Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প সঙ্কলন pdf

Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প সঙ্কলন pdf
Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প সঙ্কলন pdf

মহাশ্বেতা দেবীর দশটি বাছাই করা গল্প নিয়ে সংকলিত মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প সঙ্কলন pdf Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf ডাউনলোড করুন ও পড়ুন।

Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প সঙ্কলন pdf
Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প সঙ্কলন pdf

Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf  মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প সঙ্কলন pdf সূচীপত্র

ভূমিকা
বান
বিছন দ্রৌপদী
রং নাম্বার
শিকার
সাঁঝ-সকালের মা
বাঁয়েন
বেহুলা
মৌল অধিকার ও ভিখারী দুসাদ

Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf ভূমিকা

1984 সালে প্রকাশিত তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’-এর ভূমিকায় মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন, ‘সাহিত্যকে শুধু ভাষা, শৈলী, আঙ্গিক নিরিখে বিচার করার মানদণ্ডটি ভুল। সাহিত্য বিচার ইতিহাস প্রেক্ষিতে হওয়া দরকার। লেখকের লেখার সময় ও ইতিহাসের প্রেক্ষিত মাথায় না রাখলে কোনো লেখককেই, মূল্যায়ন করা যায় না। পুরাকথাকে, পৌরাণিক চরিত্র ও ঘটনাকে আমি বর্তমানের প্রেক্ষিতে ফিরিয়ে এনে ব্যবহার করি অতীত ও বর্তমান যে লোকবৃত্তে আসলে অবিচ্ছিন্ন ধারায় গ্রথিত তাই বলার জন্য।’ এই ‘অবিচ্ছিন্ন ধারাটি ও বায়বীয় কিছু নয়, বরং জাতপাত, জমিজঙ্গলের অধিকার, এবং সর্বোপরি ক্ষমতাসীন শ্রেণীর ক্ষমতার আস্ফালনের তথা কায়েম রাখার পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে নিম্নবর্গীয় মানুষের শোষণের ক্রমান্বয়িক ইতিহাস।

বোতামঘর pdf – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী Botamghar pdf – Smaranjit Chakraborty

তাঁর এই নতুন সংকলনটির জন্য লেখিকা যে গল্পগুলি বেছেছেন তার ন’টির মধ্যে আটটির কেন্দ্রে রয়েছে অন্তেবাসী মানুষ যারা সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, সংস্কার তথা ইতিহাসের শাসনেই নির্বাসিত। এই গল্পগুলিতে এরা কখনো তথাকথিত নিচু জাত, কখনও বা অন্ত্যজ উপজাতিক। এদেশে অর্থনৈতিক শোষণ বহুদিন ধরে ধর্মীয় সংস্কারের মায়াজাল বিস্তার করে তার আড়াল থেকে অব্যর্থ শরক্ষেপ করেছে। এইভাবেই শোষণ লোকবৃত্ত-পুরাকথাকে আশ্রয় করে শোষিতদের মায়াবি অন্ধকারে আচ্ছন্ন করতে সমর্থ হয়েছে। অন্তেবাসীদের মধ্যে লোকবিশ্বাসের এই ভয়ংকর পিছুটান মহাশ্বেতা দেবীকে একটু বিশেষভাবেই চিন্তিত করে।

নিজের লেখা গল্পে যে-সমাজকে তিনি চিত্রিত করতে ক্রমশই আরো আগ্রহী হয়েছেন, তাদের জীবনতথ্য ও ইতিহাসের সন্ধানে যতই তাদের কাছে গেছেন ততই তাদের জীবন-জীবিকা-অধিকারের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন, সেই সমাজের সংস্কৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সূত্রেই তিনি দেখেছেন ও জেনেছেন এই বিশ্বাসের জগৎ। এই বিশ্বাসে যে-গৌরববোধ, সেই গৌরববোধই হয়ে ওঠে দাসত্বশৃঙ্খল, বঞ্চনাকে আশীর্বাদ বলে মেনে নেবার যুক্তি। মিথ বা পুরাকথা অতিকথাকে রমণীয় করে দেখানোর যে প্রবণতা এদেশে অদ্ভুত এক অনৈতিহাসিকতাকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে, কখনো বা আপাত মার্কসীয় ঢঙে তাকে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের বিবাদী অন্য উত্তরাধিকার রূপে সমাদর করছে, এবং যার ধোঁয়াটে ঐতিহ্যবিলাসের আড়ালে চোরাপথে জায়গা গুছিয়ে বসছে এক রাজনৈতিক হিন্দুত্ব, তারই মূলে আঘাত করেছেন মহাশ্বেতা দেবী।

এই গল্পগুলিতে যে অন্তেবাসী সমাজ বা সম্প্রদায়গুলিকে চেনা যায় তাদের মধ্যে আছে বাগদি (‘বান’), ডোম (‘বাঁয়েন’), পাখমারা (‘সাঁঝ-সকালের মা’), ওঁরাও (‘শিকার’), গঞ্জু (‘বিছন’) দুসাদ (‘মৌল অধিকার ও ভিখারী দুসাদ’), মাল বা ওঝা (‘বেহুলা’), সাঁওতাল (‘দ্রৌপদী’)। এদের মধ্যে ‘গজ্জুদের কাজ মৃত পশুর চামড়া ছোলা’, ভিখারী দুসাদের জীবিকা ‘ঘুরে ঘুরে ছাগল চরানো’, বাঁয়েন হয়ে যাবার আগে চণ্ডীর ‘বংশগত উত্তরাধিকার’ ছিল ‘কাঁচা ভাগাড়ের কাজ’। এই যে জীবিকা বা বংশগত উত্তরাধিকার এই এক একটি সমাজকে বংশানুক্রমে অন্তেবাসী করে রেখে দেয়, তাকে ঘিরে যেন বা সংস্কারের শাসনকেই অনম্ভ করে রাখার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এক একটি পুরাকথা। পাখমারারা ‘জরা-ব্যাধের বংশধর, ডোমেরা সেই আদিম গঙ্গাপুত্রের সন্ততি যে হরিশচন্দ্রের কাছে পৃথিবীর সকল শ্মশান ভিক্ষা পেয়ে নির্বোধ আনন্দে ‘দুই হাত তুলে ভীষণ নেচেছিল।

উল্লাসে বলেছিল, ‘হাঁ, মোরা শ্মশান পেয়েছি গো, সকল শ্মশান পেয়েছি। এ পিথিবীর সকল শ্মশান মোদের।’ পুরাকথাকে কেবলমাত্র স্মৃতি বা উপাখ্যানের শ্রুতি মাত্রায় আবদ্ধ না রেখে মহাশ্বেতা দেবী যখন তাকে নাটকীয় মাত্রার বিরাটত্ব দেন, ঐ পৌরাণিক বিস্তারই তখন যুগপৎ ধর্মের ছল তথা ছলনা ও তার মায়াজালের নাগপাশকে মূর্ত করে, অন্তেবাসীকে ইতিহাসের পটের সামনে দাঁড় করায় উচ্চতর বর্গের শঠতার নির্বোধ শিকার হিসেবে। এইভাবেই ইতিহাসের সাজানো বিন্যাসে ফাটল ধরিয়ে তিনি অন্য এক ইতিহাস উন্মোচন করেন – গল্প বলার বিশেষ শৈলী বা কারিগরিকে যেন এক বিশেষ ভাষা রূপে কাজে লাগিয়েই। Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf ডাউনলোড করুন ও পড়ুন।

এদিকে কিন্তু অনেক কিছু পালটায় আর্থ-সামাজিক স্তরে। মলিন্দর গঙ্গাপুত্র শ্মশানের ডোম থেকে ‘মহকুমার লাশঘরে কাজ পেয়েছে।’ সরকারবাবুর সঙ্গে যোগসাজশে সে বেওয়ারিশ মড়ার খুলি- হাড়-কঙ্কাল বেচার ব্যবসায়ে লিপ্ত, সেই চোরা পথে পাওয়া ‘উপরি টাকা সুদে খাটিয়ে সে কয়েকটা শুয়োরও কিনেছে। তবুও তার বিশ্বাসের সংস্কার পালটায় না। নিজের স্ত্রীকে বাঁয়েন বলে চিহ্নিত করে সমাজের বার করে দিতে তার বাধে না। মহাশ্বেতা দেবীর ‘বাঁয়েন’ গল্পের সবচেয়ে যন্ত্রণার জায়গা এইখানেই। যারা নিজেরা ভদ্র সমাজ থেকে নির্বাসিত তারাই আবার নিজেদের একজনকে নিজেদের সমাজ থেকে বার করে দেয়। মনুষ্য সমাজের প্রান্তদেশে যাদের অবস্থান, তারা যখন কাউকে বার করে দেয়, সেই নির্বাসিতা যেন মনুষ্যেতর শ্রেণীতে গিয়ে পড়ে, নিজেও সেই জায়গাটা মেনে নেয়।

চণ্ডী তাই মানুষ নয়, বাঁয়েন। মলিন্দর ছেলে ভগীরথকে বলে, ‘আগে মানুষ ছিল, তোর মা ছিল।’ সংস্কারের সঙ্গে প্রচ্ছন্ন অনির্বাণ মানবতার দ্বন্দ্ব কখনোই নিঃশেষ হয় না। তাই বাঁয়েন চণ্ডীরও ‘হঠাৎ মানুষের বউয়ের মতো অবিবেচক মলিন্দরের ওপর রাগ হয়। এই গল্প অন্য বাঁক নেয় তখনই যখন আধুনিক মানসিকতার প্রতিভূ হয়েই ভগীরথ তার মায়ের কাছে পৌঁছবার চেষ্টা করে, যখন সে চণ্ডীকে কিছুতেই আর মানুষ না ভেবে অন্য কিছু ভাবতে পারে না। চণ্ডীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পুত্র ভগীরথ যেন সমাজবিচ্ছিন্না এই মহিলাকে আবার টেনে আনে সমাজের দায়দায়িত্বের মধ্যে। প্রথমে ‘টোকাটাকে’ সামলাবার দায়িত্ব থেকেই অবলীলায় অনিবার্যভাবেই চণ্ডী পৌঁছে যায় ট্রেনযাত্রীদের বিপুলতর সমাজকে রক্ষা করার দায়বোধে।

একটা পবিত্র ভয়ে যে সমাজ একদা চণ্ডীকে বাঁয়েন ঘোষণা করেছিল, চণ্ডী তার নতুন প্রতিরোধী ভূমিকায় সেই পবিত্র ভয়ই ধরায় সামাজিক ডাকাতদের মনে। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এই সূত্রগুলিই মহাশ্বেতা দেবীর গল্পের প্রাণ। ‘ওর সমাজের মানুষদের এত ভয় পেতে বাঁয়েন কোনোদিন দেখেনি।’ সমাজের বাইরে নির্বাসিত জীবন যাপনের জমাট যন্ত্রণা নবোম্মেষিত মানবতাবোধের দাহে প্রজ্বলন্ত হয়ে উঠে সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বিবেকের রূপ পায়। আধুনিক ইয়োরোপীয় কথাসাহিত্যে সুপরিচিত বহিঃস্থ মানুষের ভূমিকা এখানে অন্য এক মাত্রায় সঞ্জীবিত হয়। সমাজের অবিচারই চণ্ডী বাঁয়েনকে এই শক্তি দিয়েছে সেই অবিচারেরই আরেক প্রকাশকে প্রতিহত করতে। চণ্ডীর এই প্রবল নৈতিক আত্মঘোষণা চণ্ডীকে ফিরিয়ে আনে তার সমাজে।

ভগীরথ যখন রাষ্ট্রের কাছে, প্রশাসনের কাছে তার বংশপরিচয় দেয়, নিজেকে চণ্ডী বাঁয়েনের সন্তান বলে পরিচয় দেয়, সেই নাটকীয় ক্ষণটি হয়েওঠে গল্পের তুঙ্গমুহূর্ত, পুরাকথাসম কোনো পুনর্জন্ম যেন। সংস্কারের পাথরভার ফেলে দিয়ে আধুনিক মানসিকতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের আরেকটি ছবি ‘বেহুলা’ গল্পে। এখানে বহিঃস্থ সংস্কারকের দায় নিয়ে আসে বসন্ত কুমার। এখানে পুরনো সংস্কারের ধারক শ্রীপদ মাল‘এ অঞ্চলে সাপের ওঝা, উইচ-ডক্টর।’ কিন্তু যেখানে মুনাফার হিসেব মৃত্যুকে লালন করে (একদিকে হেদো নস্কর ঠিক দাম না পেলে ইঁটের পাঁজা বেচবে না, আর সেই ইঁটের পাঁজায় সর্পকুল বংশবৃদ্ধি করে যাবে; অন্যদিকে ‘সর্পদংশন কোনো ওষুধ কোম্পানিকে আগ্রহী করতে পারে না, কেননা সাপ কামড়ায় চার লাখ মানুষকে, মরে হাজার বিশেক’), সেখানে বসন্ত শ্রীপদের মধ্যে গভীর সহযোগ গড়েওঠে, শিক্ষার স্বচ্ছন্দ বিনিময় ঘটে, ‘বিজ্ঞান ও বিষহরি, উভয়ের সাধনা’ যুক্ত হয়।

কিন্তু এই গল্পে মহাশ্বেতা দেবী নানা ভাষাকে ব্যবহার করেন কাহিনীকে অন্য মাত্রা দেবার উদ্দেশ্যে। বিজ্ঞানের ভাষায় ইংরেজির অফুরন্ত মিশেল একদিকে দূরস্থ ক্ষমতাসূত্রের অদৃশ্য শাসনের দ্যোতক হয়, অন্যদিকে গ্রাম থেকে শহরের সংস্কৃতির ব্যবধানেরও সাক্ষ্য বহন করে। বসন্তের গ্রামদর্শন তথা তার দৃষ্টিকোণ একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে যে দূরত্ব বহন করে তারই পরিচয় লেগে থাকে বাংলা বুনটের মধ্যে বিজাতীয় শব্দের বাহুল্যে— ‘এখানে অপুষ্ট, ক্ষয়প্রাপ্ত, প্রতিরোধহীন মানবশরীর ও কালাজ অ্যাবাউনডিং’— ‘অবলাইজ’, ‘রেজিম’, ‘এ্যাকাডেমিক আকর্ষণ’, এমনি শব্দগুলি যেন বসন্তের চর্চিত বৌদ্ধিকতার সংস্কার থেকে উঠে এসে এই গ্রামীণ নিম্নবর্গীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকেই একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় অবরুদ্ধ করতে চায়। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ভাষা ও দৃষ্টিকোণও একেক সময় যেন ব্যবধানের প্রাচীর হয়ে ওঠে।

ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ঘনিষ্ঠ সংলাপ, ও সেই সংলাপের মধ্য দিয়েই এক মানবসম্পর্কের উন্মেষে এই ব্যবধান ভাঙে। যেমন ‘বাঁয়েন’-এ, তেমনি ‘বেহুলা’তেও। দুটি গল্পেই সংস্কারের মধ্য থেকে অন্যতর সমাজবোধের এই যে দীপ্ত উন্মেষ, তাকে সংস্কারমুক্ত এক অন্যতর পবিত্রতা বা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই যেন মহাশ্বেতা দেবী এক প্রাণপ্রদ মৃত্যুতে পরিণতি দেন। ‘বেহুলা’ গল্প শেষ হয় এক ভয়মুক্ত সংস্কারবিনাসী সর্পযজ্ঞে : ‘গ্রামের লোকগুলির শোক, কালাজ বিষয়ে ভয়, হেদো নস্করের ওপর রাগ, সব উত্তরিত হয় এক্ষণিক প্রজ্বলন্ত ক্রোধে। আগুন তাই ভীষণ জ্বলে।’ শ্রীপদর মৃত্যুকালে সে যে মুক্ত, সর্ববিদারক দৃষ্টি নিয়ে দেখতে দেখতে জানতে জানতে বুঝতে বুঝতে মৃত্যু বরণ করে, সেই মৃত্যুর মধ্যেই এই মুক্তির আশ্বাস নিহিত ছিল।

‘সাঁঝ-সকালের মা’ ঠিক অমনই এক মৃত্যুকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। এই মৃত্যুর কাছে এসে, এই মৃত্যুর মধ্য দিয়েই জটেশ্বরী ঠাকুরনি সত্তা থেকে তার স্বাভাবিক মানবী সত্তায় ফিরে আসে। যে পুত্র সাধনকে জটি একদা বারণ করে দিয়েছিল, ‘মা বোলে ডাকো না বাপ, বাপো আমার,’ যার কাছে সে হয়ে উঠেছিল, ‘সাঁঝে আর সকালে তু মা, আর দিনেমানে তু ঠাকুরনি’, সাধনের ‘সাঁঝ-সকালের মা’, সেই সাধনকে সে মৃত্যুর আগে আবার তাকে মা বলে ডাকবার অনুমতি দেয়। জটির দেবীত্বমুক্তির ক্রমিক ইতিহাস বস্তুত শুরু হয় এই ‘মা” ডাকার অনুমতিদান থেকেই। তারপর অনাদি ডাক্তার দেখে, “জটি ঠাকুরনির চোখে শুধু আশ্চর্য, অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি … আসন্ন মৃত্যু ছাড়া আর কেউ এমন সৌন্দর্যে মানুষের চোখ রাঙিয়ে দিতে পারে না।’

তার মানবীত্বে প্রত্যাবর্তনেরই ইংগিত বহন করে ‘অনাদি ডাক্তারের টেবিলে মাঝে মাঝে যে-সব যুবতী মেয়েরা অসহায় বেদনায় শুয়ে থাকে’, তাদের সঙ্গে জটির তুলনায়। চণ্ডী বাঁয়েনের মতো, শ্রীপদ মালের মতো জটি ঠাকুরনিও মৃত্যুতে এক মহনীয় মাত্রা পায়: ‘যেন এক অন্ত্যজ, গরিব, হতভাগিনী মারা যাচ্ছে না, যেন কোন মহামানী দামী মানুষ মারা যাচ্ছে তাই এত ভিড়।’ Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf ডাউনলোড করুন ও পড়ুন।

‘বাঁয়েন’-এর সঙ্গে মিল আছে ‘সাঁঝ-সকালের মা’-র। ডোমদের অভিশপ্ত অন্ত্যজ জীবনের পিছনে যেমন হরিশচন্দ্রের উপহার, পাখমারারাও তেমনি জরা ব্যাধের বংশধর রূপে ঈশ্বরকে হত্যা করেছিল বলে’ ‘অভিশপ্ত’। একই ভাবে বন্য আত্মনিবেদনের রোম্যান্‌স্-এ মলিন্দর-চণ্ডী জটি-উৎসবের প্রেমের সূত্রপাত। মলিন্দরের মতোই জটি-উৎসবও প্রথাগত বৃত্তি ছেড়ে সরে এসেছিল। ‘এখন তুমি জাতে উঠেছ, শ্রেণী বদলিয়েছ।’ কিন্তু সংস্কারে প্রোথিত ভয় যায় না। জাতে ওঠার অদম্য আকাঙ্ক্ষা, পুরনো জাতপরিচয় মুছে ফেলার দুরন্ত সাধ, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়- -এ নিয়ে তাদের অনেক দিন কাটে। যতদিন উৎসব বেঁচে থাকে। এবার আর চেষ্টা করেও জটি পাখমারাদের সমাজে ফিরে যেতে পারে না, তাদের খুঁজেই পায় না। ‘অলৌকিকতা দিয়ে নিজের চারদিকে বর্ম ‘ এঁটে জটি নিজেকে বাঁচিয়েছিল, ‘সন্ধে হলে ঠাকুরনি হয়ে যেত সাধনের মা।

ঠাকুরনি হয়ে যে চাল পেত, মা হয়ে তার ভাত রেঁধে ওর হাবা ছেলেকে খাওয়াত!” যে পবিত্রতাকে বা দেবীত্বকে জটি বাঁচবার ও ছেলেকে বাঁচাবার উপায়স্বরূপ গ্রহণ করেছিল, তার মধ্যেই নিহিত ছিল অর্থহীন আচারের প্রতি সেই অনীহা যা নাটকীয় মাত্রা পায় যখন সাধন-পুরোহিতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় ‘ছরাদের চাল’, যা ‘খেতে নাই”। আবার মহাশ্বেতা দেবী তাঁর স্বভাবধৃত ভাষাপ্রয়োগে এই আপাত অনাচারকে মানবীয় মর্যাদা দেন, ক্ষুন্নিবৃত্তিকে ধর্মের ঐশ্বর্য দেন, আবার ঐ ভাষার গার্হস্থ্য অন্তরঙ্গতায় তাকে কঠিন-নির্মম বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করেন: ‘বুকের কাছে চালের পোঁটলা, সাধন হেলেদুলে বাড়ি যায়। সাধন বাড়ি যাবে, উনোন ধরাবে, ভাত রাঁধবে। ভাতের গন্ধ বড় ভাল গন্ধ। ভাতের গন্ধে সাধন তার মাকে খুঁজে পায়। যতদিন ভাত রাঁধবে সাধন, তপ্ত ভাত খাবে, ততদিন ওর কাছে সাঁঝ-সকালের মা বাঁধা থাকবে।

মায়ের কথা মনে করতে গিয়ে পুরুতের ওপর দুর্ব্যবহারের অনুতাপে সাধনের চোখ জলে ভেসে গেল। ‘মা, তুমি যেমন তেমন করে স্বর্গে যাও। সাধন এখন ভাত রেঁধে খাবে। তুমি দোষ নিও না। ‘ Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf ডাউনলোড করুন ও পড়ুন।

সাধন কান্দোরীর অপরিণতবুদ্ধি সারল্যের মধ্যে একটা নগ্ন সত্যদৃষ্টি আছে যা ক্ষুধার রূঢ় বাস্তবকে সবার উপরে স্থান দেয়। সেই একই দৃষ্টি শকাব্দে চৈতন্যের সমকালে কল্পিত ‘বান’ গল্পে বালক চিনিবাসের। এদের দুজনেরই চোখে ধর্ম ও ক্ষুন্নিবৃত্তি সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। এক বিচিত্র আয়রনির প্রসাদে মহাশ্বেতা দেবী যেন এই কথাই বলতে যান, ক্ষুধার অন্নের সংস্থান করে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে বড় আর কোন্ আদর্শ ধর্ম হয়ে উঠতে পারে? ‘বান’ গল্পটিতে আকাঙ্ক্ষিত, প্রত্যাশিত চৈতন্যদেব যখন চিনিবাসের গ্রামে শেষ পর্যন্ত আসেন না, তখন চিনিবাসের আশাভঙ্গ শুধু সাম্যের, সান্ত্বনার, অভিযোগ- নিরসনের প্রত্যাশারই বিনাশ নয়, ‘শুধু তো গৌরাঙ্গ দর্শন নয়।

পেটের জ্বালা বড় জ্বালা।’ অতীতে গঙ্গার কোনো এক বান তার ভয়ংকর ধাক্কায় অন্তত সাময়িকভাবে জাতপাতের বিভাজনকে আড়াল করেছিল, উঁচু জাতের ক্ষমতাবান প্রতিভূরা অন্ত্যজ দরিদ্রদের তাঁদের উদ্বৃত্ত খাদ্য পরিবেষণ করেছিলেন। সেই একবারই অস্তেবাসীদের হৃদয় ও পেটের ক্ষুধা শান্তি পেয়েছিল। তাই স্বভাবতই চৈতন্যপ্রেমের বানের সম্ভাবনায় চিনিবাস সেই একই পরিণাম কল্পনা করে, কামনা করে। এই দুই বানকে মিলিয়ে দিয়ে মহাশ্বেতা দেবী যেন অসাম্যের মধ্যে সাম্যের প্রতিষ্ঠাকে ঘিরেই একটা অন্য ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন—দয়া, দাক্ষিণ্য, হৃদয়পরিবর্তনে নয়, একটা প্রবল বিপর্যয়ের মধ্যেই ঘটতে পারে ঐ সাম্যের প্রতিষ্ঠা।

স্মৃতি, সংস্কার, অক্ষমতাবোধ, ভয় অন্তেবাসীদের যে শুধু দমিত করে রাখে তাই নয়, তাদের মন ও চরিত্রের গভীরেও ক্রিয়া করে যায়। এই ক্রিয়া প্রথমে হয়ত টিকে থাকার পদ্ধতি-কৌশল আবিষ্কার-উদ্ভাবনে মুক্তি খোঁজে (যেমন জটির ঠাকরুন হয়ে ওঠায়), কখনো বা এক শুদ্ধ মানবীয় আবেগে উত্তীর্ণ হয়ে মুক্তি এনে দেয় (যেমন বাঁয়েনের সেই অতিমানবীয় ভূমিকায়)। সত্তরের দশকের প্রথম পর্যন্ত এই দিকটাই মহাশ্বেতা দেবীকে বেশি ভাবিত করেছিল। ঐ ভয় অন্তেবাসীদের মধ্যেই সীমিত নয়। মধ্যবিত্ত নাগরিক পরিমণ্ডলে ঐ ভয়ের ছবি ‘রং নাম্বার’ গল্পে। 1972 সালে লেখা এই গল্পটি একদিক থেকে দেখতে গেলে একটি সূক্ষ্ম সীমারেখা টেনে দিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর গল্পগুলির মধ্যে একটা বিভাজন এনে দেয়। তেমন যান্ত্রিক কোনো বিভাজন নয়, তবুও বিভাজন। ‘দ্রৌপদী’, ‘বিছন’, ‘শিকার’ (1978) গল্পে একটা প্রবল প্রতিবাদী চেতনা প্রতিরোধে উদ্যত হয়।

অন্তেবাসীরা এবার লড়াইয়ের পথে নেমেছে। ‘দ্রৌপদী’তে সে পথ সংগঠিত আন্দোলনের। কিন্তু অন্য দুটি গল্পে প্রতিরোধ বা প্রতি-আক্রমণ স্বতঃস্ফূর্ত ; এবং তা অন্তেবাসীদের জীবনযাপন তথা অনেক-কিছু মেনে নিয়ে টিঁকে থাকার যে প্রাণান্ত অভিযান, তারই অন্তস্তল থেকে উৎসারিত, বাইরে থেকে সঞ্চারিত কোনো রাজনৈতিক বোধ বা চেতনার পরিণাম নয়। Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf ডাউনলোড করুন ও পড়ুন।

তবুও সত্তরের দশকের শেষপাদে লেখা এই তিনটি গল্প বা এই সংকলনে অনুপস্থিত ঐ সময়ের অন্য গল্পগুলি কোনোমতেই ব্যতিক্রমী নয়। ‘বিছন’ গল্পে দুলন গঞ্জুর অভিজ্ঞতায়, ‘বেঁচে থাকবার কৌশল ভাবতে ভাবতে বাবা কোনোদিন ছেলে বা নাতির সঙ্গে কথা কইতে সময় পেল না।’ ‘বাঁচবার তাগিদেও জোর খাটিয়ে নয়, ফিচলেমি করে সর্বদা প্রতি পরিস্থিতি থেকে ফায়দা তুলে নেয়।’ কিন্তু ঘটনা তথা ইতিহাস দুলনকে ঐ অবস্থানে থিতু হয়ে থাকতে দেয় না। মহাশ্বেতা দেবীর লেখকধর্ম স্বরূপ ঐ ইতিহাসচেতনা শুধু তাঁরই নয়, তাঁর চরিত্রদেরও, যাদের মধ্যে ইতিহাস চেতনায় জারিত হয়ে চেতনার অঙ্গীভূত হয়ে যায়। মহাশ্বেতা দেবী ইতিহাসের এই আত্মীকরণকে তাঁর কাহিনীধর্মে পুরাণের মাত্রা দেন নানাভাবে— কখনো নতুন কোনো গানের জন্মে, যেমন ধাতুয়ার সেই গান, ‘কেউ তাদের খোঁজ দেয় না কেন?

তারা পুলিসের খাতায় হারিয়ে গেছে’— কিংবা পুরাণ-প্রকৃতির সেই মেলবন্ধনে যাতে মৃতদের শরীর ও অস্থি প্রকৃতিতে প্রাণ সঞ্চার করে, বীজ হয়ে ফলনের কারণ হয়। দুলন বলে, ‘ধাতুয়া, তোদের হম বিছন বনা দিয়া।’ সেই ফলনের আদিম আবেগ থেকেই এক বৈনাশিক প্রতিহিংসাস্পৃহা জাগ্রত হয়। জন্ম-বিনাশের অবিচ্ছেদ্য দ্বান্দ্বিকতায় নবপুরাণের মাত্রা লাগে। তখনই সংস্কারের দাসত্ব ভেঙে পড়ে যুগান্তর ঘটে।
‘শিকার’ গল্পে অন্তেবাসী মেরী ওঁরাও সাহেবের জারজ হিসেবে জাত-পাত সংস্কারের বিচারে এক অদ্ভুত বৈষম্য-দূরত্বে প্রতিষ্ঠিত। ‘আদিবাসী যুবকদের কাছে মেরীর গায়ের রঙ একটা প্রতিরোধের দেয়াল।’ ‘শ্বেতাঙ্গ পিতার জারজ মেয়ে বলে ওকে ওঁরাওরা রক্তের রক্ত মনে করে না এবং স্বয়ং স্ব সমাজের কঠোর রীতিনীতি ওর ওপর আরোপ করে না।’

আবার ঐ ওঁরাও সমাজের সংস্কারের যাবতীয় প্রতিবন্ধের বাইরে তাকে মুক্তি দিয়ে তার যথার্থ সমাজ তাকে এক বিশেষ অধিকার তথা শক্তি দেয়, তারা নিজেরাও মানে, ‘মেরীর মধ্যে সাচাই আছে, অস্ট্রেলিয়ান রক্তের তেজ।’ ঐ সমাজের বাইরে দাঁড়িয়ে আবার বাঁয়েনের মতোই শিকারের ‘পবিত্রতাকে’ অন্য মাত্রায় অন্য পবিত্রতা দেয় মেরী তার প্রতিহিংসাত্মক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জাত-পাতের যে পবিত্রতা উঁচু জাতকে প্রশ্রয় দেয়, নিচু জাতকে শোষণ করবার, অসম্মান করবার অধিকার দেয়, তার বিরুদ্ধে শিকারের প্রাচীন আচারের পবিত্রতাকে আশ্রয় করে মেরী যেন তার নিজস্ব সমাজের ধর্মকেই পুনরাবিষ্কার করে তাকে আত্মস্থ করে: সে আর তখন তোহরি বাজারের বাজারিয়া নয়, প্রসাদজীর মুনাফার নিষ্ঠাবতী রক্ষয়িত্রী নয়, বড় শিকারের পর যেন তার পুনর্জন্ম হয়।

তার প্রতিশোধ পৌরাণিক মাত্রা পায়: ‘নালায় নেমে নগ্ন হয়ে স্নান করতে করতে ওর মুখ গভীর তৃপ্তিতে ভরে গেল। যেন পুরুষসঙ্গ করে অশেষ তৃপ্তি পেয়েছে ও।’ তারপর সে যেন অন্য এক পুনর্জাত মেরী ওঁরাও ‘মদ আর গান, মদ আর নাচ’-এর মধ্য দিয়ে তার সমাজের জীবনের ছন্দের স্বাদ নেয়, তার মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে, নবার্জিত স্বাধিকারে, ‘বড় শিকারের’ অর্জনের দাবিতে। কিন্তু এখানেও ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতায় যে-মুহূর্তে মেরী ওঁরাও তার পদানত পর্যুদস্ত-নিপাতিত সমাজের অতীত শক্তিকে আবিষ্কার করে, তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠ করে, সেই মুহূর্তে সে যুগপৎ তার স্বসমাজে তার স্থান নিজে করে নেয়, আবার সেই সমাজকে পেরিয়ে যায়, কারণ যে অতীত আজ তার করায়ত্ত তথা চেতনায় প্রসারিত সে-অতীত আজ আর তার সমাজের নয়, বরং জালিমকে নিয়ে যে ভবিষ্যৎ সে সৃষ্টি করতে চায়, তারই দিগ্‌দর্শন।

নবপুরাণের ভাষাতেই যেন মহাশ্বেতা দেবী লেখেন : ‘তখন নাচতে নাচতে মেরী পিছোতে থাকল। পিছোতে পিছোতে অন্ধকারে ওরা নাচছে, খুব নাচছে। মেরী অন্ধকারে ছুটে চলল।’ পিছনো-এগনো ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতায় যখন একাত্ম হয়ে যায়, তখন অতীতের পথ ভবিষ্যতেরই পথ। তাই শিকারের আদিম শক্তি আয়ত্ত করে মেরীকে যেতে হবে বাস-এ চড়ে, কাঠের ট্রাকে করে ‘রাঁচি- হাজারীবাগ-গোমো – পাটনা’, অরণ্যের আদিম মায়াবি অন্ধকারের গভীরে নয়। ‘অন্ধকারে, তারার আলোয় রেললাইন দেখে পথ চলতে চলতে মেরীর মনে কোনো ভয় এল না, কোনো জানোয়ারের ভয়। আজকে ও সবচেয়ে বড় জানোয়ার মেরেছে বলে বন্য চতুষ্পদদের বিষয়ে সব প্রাত্যহিক, রক্তে অভ্যাসের ভয় ওর চলে গেছে।’ জঙ্গল থেকে রেললাইন— ইতিহাসেরই অমোঘ যাত্রাপথ।

মেরী স্বেছায় আসে জঙ্গল থেকে রেললাইনে। ‘দ্রৌপদী’ গল্পে দোদি মেঝেকে পুলিশি প্রশাসন বিশ্বাসঘাতক দলছুটদের সঙ্গে যোগসাজসে টেনে আনে জঙ্গল থেকে সেনানায়কের ক্যাম্প-এ—ইতিহাসেরই আরেক পথ ধরে একই অমোঘ যুক্তিতে। ‘শিকার’ ও ‘দ্রৌপদী’ একই কাহিনীর দুই পিঠ। মেরীর রক্ত ‘সাহেবি রক্ত’। ‘দোদির রক্ত চম্পাভূমির পবিত্র কালো রক্ত, নির্ভেজাল। চম্পা থেকে বাকুলি, কত লক্ষ চাঁদের উদয়াস্তের পথ। রক্তে ভেজাল মিশতে পারত, দোদির পূর্বপুরুষদের জন্যে গর্ব হল। তারা কালো কুঁচের কুচিলায় মেয়েদের রক্ত পাহারা দিত। সোমাই ও বুধনা জারজ। যুদ্ধের ফসল। শিয়লডাঙার মার্কিন সৈন্যদের উপহার টুওয়ার্ডস রাঢ়ভূমি।’ মেরীকে ছেড়ে আসতে হয় তার সমাজকে।

আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দোদি বাঁধা পড়েছে শক্তপোক্ত সূত্রে তার সমাজের সঙ্গে, যে-সমাজ আবার ঐ আন্দোলনের কারণেই আরো প্রসারিত, বৃহত্তর তাতে শহরের সেই ছেলেরাও আছে যারা নির্মম সমরনীতি রচনা করে ; ‘অরিজিতের গলা, যদি কেউ ধরা পড়ে, টাইম বুঝে অন্যরা হাইড-আউট চেন্জ করবে। ….কোনো কমরেড নিজের জন্যে অন্যদের ডেসট্রয়েড হতে দেবে না।’ তাই সেই সমাজের সহজাত চেতনা নিয়েই দোদি লড়াই করতে করতে তার সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তিকেই লালিত করে। সেই শক্তিরই পৌরাণিক মাত্রায় অতিকায় প্রকাশ ঘটে তার ‘সর্ব সত্তার শক্তি’ দিয়ে তার ‘একবার, দুবার, তিনবার’ সেই প্রবল কুলকুলিতে যাতে গল্পের দ্বিতীয় পর্বের নাটকীয় পরিসমাপ্তি। জঙ্গলে যা কুলকুলি, প্রতিপক্ষের শিবিরে তাই কিন্তু পুনরুচ্চারণে সমানই দুর্মর ‘লেঃ কাঁউটার কর্…।’

‘শিকার’ গল্পের শেষে মেরী যে ভয় পার হয়ে আসে, ইতিহাসের দাবার ছক উলটে দিয়ে দোদি সেই ভয়ই সঞ্চার করে দেয় সেনানায়কের মনে। ‘দ্রৌপদী দুই মর্দিত স্তনে সেনানায়ককে ঠেলতে থাকে এবং এই প্রথম সেনানায়ক নিরস্ত্র টার্গেটের সামনে দাঁড়াতে ভয় পান, ভীষণ ভয়।’ ‘শিকারের ভিত্তি ও পরিবেশ জঙ্গলই, ‘দ্রৌপদী’তে জঙ্গল আর প্রশাসনের সংঘাত। তার ভাষাতেও তাই সেই সংঘাত, ভাষার স্তরবৈচিত্র্য : ডাসিয়ারের ইংরেজী ক্ষমতার, অধিকারের, শাসনের ভাষা; তকমাধারীদের ভাষায় তা নেমে আসে মধ্যম স্তরে, যেখানে ক্ষমতা প্রযুক্ত হয় ; সেনানায়কের ভাষায় এবং তাকে ঘিরে ভাষার যে বহুমাত্রিক আবহ মহাশ্বেতা দেবী রচনা করেন, তাতে আছে ক্ষমতার আরো এক জটিল বিন্যাস।

এই নানা ভাষার বুনটে তৈরি ক্ষমতার জাল ছিন্ন করেই উচ্চারিত হয় দোদির ভাষায়: ‘লেঃ কাঁউটার কর্ যেখানে প্রশাসনের ক্ষমতার ভাষা তার উচ্চারণে উলটে পড়ে, মাথা থুবড়ে পড়ে, তার প্রবল শারীরিক তাড়নায় তারই শরীর থেকে, তার প্রতিরোধী রোষ থেকে অর্থান্তরে পৌঁছে যায়। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর গল্প উপন্যাসে যে কখনবৃত্ত বেছে নিয়েছেন তাতে যেমন বাস্তবের উপস্থিতি রয়েছে, তেমনই রয়েছে সেই বাস্তবকে ইতিহাসের ক্রমান্বয়তায় পরিবর্তমান রূপে দেখানোর নানা পদ্ধতি : ইতিহাস মানে এখানে কেবল অতীতের উৎস বা উত্তরাধিকারের উদ্ঘাটন নয়, বরং অতীত থেকে ভবিষ্যতের যাত্রাপথের ইংগিতও বটে; তাতেও অবশ্য আশাবাদী ভবিষ্যদ্দর্শনের সহজ উত্তরণ নেই, বরং বর্তমানের মধ্যেই ভবিষ্যতের বীজের উদ্‌গমের পুরাকথাসম উদ্ভাস আছে।

বাস্তবে এমন হয়ত ঘটে না বা ঘটেনি, বা ঘটলেও ঘটেছে আপতিক অতর্কিত কোনো উৎক্ষেপে ; মহাশ্বেতা দেবী সেই সম্ভাব্য বা সম্ভাবনাকেই এক পুরাবৃত্তীয় বিস্তার তথা কল্পমাত্রা দেন যা বাস্তবের মধ্য থেকেই উদ্‌গত হয়ে বাস্তবকে অতিক্রম করে। ভাষাকে টেনে প্রসারিত করে তার মধ্যে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বাস্তবের একাধিক মাত্রা ও তাদের অহরহ টানাপোড়েনকে গ্রথিত করে তিনি ভাষার এমন এক ক্ষেত্র রচনা করেন যে ঐ ক্ষেত্র থেকে ঐ নাটকীয় কল্পক্ষণের উদ্ভব কখনোই রূপকথা হয়ে যায় না, বরং বাস্তবেরই অনিবার্য উপচিতি মনে হয়। দোদি মেঝেন, দুলন গঞ্জু, চণ্ডী বাঁয়েন, শ্রীপদ মাল, জটি ঠাকুরনি, এরা সকলেই বাস্তবেরই মানুষ হয়েও বাস্তববিসারী।
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়

Mahashweta Devir Chhotogolpa Sonkolon pdf download link
Download / Read Online

Be the first to comment

Leave a Reply