পৌঁছল। একই ধরনের অনুভূতি তার হয়েছিল একথা র‍্যাচেলও বলেছিল। একথা পরে সে শুনল ল্যাম্পটনও সেই একই কথা বলে বেড়াচ্ছে।

পরে সে শুনল যে একটা মৃদু ভূকম্প হয়েছে একথা ডাক্তার বলেছে কিন্তু শয়তান এই পথে চলে বেড়াচ্ছে একথা গ্রামের লোকেরা বলছে। শয়তান এসেছিল শিকাররক্ষক সলমন মোন্স এর কালো আত্মাকেই নিয়ে যেতে, তার নিজের ঘরেই এই সকালেই তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তার বালিয়াড়ির পাশে।

র‍্যাচেল রিচার্ডকে মুচির কাছে পাঠাল জুতোর বক্লস আনতে যখন রিচার্ডের একটু হাঁটার ক্ষমতা হয়েছিল। সে বাগানের নীচে পর্যন্ত গেল স্বামীর সঙ্গে। রাস্তাটা চলে গেছে তার খাড়া তাঁর বরাবর। রিচার্ড অসুস্থ বোধ করল এবং সে হাঁটতে হাঁটতে গোঙাতে লাগল। র‍্যাচেল কিছুটা বেগে এবং কিছুটা তামাশা করে তার স্বামীকে ঠেলে দিল। সে উপুড় হয়ে পড়ে গেল কাঁটা ঝোপ এবং পুরনো লোহার মধ্যে। হো হো করে হেসে দৌড়ে র‍্যাচেল আবার বাড়িতে ফিরে গেল। রিচার্ড দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁটা ঝোপের ভেতর থেকে জুতো বের করে উঠে দাঁড়াল। তারপর প্রথমে ফটকটা পেরোল এবং তারপর তাঁর বেয়ে প্রচণ্ড বোদ্দুরের মধ্যে হাঁটতে লাগল।

ধপাস্ করে বসে পড়ল মুচির বাড়িতে পৌঁছে গিয়ে। মুচি খুশি হল তাকে দেখে এবং এও বলল যে খুব খারাপ লাগছে তোমাকে।
রিচার্ড বলল : ঠিক কথাই। শুক্রবার সকালে একটু মাথা ঘুরে গেছে, একটু ভাল আছি এখন। গলা ছেড়ে বলে উঠল মুচি, ‘তোমার মাথা ঘুরেছিল, আর আমার কেউ যেন ছাল চামড়া ছাড়িয়ে নিচ্ছে বলে মনে হয়েছিল। যে রকম লোকে একটা পাথর নিয়ে করে সেরকম আমার আত্মাকে নিয়ে কেউ যেন লোফালুফি করছিল। ছুঁড়ে ফেলে দিল তারপরই আমাকে। আমি কোনোদিন ভুলব না গত শুক্রবারের সকালটায় কথা।’

মুচির কথা শুনে রিচার্ডের মাথায় অদ্ভুত একটা ধারণা ঢুকল। পাথরের মত তবে কি মুচির আত্মাকেই সে নাড়াচাড়া করেছিল? সে ভাবল : ল্যাম্পটনের প্রতিটি পুরুষ, নারী এবং শিশুর আত্মাই সেখানে হয়তো পাথর হয়ে গিয়েছিল।’ সে একটা বলস নিয়ে বাড়ি চলে গেল মুচিকে কিছু না বলেই।
বাড়িতে কোনো সুখ নেই কারণ পাকাপাকি ভাবে বসে গেছে চার্লস। তাই এতে কিছুই বলার নেই।

র‍্যাচেল যখন স্বামীকে গালাগালি দেয় তখন চার্লস র‍্যাচেলের পক্ষই নেয় কারণ কঠোর পরিশ্রমী এবং মৃদুভাষী চার্লস। র‍্যাচেল তার কোন প্রতিবাদ করে না এবং সেটাই সবচেয়ে দুঃখজনক।
ক্রলি বলল, ‘হাসির খোরাক হবে গল্পের বাকি অংশটুকু। রিচার্ড বালিয়াড়ির পাথরের স্তূপের মধ্যে ডাক্তার ও রেক্টরের আত্মা দুটিকে চিহ্নিত করল। হুইস্কির বোতলের মত গড়ন অনেকটা ডাক্তারের আত্মা আর আদিম পাপের মতই কালো র‍্যাচেলের আত্মা। তার ধারণা কল্পনামাত্র নয়, এইভাবেই সে প্রমাণ করে দিল। এইসব বিবরণের মধ্যে আর গেলাম না। রিচার্ডকে র‍্যাচেল আবার ভালবাসতে শুরু করে দিল আগের মতই।

চার্লস বাড়ি গেছে, সে যে কোথায় গেছে, তা কিন্তু কেউ জানে না।
রিচার্ড সুস্থ হল দু-একদিনের মধ্যেই, আবার আগের মত চলতে লাগল সবকিছু। একদিন বিকালে হঠাৎ দরজায় চার্লসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
সে ঘরে ঢুকল, কোনো কথা না বলে টুপিটাকে ঝুলিয়ে রাখল সে পেরেকের সঙ্গে।
‘রাতের খাবার কখন তৈরী হবে?

র‍্যাচেলের দিকে রিচার্ড তাকিয়ে বুঝল যে র‍্যাচেল মজে গেছে এই লোকটাকে দেখেই। সে বলে উঠল : ঠিক আটটায় রাতের খাবার তৈরী হবে। রিচার্ডের একজোড়া চটি র‍্যাচেল এগিয়ে দিল রিচার্ডের কাদামাখা জুতো জোড়া খুলে দিয়ে।
চার্লস বলে উঠল : ‘এখন সাতটা বাজে ঠিক আছে আর একঘণ্টা বাদেই রাতের খাবার প্রস্তুত হবে। অগ্নিকুণ্ডের লোকটি নটার সময় সান্ধ্য পত্রিকা দিয়ে গেল। দশটার সময় আমি আর তুমি
এক সঙ্গে ঘুমাব র‍্যাচেল।

চার্লসের মনে হল রিচার্ড যেন হঠাৎ পাগল হয়ে গেছে। র‍্যাচেল শান্ত গলায় জবাব দিল। ‘নিশ্চয় নিশ্চয়’। র‍্যাচেল রিচার্ডের গালে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিল এবং তারপর বলে উঠল, ‘দূর হয়ে যাও তুমি এখান থেকে বেঁটে মানুষ।

রিচার্ড হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল এবং গালে হাত বুলোতে লাগল। সে নিজে নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছে একথা বিশ্বাস হল কিন্তু চার্লস পাগল হয়ে গেছে একথা তার কিছুতেই বিশ্বাস হল না। রিচার্ড এবং র‍্যাচেলের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি আছে যে কোনো একজন যদি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চায় তবে অপরজন তাতে বাধা দেবে না। তারা জীবনে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে। অনুষ্ঠানের চাইতে ভালবাসার বন্ধনকেই যথাসাধ্য বেঁধে রাখা শান্ত গলায় রিচার্ড বলে উঠল। ‘আমি তোমাদের দু’জনকে একত্রে রেখে চলে যাব র‍্যাচেল।’

রিচার্ডের দিকে এক পাটি বুট ছুঁড়ে চার্লস বলে উঠল এক হুংকারে তোমায় কান দুটোতে ছিড়ে ফেলব। তুমি প্রাতঃরাশের সময় পর্যন্ত এ ব্যাপারে নাক গলাবে না ।
পরিষ্কার মাথায়, শান্ত চিত্তে, ভয় নেই এরকম ভাব দেখিয়ে রিচার্ড বেরিয়ে গেল। গলিপথ ধরে সে মাঠে নেমে এল ফটক পার হয়ে। এখনও তিন ঘণ্টা বাকী রয়ে গেছে সূর্যাস্তের। ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে স্কুলের মাঠে। হাসি ঠাট্টা করল প্রথমে তাদের সঙ্গে এবং এরপর র‍্যাচেলের কথা মনে পড়তেই চোখে জল এসে গেল তার। তারপর সে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে আমার মন্দ ভাগ্য, আমি পাগল হয়ে গেছি।

পাথরগুলির কাছে শেষ পর্যন্ত সে এল। সে পাথরগুলিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, আমার আত্মাকে আমি এই পাথরের টুকরোর মধ্যে থেকে খুঁজে বের করব এবং তারপর হাতুড়ি দিয়ে সেটাকে একশোটা টুকরো করে দেব। কারণ তার সঙ্গে তার হাতুড়িটা ছিল। এটাকে সে নিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে বেরোবার সময়।

নিজের আত্মাকে সে খুঁজতে লাগল এবার। নিজের আত্মাকে কেউ চিনতে পারে না যদিও অন্য স্ত্রী এবং পুরুষের আত্মাকে চেনা যায়। রিচার্ড নিজের আত্মাকে চিনতে পারল না কিন্তু র‍্যাচেলের আত্মাকে দেখেই চিনতে পারল (সবুজ পাথর যেটি স্ফটিক খচিত)। গায়ে তার লেগে রয়েছে আরও একটি পাথর যার রঙ বাদামী এবং কুৎসিত গড়নের ও গায়ে ফুটকি ফুটকি রয়েছে। রিচার্ড প্রতিজ্ঞা করল, ‘এটা নিশ্চয় চার্লসের আত্মা এবং এটাকে আমি ধ্বংস করব। সে তার দুটি ঠোটেই চুমো খেল র‍্যাচেলের আত্মাকে।

হাতুড়িটা তুলে সে চার্লসের আত্মাকে বলল, ‘এটাকে আমি ভেঙে পঞ্চাশটা টুকরো করে ফেলব।
তার মনে খটকা লাগল তাই সে থেমে গেল। র‍্যাচেলের ভালবাসাকে সে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য কারণ র‍্যাচেল তার চাইতেও বেশী ভালবাসে চার্লসকে। চার্লসের পাথরের পাশেই পড়েছিল একটি তৃতীয় পাথর। (তার নিজের আত্মা নিশ্চয়ই এটি)। একটা ক্রিকেট বলের মত বড় মসৃণ ধূসর গ্রানাইট পাথর। সে নিজের মনেই বলে উঠল, টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলব আমি আমার নিজের আত্মাকে, আমার অবসান তাহলেই হবে।’ চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল এবং পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল তার চোখের সামনে। তার মূর্ছিত হবার মত অবস্থা হল, সে সামলে নিয়ে তীব্র চীৎকার করল প্রথম এবং তার পর কয়লা ভাঙা হাতুড়ি দিয়ে ধূসর পাথরটার ওপরে আঘাতের পর আঘাত করতে লাগল।

পাথরটা চার টুকরো হয়ে তা থেকে বারুদের মত গন্ধ বেরোতে লাগল, রিচার্ড হো হো করে হেসে উঠল যখন দেখল যে সে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। সে পাগল হয়ে গেল একেবারে পাগল, হাসির পর হাসি হাসতে লাগল, সে ক্লান্ত দেহে বসে পড়ল একসময় হাতুড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এবং তারপর সে ঘুমিয়ে পড়ল।
সে যখন জাগল সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সে ভাবতে লাগল বাড়ি যেতে যেতে ‘র‍্যাচেল নিশ্চয় আমাকে এই খারাপ স্বপ্ন থেকে উদ্ধার করতে পারবে।’

ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে একদল লোক কথা বলছে উত্তেজিতভাবে। সে শহরের প্রান্তে যখন পৌঁছল তখন দেখল, একজন এদের মধ্যে বলছে, ‘আটটা নাগাদ এই ঘটনাটা ঘটেছে।’ হ্যাঁ তাই-তাই আর একজন বলছে। ‘বদ্ধ পাগল ও’ তৃতীয়জন বলে উঠল। সে বলে, ‘আমাকে ছুঁলেই আমি হুংকার দিয়ে উঠব এবং আমি যদি আরেকবার হুংকার দিই তাহলে গোটা পুলিশ বাহিনীই অজ্ঞান হয়ে যাবে। তোমরা পাগল হয়ে যাবে আমার হুংকার শুনে।’ ইন্সপেক্টর বলে উঠল, ‘তোমাকে এতদিনে বাগে পেয়েছি ক্রসলি, তুমি এবার তোমার হাত দুটি তোল। তখন সে বলল, ‘এই একটা শেষ সুযোগ, আমাকে এখানে রেখে চলে যাও, নইলে আমি তোমাদের মেরে কাঠ বানিয়ে দেব এক হুংকারে।’

রিচার্ড দাঁড়িয়ে পড়েছিল তাদের কথাবার্তা শুনে। সে বলে উঠল, ‘সেই নারী কি বলল এবং ক্রলিরই বা কি হল।’ ইন্সপেক্টরকে বলল, সেই নারী, ‘আপনি চলে যান খ্রীষ্টের দোহাই, আপনাকেও মেরে ফেলবে নইলে।’
‘কি হুংকার আর দিল লোকটি।’

‘কোনো হুংকার সে দেয়নি। সে কেবল মুখটা কুঁচকে শ্বাস টেনেছে মুহূর্তের জন্য। জীবনে এরকম মুখ আমি দেখিনি হে পরমেশ্বর। তিন চার পেগ ব্রান্ডি খেতে হয়েছিল পরে আমাকে। গুলি করল ইন্সপেক্টর রিভলবার বাড়িয়ে কিন্তু গুলি কারোর গায়েই বিধল না। হঠাৎ একটা পরিবর্তন দেখা দিল ক্রসলি নামক লোকটির মধ্যে। সে বুকের উপর সশব্দে হাত রাখল। চকচক করতে লাগল মুখটি। সে হাসতে শুরু করল প্রথমে এবং তারপর নাচতে শুরু করল সে। এবং নানারকম অঙ্গভঙ্গী করতে লাগল সে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল স্ত্রীলোকটি বিশ্বাস করতে পারছিল না সে নিজের চোখকেই। তাকে নিয়ে চলে গেল পুলিশটি। যদি লোকটি একেবারে শান্তশিষ্ট এবং নিরীহ ছিল পাগলও সে হয়ে থাকে। পুলিশকে কোনোরকম ঝামেলাই পোহাতে হয়নি তাকে নিয়ে। তাকে রাজকীয় পশ্চিমাঞ্চলে উন্মাদ আশ্রমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

বাড়ি ফিরে গেল রিচার্ড। যদিও বেশী কিছু বলার ছিল না তবুও র‍্যাচেল এবং সে কল বলতে শুরু করল।
স্ত্রী বলল, ‘সে রিচার্ডকে বিরক্ত করার জন্যই করেছিল, সে আসলে চার্লসের প্রেমে পড়েনি । সে চার্লসকে কিছু বলতে শোনেনি এবং নিজেও কিছু বলেনি। স্বপ্ন তার সবটাই। স্বামীকে সে চিরদিনই ভালবেসেছে যদিও তার স্বামীর কিছু দোষ ত্রুটি রয়েছে। তার অন্য কোনো দোষ নেই, তবে তার কৃপণতা, বাচালতা আর অপরিচ্ছন্নতা আছে। চুপচাপ রাতের খাবারও খেয়েছিল চার্লস।

যখন সে তাকে নাচতে ডাকছিল এবং তার সঙ্গে খুনসুটি করছিল ঠিক তখনই দরজায় একটি টোকা পড়ল। চীৎকার করে বলল ইন্সপেক্টর, ওয়ান্টার চার্লস ক্রলি, আমি তোমাকে গ্রেফতার করছি। জর্জ গ্রান্ট, হ্যারি গ্রান্ট ও আভা কোলম্যানকে খুন করার প্রতিবাদে। বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে চার্লস। জুতোর বলস গকেট থেকে বের করে বলে উঠল, ‘এই নারীকে বেঁধে রাখ আমার হয়ে। পুলিশকে যেতে বলল তারপর। যদি পুলিশ না যায় তবে সে তাদের হুংকার দিয়ে মেরে ফেলবে। তারপর টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল ভয়ঙ্করভাবে মুখ ভেংচে উঠে। ‘খুব ভাল ছিল কিন্তু লোকটি, আমার বড় ভাল লেগেছিল। আমার ওর জন্য বড় দুঃখ হয়।

ক্রসলি শুধোলো, আপনার কি ভাল লেগেছে গল্পটা।’
রান লিখতে তখন ব্যস্ত আমি, লিখতে লিখতেই জবাব দিলাম আমি, ‘একটি সেরা মাইলেসীয় গল্প এটি, আপনাকে অভিনন্দন জানাই লুসিয়াস এপুলিয়াস।’ আমার দিকে ক্ষুব্ধ মুখে ঘুরে বসলেন ক্রসলি। কাপছে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটি। তিনি বললেন, প্রতি শব্দটাই এর সত্যি। আমি পাগল হয়ে গেলাম আর ক্রলির আত্মা চারটুকরো হয়ে গেল। একটা হুংকারের ক্ষমতাই শুধু এখন আমার আছে।’
কালো মেঘ কখন যে সূর্যকে ঢেকে অন্ধকার করে ফেলেছে তা আমি জানতেই পারিনি কারণ রান লিখতে তখন আমি এতই ব্যস্ত ছিলাম। একটা বিদ্যুৎ চমক ঝলসে দিল এবং কানে এল বজ্রের হুংকার।

সব গোলমাল হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। বৃষ্টি নামল মুষলধারে, আশ্রয়ের জন্য ছুটোছুটি করতে লাগল খেলোয়াড়রা। চীৎকার চেঁচামেচি করতে করতে পাগলরা শুরু করে দিল লড়াই। সেই বি. সি. ব্রাউন যে ছিল ঢ্যাঙা যুবক সে তার সমস্ত পোশাক খুলে ফেলে দিল এবং উলঙ্গ হয়ে গেল। দাড়িওয়ালা একটি যুবক বজ্রের মত প্রার্থনা আরম্ভ করল, সে ছিল স্কোরিং বক্স-এর বাইরে।
সে শুরু করে দিল তৎক্ষণাৎ ‘ব্যা ব্যা’।

চোখ দুটি সগর্বে ঘুরতে লাগল ক্রসলির। আঙুল বাড়িয়ে বললেন, আকাশের দিকে, ‘হুংকারটা ঠিক এই রকম।’ হঠাৎ মুখটা নামিয়ে নিলেন তিনি এবং তার মুখে একটা শিশুসুলভ দুঃখ এবং বিরক্তি দেখা দিল। তিনি ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘ক্রসলি আবার হুংকার দেবে আমাকে লক্ষ্য, করে জমিয়ে ছাড়বে আমার মজ্জা পর্যন্ত।’
তার কথা আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। কারণ টিনের ছাদের উপর বৃষ্টি এত জোরে পড়ছিল আরো জোরে, আবার একটি বিদ্যুতের ঝিলিক দিল। বজ্রের হুংকার একটি। কানে কানে বললেন তিনি আমার, ‘দ্বিতীয় ডিগ্রীর হুংকার তো এটি। প্রথম ডিগ্রী হুংকারেই আমি কেবলমাত্র মানুষ খুন করতে পারি।’
আরও বললেন তিনি, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না।’ বোকার মত হাসলেন তিনি। ‘আমিই রিচার্ড এখন আর ক্রস্‌লি আমাকে খুন করবে।’

দুই হাতে ক্রিকেট স্টাম্প ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটছে আর চেঁচাচ্ছে লোকটি, এক কুৎসিত দৃশ্য সেটি, সে কেবলই চীৎকার করছে ‘বা বা বা’ এবং তার পিঠে জল গড়িয়ে পড়ছে বুড়োর উল্টোনো টুপি থেকে।
‘সব বাজে কথা’ আমি বললাম। ক্রলি ‘আপনি মনে রাখবেন, মনে সাহস আনুন আপনি, সমানে লড়তে পারেন একডজন রিচার্ডের সঙ্গে। রিচার্ডের ভাগ্য ভাল ছিল বলে আপনি একবার হেরেছেন, এখন আপনার আয়ত্তে হুংকার আছে।

কেমন যেন পাগল পাগল বলে আমার মনে হচ্ছিল নিজেকে। স্কোরিং বক্সে ছুটে এসে ঢুকলেন পাগলা গারদের ডাক্তার। জল ঝরছে তাঁর ফ্লানেলের পোশাক থেকে। প্যাড আর ব্যাটিং গ্লাভস রয়েছে তাঁর পরনে। কোথায় ছিটকে পড়ে গেছে তাঁর চশমা। কানে গিয়েছিল তিনি হুকুম দিলেন, ‘ক্রলির হাত দুটো জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে, ‘এখুনি তোমার ডমিটারিতে চলে যাও ব্রুলি।’ সগর্বে বললেন ক্রলি, ‘যাব না আমি, সাপ ও আপেলওয়ালা মানুষ তবে রে।’ তাকে ঠেলে বের করে দিতে চেষ্টা করল ডাক্তার তার কোটটা চেপে ধরে।

এক ধাক্কায় তাকে ফেলে দিলেন ক্রল। চোখ দুটি জ্বলছে তার। ‘যাও বেরিয়ে যাও, একা থাকতে দাও আমাকে, আমি হুংকার দিয়ে উঠব নইলে। শুনতে পাচ্ছ হুংকার দেব আমি। সবাইকে মেরে ফেলব তোমাদের। পাগলা গারদটাই ভেঙে পড়বে আমার হুংকারে। আমি হুংকার দেব, সব ঘাম শুকিয়ে যাবে।’ তার মুখটা বেঁকে যেতে লাগল তীব্র ত্রাসে। একটা লাল দাগ ফুটে উঠল চোয়ালের উপর এবং ক্রমশঃ তা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

স্কোরিং বক্স থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলাম দুই কানে আঙুল ঢুকিয়ে। যেই আমি বিশ গজ ছুটেছি একটা আগুনের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা আমাকে তালগোল পাকিয়ে দিল।
অবশ দেহে দাঁড়িয়ে রইলাম বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে। মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম কোনো মতে। আমার ভাগ্যটা গল্পের রিচার্ডের মতই ভাল। ক্রলি এবং ডাক্তার দু’জনেই মারা
গেলেন সেই বিদ্যুতের স্পর্শে।

ডাক্তারের শরীরটা এককোণে গুঁড়ি মেরে পড়েছিল। তার কান ঢাকা ছিল দুই হাতে। কেউ বুঝতে পারল না ব্যাপারটা। তাদের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতের সঙ্গেই। কানে আঙুল দেবার মত লোক ডাক্তার নন বজ্রের হুংকার শুনে।

মোটেই সন্তোষজনক নয় এই গল্পের উপসংহারটুকু। র‍্যাচেল ও রিচার্ড এই দুই বন্ধুর বাড়িতে ‘আমি উঠেছিলাম। এবং খুবই সঠিক বিবরণ ক্রলি তাদের দিয়েছিল। তাদের বললাম পরে, যখন বজ্রাহত হন তাদের বন্ধু সেই ডাক্তারটি, একইভাবে বজ্রাহত হয়ে মারা গেছে তখন চার্লস ক্রলি। তাঁরা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করেছিল ক্রসলির মৃত্যুটিকে। উদাস দৃষ্টি রিচার্ডের। র‍্যাচেল বলে উঠল, ‘আমার ধারণা ক্রলি একজন অষ্ট্রেলীয় যাদুকর বলে পরিচয় দিয়ে কিছু যাদুর খেলা দেখিয়েছিল, বেশী যন্ত্রপাতি ছিল না একখানা কালো রেশমী রুমাল ছাড়া। আমার খুব ভাল লেগেছিল তার মুখটা, কিন্তু আহারে’ তাকে মোটেই ভালো লাগেনি রিচার্ডের।’
‘আমি মোটেই বরদাস্ত করিনি লোকটা সারাক্ষণ যেভাবে তোমার দিকে তাকিয়েছিল, ‘ রিচার্ড বলে উঠল।

download any banglabookspdf here

Be the first to comment

Leave a Reply