নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী এর ভৌতিক গল্প পিৎজা পার্টি Pitja Party পড়ুন এখনই।
পিৎজা পার্টি Pitja Party পড়ুন
ঘুম থেকে উঠে ঘড়িতে দেখলাম বেলা প্রায় এগারোটা বাজে। কাল অফিসের ফেয়ারওয়েল পার্টিটা থেকে ফিরতে বেশ একটু রাত হয়েছিল। অফিসের গাড়িটাই শেষবারের মতো ড্রপ করে দিয়ে গিয়েছিল ফেরার সময়। এই বর্ষায় রাস্তায় জমা জলে এমনিতেই গাড়ির স্পিড তোলা দায়। নেহাৎ অফিসের সকলে ফেয়ারওয়েলটায় থাকার জন্য জোরজার করেছিল, না হলে এই বর্ষায় বাইরে বেরোয় কোন বোকা! এখন বাইরের দিকে তাকালাম। জানলার বাইরে এখনও ঝমঝমে বৃষ্টিটা হয়েই চলেছে। মুম্বইয়ের কুখ্যাত বৃষ্টি। গত পাঁচদিন ধরে টানা বৃষ্টিটা হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গায় একতলায় যাদের বাড়িঘর তাদের ঘরে জল ঢুকতে শুরু করেছে দু’দিন আগে থেকেই। তবে এই বৃষ্টিতে জল শুধু একা সমস্যা নয়, সমস্যা আরও আছে। সমস্যা হল মাটির নিচের প্রাণীরা।
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল pdf – চিত্রা দেব Thakurbarir Andarmahal pdf – Chitra Deb
বৃষ্টিতে মাটির নিচ থেকে উঠে আসে। সাপ, ব্যাঙ, ছুঁচো। এই শহুরে অঞ্চলে অবশ্য সাপ, ব্যাঙ বেশি নেই। আছে ইঁদুর। ছোট নেংটি ইঁদুর নয়, বিরাট সাইজের ধেড়ে ইঁদুর। মুম্বইতে মাটির নিচে প্রচুর ইঁদুর থাকে। বড় বড় চেহারার ইঁদুর। এক একটা ইঁদুরের চেহারা এমন বড় যে বেড়ালরা অবধি তাদের দেখে ভয়ে পালায়। এসব ইঁদুর লাফ দিয়ে দিয়ে জলের পাইপ বা জানলার কার্নিশ বেয়ে দু’তলা, তিনতলা অবধি উঠে যায়। ফাঁকা, জনমানবহীন ঘর পেলে তারা অনেক সময় এরকম বর্ষায় সেসব ঘরে ঢুকে ডেরা বাঁধে। এমনিতে মানুষের তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে ছোট পাখির বাচ্চা বা প্রাণী পেলে তারা দল বেঁধে আক্রমণ করে, কুটকুট করে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়।
আমাদের এদিকটায় অবশ্য সেসব ঝামেলা নেই। সবই হাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্ট। যেহেতু আমার আজ অফিস নেই, তাই এখন আমার সারাদিন ল্যাদ খাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। কাল ভোরেই আমি মুম্বই থেকে কাটছি। জিনিসপত্র সব বাঁধা ছাঁদা হয়ে গেছে গতকাল রাতেই। জিনিস বলতে একটা বড় ট্রলি আর একটা রুকস্যাক। আগামী পাঁচবছর ওই – দুটোই আমার ঘরবাড়ি হতে চলেছে। ঘরের ফার্নিচারগুলোকে নিয়ে আমার কোনও চিন্তা নেই। স্থাবর অস্থাবর কোনরকম সম্পত্তিতেই আমার বিশ্বাস নেই। আমার অ্যাপার্টমেন্টটা ভাড়ার। ফুললি ফারনিশড। আসবাবপত্র সব বাড়িওয়ালার। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছে। অন্তত যা যা আমি ঠিক করেছি। সেইমতই। শুধু এই ফালতু বৃষ্টিটা ছাড়া।
তবু জানি না কেন, মনের মধ্যে একটা খচখচানি লেগেই আছে। জানি না এই খচখচানির কারণ কী? হতে পারে এর একটা কারণ এই বৃষ্টিটা। অথবা হতে পারে এর কারণ ঋষি দা। অথবা এর কারণ হয়ত তিলোত্তমা। অথবা হয়ত এর কারণ….
তিলোত্তমা আর আমি এক অফিসে কিছুদিন কাজ করছিলাম। সেখান থেকেই পরিচয়, সেখান থেকেই ঘনিষ্ঠতা। ফেয়ারওয়েলের রাতে একসময় ফিসফিস করে ও বলেছিল “আমি ভেবেছিলাম আমরা… আমরা…”
আমি জবাব দিইনি। আমি হেসেছিলাম। স্থাবর অস্থাবর কোনরকম সম্পত্তিতেই আমার বিশ্বাস নেই। আমার পছন্দ ফুললি ফারনিশড অ্যাপার্টমেন্ট। যে কোনও সময় যা ছেড়ে যাওয়া যায়। গতকাল ছিল এখানকার বিখ্যাত মিডিয়া কোম্পানিতে আমার চাকরির শেষ দিন। আমি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটা অ্যাসাইনমেন্টে জয়েন করছি দু’দিন পর থেকে। পাঁচ বছরের কন্ট্রাক্ট। সেই উপলক্ষেই কাল ব্রেজিল যাওয়া। অ্যামাজনের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে হবে। এমন একটা কাজ যা অন্য যে কোনও ফটোগ্রাফারের মতো আমারও স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন, অফার লেটার হয়ে একমাস আগে আমার মেলবক্সে এসেছিল।
কাল ভোররাতে আমার ব্রেজিলের রওনা দেওয়ার ফ্লাইট আছে। পুরো আঠেরো ঘন্টার জার্নি। যেহেতু জিনিসপত্র সব বাঁধাছাদা হয়ে গিয়েছে তাই রান্নার আর কোনও সুযোগ নেই। রান্না অবশ্য আমি বাড়িতে খুব বেশি কোনকালেই করতাম না। বেশিরভাগ সময়ই খাওয়া দাওয়া হত অফিসে বা আউটডোরে। পেশাদার ফটোগ্রাফার হলে যা হয়। ঘরে থাকলে প্রায়ই খাওয়া দাওয়া সারতাম ঋষি দা আর গৌতমী বউদির বাড়িতে। তবে আজ ওরা কেউ বাড়িতে নেই। ঋষি দা বেড়াতে গিয়েছে ডুয়ার্সে। গৌতমী বউদি তার বাপের বাড়িতে।
অথচ এখন খিদে পেয়েছে। কী খাওয়া যায়! কী খাওয়া যায়। একটা পিজার অর্ডার দিলে কেমন হয়! এই বৃষ্টির চোটে ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। সৌভাগ্যক্রমে পিজার দোকানটা আমার অ্যাপার্টমেন্টের নিচেই। তাই যেহেতু আমার এখানে এখনও সেরকম জল জমেনি তাই হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট পরে বেরোলাম। পিৎজার দোকানে কাউন্টারে থাকা মেয়েটা আমার মুখচেনা। আমায় দেখে হাসল। আমিও একটু হাসলাম। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার আমার একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। আমি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলি টা সামান্য ভুলে, চোখটা একটু বড় করে, চাহনিটা থাকে নরম। গলার স্বরটা একটু গভীর করে নিই। টেকনিকটা সবসময় কাজ দেয়। মেয়েটার জামার বুকের উপরে তার নাম লেখা আছে। মেয়েটার নাম – মেনকা।
আমি বললাম, “মেনকা, আমি ভয়ংকর ক্ষুধার্ত। তাড়াতাড়ি কিছু খাওয়াবে?”
মেনকা আমার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল। আমি অবশ্য হাসলাম না। মুখের অসহায়তা আর চোখের রসিকতা বজায় রেখে তাকিয়ে রইলাম।
মেনকা মেনুটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “বলুন না স্যার, কী খাবেন?”
পিৎজা মানেই, আমার কাছে প্রচুর টপিংস। এখন একটু মেনু থেকে সবচেয়ে বেশি মাংস, চিজ আর সবজি দেওয়া একটা বড় পিৎজা পছন্দ করে অর্ডার দিয়ে দিলাম। এখন খেয়ে কিছুটা বাঁচলে রাতের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। ঘরে ডেলিভারিটা দিতে বললাম।
মেনকা বলল, “এত বৃষ্টিতে আধঘন্টার অফার নেই স্যার। আপনি কি অর্ডার দিতে চান?
আমি বললাম, “প্লিজ, আমাকে স্যার স্যার বলো না। স্যার বলার মতো এতখানি বুড়ো আমি এখনও হইনি। আমার নাম দেবরাজ। হ্যাঁ, আমি তোমার দোকানের পিজা খাওয়ার জন্যে কিছুক্ষণ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখব। দেখো যত তাড়াতাড়ি দেওয়া যায় মেয়েটা আবার ফিক করে হাসল। আমি কিন্তু হাসলাম না। উদাস নরম চাহনিটা ভাসিয়ে রাখলাম। মেয়েটার হাসির সঙ্গে আমি হাসলে সে ভাবত আমি ওর সঙ্গে ফ্লার্ট করছি। ফ্লার্ট করা একটা আর্ট। সবাই তা পারে না। ফ্লার্ট করার প্রথম শর্ত হল মাত্রাজ্ঞান। মুখ সিরিয়াস রেখে হালকা ধরনের কথা বলতে হয়। যার সঙ্গে ফ্লার্ট করা হচ্ছে, সে যেন কখনও না ধরতে পারে তার সঙ্গে ফ্লার্ট করা হচ্ছে। সবসময় তাকে দ্বিধান্বিত রাখতে হয়। মেনকার চোখ দ্বিধান্বিত। আমার এই টেকনিকটাও সবসময় কাজে দেয়।
পিৎজার অর্ডার দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলাম। তারপর বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেল। দরজায় টিং টং শুনে ভাবলাম ডেলিভারি দিতে এসেছে। খুলে দেখলাম ঋষি দা। একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
২
ঋষি দা’রা আমার উল্টোদিকের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে। ফ্ল্যাটতুতো দাদা বউদি। ঋষি দা আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড়। গৌতমী বৌদি প্রায় আমারই বয়েসী। ঋষি দা’র সাথে আমার আরও কিছু সম্পর্ক আছে। তার মধ্যে একটা হল আমরা দুজনেই একসাথে দাবা খেলি। ভালো করে বলতে গেলে দাবা খেলাটা আমি ভালো করে শিখি ঋষিদার কাছেই। শান্ত আর গোবেচারা ধরনের দেখতে এই লোকটা যে কী পরিমাণ অ্যাগ্রেসিভ দাবা খেলতে পারে তা ভাবা যায় না!
ঋষি দা দেখি তৈরি হয়েই এসেছে। দাবার বোর্ড বগলে। হাতে গুটির প্যাকেট।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “চল! আজকের দানটা হয়ে যাক। গৌতমীও বাপের বাড়ি গেছে। জমিয়ে খেলা যাবে আজ।” বলে আমাকে একরকম ঠেলেঠুলেই ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখে টি টেবলে ছক পাততে লাগল।
আমি হঠাৎ ঋষি দা’কে দেখে এত অবাক হয়ে গেছি যে প্রথমে কোনও কথা বলতে পারলাম না। তারপর দরজা বন্ধ করে এসে অবাক স্বরেই বললাম, “এ কী! তুমি কাল রাতে ডুয়ার্সে যাওনি?”
ছক পাততে পাততে ঋষি দা বলল, “আরে দুর দুর! কাল গৌতমীকে ওর বাপের বাড়ি বান্দ্রায় নামিয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখি ট্র্যাকে জল জমে দুরন্ত এক্সপ্রেস বাতিল হয়ে গেছে। টিকিট ফিকিট ক্যান্সেল করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই রাত দুটো। সকাল দশটা অবধি ভোঁস ভোঁস করে। ঘুমোলাম। উঠে থেকে দেখছি সেই বৃষ্টির ভ্যানতাড়া হয়েই চলেছে। গৌতমী এখনও জানে না যে আমি ফিরে এসেছি। মোবাইলের টাওয়ার তো সব বরবাদ হয়ে গেছে। ব্যালকনি দিয়ে একটু আগে দেখলাম তুই হাফপ্যান্ট পরে কোথায় বেরলি, আবার ফিরে এলি। বহুদিন পর এমন সুযোগ পাওয়া গেছে। কেউ ডিস্টার্ব করার নেই। আয় বাবা, একটু জমিয়ে খেলি।”
বসে গেলাম। এখানে ‘কেউ’ মানে ঋষি দা গৌতমী বউদিকে বোঝাল। যদিও আমি জানি এটা ঋষি দা’র একেবারে বাজে কথা। আদুরে ধরনের খুনসুটিপনা বাজে কথা। আমি আর ঋষি দা যখন ওদের ঘরে দাবা খেলি, গৌতমী বউদি তখন অকাতরে কফি আর স্ন্যাক্স সাপ্লাই দেয়। বিয়ের এতগুলো বছর পরেও ঋষি দা আর গৌতমী বউদির মধ্যে সম্পর্কে টানের কোনও কমতি নেই। হয়ত কোনও সন্তান না থাকায় এমন হয়েছে। অন্য স্বামী স্ত্রী’র টান এসব ক্ষেত্রে কমে যায়।
এদের বেড়েছে। ঋষি দা আর গৌতমী বউদি একটা আইডিয়াল কাপল বলতে যা বোঝায়, তাই। ঋষি দা আর আমার কমন ইন্টারেস্ট যদি দাবা হয়, তবে গৌতমী বউদি আর আমার কথাবার্তার অর্ধেক হয় বাংলা সাহিত্য নিয়ে। আরও ভালো করে বললে বাংলা সাহিত্যের একজন সাহিত্যিককেই নিয়ে। তাঁর নাম – সহদেব গুণ। সহদেব গুণ হলেন আমাদের দু’জনেরই প্রিয় লেখক।
সহদেব গুণের লেখার স্পেশালিটি হল জঙ্গল ও রোমান্স। তাঁর লেখা প্রতিটি উপন্যাস গৌতমী বউদির মুখস্থ। অথচ বউদি আদতে মুম্বইয়ের মেয়ে। পড়াশোনা এখানেই। প্রবাসে বড় হয়েও বাংলা সাহিত্যের প্রতি এমন ভালোবাসা অতি বিরল ব্যাপার।
আমার কথা অবশ্য আলাদা। আমি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক। বয়েস বত্রিশ। বর্ধমানের এক পড়তি অভিজাত বাড়ির ছেলে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি শুরু করি কলকাতায় এক পত্রিকার স্টাফ ফটোগ্রাফার হিসাবে। ছোট থেকেই ফটোগ্রাফির প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল আমার। আদতে মফস্বলের ছেলে হলেও ফটোগ্রাফির মতো প্রফেশনে উন্নতি করার জন্য কিছু বিশেষ গুণ দরকার। সেগুলো আছে আমার। লম্বা, সপ্রতিভ চেহারা ছাড়াও আমার মধ্যে একটা বিশেষ ব্যাপার আছে।
তাকে বলে এক্স ফ্যাক্টর। সেই এক্স ফ্যাক্টরই আমাকে যেমন কলকাতা থেকে মুম্বইতে টেনে এনেছিল, তেমনই এখন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ব্রেজিলে।
দাবা খেলা শুরু হল। আমি আমার মন্ত্রীর সামনের বোড়েকে এগিয়ে প্রথম চালটা দিয়ে শুরু করলাম। ঋষি দা’ও দেখি একই চাল দিল। আমি রাজার সামনের বোড়েকে এগোলাম। ঋষি দা সেই বোড়েকে খেল। আমি একদিকের গজের সামনের দিকের বোড়েকে এগিয়ে আনলাম। ঋষি দা সেই বোড়েও খেল। আমি আমার মন্ত্রী বার করে এনে ঋষি দা’র বোড়েটাকে আড়াল করলাম।
ঋষি দা’র বোড়ের আর পালাবার পথ নেই। ফেরার উপায় নেই দেখে ঋষি দা’র বোড়ে আমার ঘোড়ার সামনের বোড়েটাকে মারল। আমি একটা গজ দিয়ে শেষ অবধি ঋষি দা’র ঘাতক বোড়েটাকে শেষ করলাম, কিন্তু মনে একটা সন্দেহ লেগেই রইল। এত সহজ চাল কি ঋষি দা দেবে! কোথাও তো একটা লুকানো অ্যাটাক রয়েছে…. আমি দাঁত দিয়ে নখ খেতে খেতে আমার সামনের চাল ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই ভাবতে পারলাম না। সব ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। ঋষি দা’কে দেখে অবধি মাথাটা এত ঘেঁটে গেছে যে কোনকিছুতেই মন দিতে পারছি না।
ঋষি দা দেখি একমনে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “কনসেন্ট্রেট, দেবু কনসেন্ট্রেট। বেসিক ব্যাপারগুলো কখনও ভুলিস না। বেসিক ব্যাপারগুলো…
বলতে বলতেই নিজের ঘোড়াটাকে এগিয়ে আনল। আমি দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে আবার খেলায় ঢোকার চেষ্টা করলাম। ঋষি দা’র লুকানো অ্যাটাকটা খুঁজে পেয়েছি। পেয়েছি বটে, তবে দেরি হয়ে গেছে। কর্ষি নার ঘোড়া এগিয়ে এল।
খেলতে খেলতে খিদের ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়ল ডোরবেলের টিং টং শব্দ শুনে। পিৎজাটা এতক্ষণে এল! প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ঢুকতেই ঋষি দা বলল, “উরেত্তারা! পিৎজা পিৎজা আবার কখন অর্ডার করলি? ওহ্ বুঝেছি, তখন এটা অর্ডার করতেই বাইরে গিয়েছিলি!
আমার টেনশন হচ্ছিল এই ভেবে যে এত বৃষ্টিতে তুই আবার কোথায় যাচ্ছিস! তুই চলে গেলে আবার আমার খেলাটার কী হত বল তো!”
ঋষি দা’র মাথা খুব পরিষ্কার। যারা দাবা খেলে তাদের মাথা পরিষ্কার হওয়ারই কথা। লোকটার সব ভালো। শুধু একটু বাউণ্ডুলে স্বভাবের। বাপ মায়ের একমাত্র ছেলে। ফার্মেসি নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে পড়াশোনা করেছিল। বাবা প্রচুর টাকাপয়সা রেখে গিয়েছেন। দাদরে একটা খানদানি ওষুধের দোকান আছে। বাঙালির ছেলে সাজানো ব্যবসা আর বিশ্বস্ত কর্মচারী পেলে যা হয়। সারা বছর ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।
বাড়িতে থাকলে দাবার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। আত্মভোলা ভালোমানুষ ধরনের। আজ যদি গ্যাংটকের কোনও অখ্যাত গ্রামে গিয়ে বসে থাকে, ভোরবেলা কাঞ্চনজঙ্ঘার কোনও অসাধারণ ভিউ দেখবে বলে, এক সপ্তাহ পরে আবার তাকে পাওয়া যাবে কচ্ছের রানে হয়ত তাঁবু টাঙিয়ে শুয়ে আছে, চাঁদনী রাত সেখানে কেমন হয় তা দেখতে।
বিয়ের প্রথম প্রথম গৌতমী বউদিও ঋষি দা’র সঙ্গে যেত। তারপর যা হয়! বিয়ের বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে। এখনও ওদের কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি। বউদির আর এমনভাবে ঘুরতে ভালো লাগে না। বৌদি বলে, “তোর ঋষি দাটা যা একখানা মানুষ না… আমার জন্য সহদেব গুণের উপন্যসের জঙ্গল আর পাহাড়ই ভালো।”
ঋষি দা এখন একা একাই ঘুরে বেড়ায়।
আমি পিৎজার প্যাকেটটা খুলে ঋষি দা’র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “নাও, খাও।”
ও মুচকি হেসে বলল, “নাহ্ শুরু। আজ বহুদিন পর তোকে বাগে পেয়েছি। আগে তোকে হারাই, তারপর চিকেন পিৎজা! তুই খা!”
ঋষি দা একটা পুরোপুরি পাগলা। ওর কথায় আমি পাত্তা দিই না। সম্ভবত গৌতমী বউদিও দেয় না।
পিৎজা খেতে খেতে খেলছিলাম। কেন জানি না একদম ভালো লাগছে না। কাল চলে যাব। এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। অথচ ঋষি দা’কে এখনও কিছু বলিনি। আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারটা ও কিচ্ছু জানে না। বহুবার বলার চেষ্টা করেছি। বলতে পারিনি। ওর দাদার মতো আমাকে ভালোবাসাটা মাঝে এসে গিয়েছে। ভেবেছিলাম ও বাইরে থাকবে, আমি চুপচাপ চলে যাব। কিন্তু এখন নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে ওর সামনে। আমাদের সামনে দাবার বোর্ড। খেলাটায় হেরে যাচ্ছি। ঋষি দা’র সঙ্গে আমার শেষ খেলা। কেন জানি না খুব ক্লান্ত লাগছে। ঘুম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ি। বমি পাচ্ছে। বমি পাচ্ছে।
ছুটে গেলাম বেসিনের দিকে। বোর্ডের গুটি টুটি চারদিকে ছিটকে পড়ল, দাবার বোর্ডটা উলটে পড়ল। বেসিনে হড়হড় করে কিছুটা বমি করলাম। বেসিন ভরতি হলুদ জল। তাতে ভেসে বেড়াচ্ছে আমার পেট, খাদ্যনালী থেকে উঠে আসা ছোট ছোট ময়দার মঞ্জু, অপাচ্য চিকেন আর সবজির টুকরো। আমার মুখ দিয়ে টপটপ করে লালা পড়ছে। টি শার্টে বমির ছিটে। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি ঋষি দা’কে ডাকতে তার দিকে তাকালাম।
তাকিয়ে দেখলাম ঋষি দা বোর্ডের গুটিগুলোকে একটা একটা করে খুব সাবধানে তুলে হাতের প্যাকেটে ভরছে। আমার দিকে খুব শান্ত চোখে তাকাল, বলল, “গতবার ভুটানে গিয়ে এক বেদেনীর কাছ থেকে বিষটা কিনেছিলাম জানিস। বুনো ক্যাকটাসের নির্যাস থেকে তৈরি এই বিষ ওরা দেশীয় ওষুধ তৈরির কাজে লাগায়। বলা হয় এর কয়েক ফোঁটাই মানুষকে প্যারালাইসড করে দিতে যথেষ্ট, আর সেখানে তো তোকে আমি…. সন্দেহটা অনেক দিন ধরে হচ্ছিল জানিস। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম। বেসিক, সবকিছুর একটা বেসিক থাকে দেবু। সেই বেসিকটাই নষ্ট করে ফেলেছিলি তুই। গতরাত থেকে এই দাবার একটা একটা গুটিতে বসে বসে বিষটা মাখিয়েছি। তারপর এল তোর পিৎজা।
টেনশন হলেই তোর দাঁত দিয়ে নখ কাটার ব্যাপারটা জানাই ছিল। কাজটা সহজ হয়ে গেল। এই বিষের আসল কাজ কী জানিস! তুই বেঁচে থাকবি। এইভাবে পঙ্গু হয়ে, পাথরের মতো বেঁচে থাকবি। ততক্ষণ বেঁচে থাকবি, যতক্ষণ না তুই মরে যাস।”
আমি খেলাটায় হেরে গেছি। দড়াম করে চিৎ হয়ে বেসিনের নিচে পড়লাম। মাথার পিছনটা ধাক্কা খেয়ে থাপ করে একটা আওয়াজ হল। মনে হল ফেটে গেল। কিন্তু কিছু অনুভূত হচ্ছিল না।
ঋষি দা আমাকে ডিঙিয়ে বেসিনে হাতটাত ধুয়ে, আমারই সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। বলল, “ব্যাপারটা প্রথমে জানতে পেরে মনে হয়েছিল যেন আমার পৃথিবীটা শেষ হয়ে গেল। পাগলের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল গৌতমীকেই এই বিষ খাওয়াই। তারপর ভাবলাম ওকে কেন? ওকেই কেন? তুই, তুই তো সব সাজিয়েছিস। কেন? কেন এই খেলাটা খেললি আমার সাথে দেবু? তোকে ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসতাম বিশ্বাস বিশ্বাস করেছিলাম – এই বেসিকটাই ভুলে গেলি?”
আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম। কোনও কিছু কানে পরিষ্কারভাবে ঢুকছিল না। মনে হচ্ছিল ঋষি দা’র কথাগুলো যেন অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে আসছে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে হিসহিস করে ক’টা কথা ছুঁড়ে দিল ঋষি দা, “প্রে দেবরাজ, প্রে… দ্যাট ইউ ডাই সুন। প্রার্থনা কর দেবু, মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা কর।”
ছোট্ট একটা কট করে শব্দ। অটো লক হওয়া দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেল।
পড়ে আছি। মুহূর্তের পর মুহূর্ত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তৃষ্ণা, অনন্ত তৃষ্ণা। কতক্ষণ হল, এক ঘণ্টা? দু’ ঘণ্টা? ছ’ঘণ্টা? একদিন? দু’ দিন? নাকি তারও বেশি?
ঘরে কীসব যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। ছোট ছোট প্রাণী। তারা ঘুরছে ফিরছে। আমার পায়ে, আমার গায়ে কামড়াচ্ছে, কচকচ করে কী যেন খাচ্ছে। কী খাচ্ছে ওরা? ফেলে রাখা পিৎজা নাকি আমার মাংস?
কী যেন এক খচখচানি ছিল মনের মধ্যে? হ্যাঁ, মনে পড়ল সেই খচখচানির ব্যাপারটা। বৃষ্টিতে গৌতমী ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারবে কি না তার খচখচানি। এক ভোররাতে মুম্বই টার্মিনালে আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে গৌতমী। ক’দিন আগেই ওর নগ্ন সাদা বুকে মাথা রেখে আমি যে বলছিলাম, “অ্যামাজনের ঘন জঙ্গল, সেখানে একটা নৌকার মধ্যে এক নিঃস্তব্ধ একাকী চাঁদনি রাতে তুমি আর আমি। ঠিক যেন সহদেব গুণের সাজানো এক উপন্যাস……
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.