তমোঘ্ন নস্কর এর রুনু Runu pdf পড়ুন এখান থেকে।
রুনু Runu pdf পড়ুন
বাসস্ট্যাণ্ডে নামতে না নামতেই মুষলধারে বৃষ্টি নামল তাড়াতাড়ি পা চালালাম আমি। আমি অসিত। লোকালট এতটা লেট করল না, সব সুপার ফাস্ট বাসগুলো মিস হল। অবশ্য আমারও একটু দোষ হয়েছে, ফেরার পথে বাজার থেকে এই মাছ, কাঁকড়াগুলো না কিনলেই হত, কিন্তু এমন সুন্দর কাঁকড়া আর জলছেঁচা মাছগুলো দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। ওতেই আগের ট্রেনটা মিস হয়ে গেল।
যাই হোক সেসব কথা না ভাবলেও চলবে। আপাতত কোনও ভ্যান রিক্সা পাওয়া যায় কিনা সেটাই দেখতে হবে। মেয়ের জন্য তুলোর পুতুলটা কিনেছি। ওইটা না ভিজলেই ভালো। রিক্সা একখানা পেয়েও গেলাম। পুরানো প্যাডেল রিক্সা চালক তবেত চাচা। চাচা প্রাচীন লোক, মোটর রিক্সার যুগেও সেই পুরানো প্যাডেলেই আছে। টুকুর টুকুর করে সওয়ারির সাথে গল্প করতে করতে পথ চলে।
চাচা প্লাস্টিকের আড়ালে বিড়ি নিয়ে বসেছিল। আমাকে দেখেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। আমি বুঝলাম, আজ চাচার পকেটের হাল খারাপ। অবশ্য এই বৃষ্টিতে কে-ই বা বেরিয়েছে তাও এই করোনা কালে।
রতনপুরের কালভার্টটা পেরিয়েছি সবে চাচা কথা শুরু করল, “দাদাবাবু কি অফিস থেকে আসছ? এই করুণার সময় অফিস যেতে হচ্ছে। গরমেন্ট বলল সব নাকি ছুটি যে….
“হ্যাঁ তা যেতে হচ্ছে বৈকি। সপ্তাহে তিন দিন যাই। দূরে বলে একটানা তিনদিন। বুধবার থেকে আমার শুরু হয়। বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র এই তিন দিন আমি করি। বুধবার গিয়ে অফিসেই থাকি। আবার শুক্রবার দিন অফিস করে বেরিয়ে আসি। আজ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। আর ট্রেনের ও যেরকম গ্যাপ। ভালো করে চালু না হলে বড় সমস্যা, বুঝলে।”
অন্ধকার কালিগোলা সন্ধ্যা, চড়বড় করে ফোঁটা ঝরে যাচ্ছে কেবল। রিক্সার সামনে একটা ছোট্ট এলইডি লাগানো আছে। তাতেও রাস্তা খুব একটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে দু’ একটা ইতিউতি মোটরবাইক ছুটে যাচ্ছে বটে কিন্তু তাতে যেন নৈঃশব্দ্য বেড়ে যাচ্ছে আরও।
আপনমনে বকতে বকতে কাকা রিকশা চালাচ্ছিল। আমিও এটা ওটা ভাবতে ভাবতে স্বভাব বশে নাক খুটছিলাম। আচমকাই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল রিক্সাটা। প্যাডেল রিক্সা বলে খুব জোরে ধাক্কা খেলাম না, কিন্তু আমার হাতখানা সজোরে লাগল পাশের রঙে। প্লাস্টিকের পর্দার ফাঁক থেকে সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটা বিড়াল রাস্তার এপার থেকে ওপারে চলে গেল। মনে মনে একটু বিরক্ত হলাম, চাচার চোখও গেছে, ধুস! আর মিনিট পাঁচেক পাঁড়ের মুদিখানা দোকানের শেডে দাঁড়ালেই হত, মোটর রিক্সা একটা না একটা পেয়েই যেতাম।
বিরক্তিটা আরও বাড়িয়ে দিল চাচার এরপরের ঘোষণাটা – রিক্সার চেন পড়ে গেছে। কাকা চেনটা তুলবে কিন্তু তার জন্য মোবাইলের আলো হাতে আমাকে নিচে নেমে আসতে হবে। চাচাকে আলো দেখাতে হবে। মাথাটা দুম করে গরম হয়ে উঠল, কিছু বলব ভেবেছিলাম তারপর নিজেই নিজেকে সামলে নিলাম। বাবার সাথে সেই বাচ্চাবেলা থেকে চাচার রিকশাতে উঠছি। চাচা কতবার আমাকে স্কুলে পরীক্ষা দিতে নিয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এমন লোককে কিছু বলাটা অশোভন হয়ে যাবে। চুপচাপ কোনও কথা না বাড়িয়ে রিকশায় প্যাকেটগুলো রেখে নেমে এলাম।
চাচা একা পারল না, আমিও হাত লাগালাম। মিনিট পাঁচেকের চেষ্টায় চেনটা তুলে পকেট থেকে স্যানিটাইজার বের করে হাতটা কচলাতে যাব, এমন সময় পাশ থেকে হুশ করে বেরিয়ে যাওয়া বাইকটার সওয়ারি দুজনের টুকরো করা কথা কানে এল। ভদ্রলোক বলছেন, “আজব শালা, এই বৃষ্টির দিনে পোষা নিয়ে রিকশায় ঘুরতে বেরিয়েছে রে!” তড়াক করে লাফিয়ে উঠে রিক্সার ভিতর চোখ রাখলাম। অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম দৃশ্যটা। রিকশায় আমার সিটের বসে আছে প্রাণীটা।
ধুন্ধুমার pdf – তমোঘ্ন নস্কর Dhundhumar pdf by Tamoghn Naskar
অবস্থা অন্ধকারের মধ্যে তার চেহারা দেখ কিন্তু তার সবজেটে চোখ দুটো এলইডির মতো জ্বল করছে। আমাকে দেখেই কেমন অদ্ভুত স্বরে ফ্যাঁস’ করে উঠে বিক্সার পিছন দিকের ফাঁক গলে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ল। প্রাণীটা চাচার ঘাড়ের উপর দিয়ে লাফ মেরে রাস্তার ওপারে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল নিমেষে। চাচা তড়িঘড়ি বা লক্ষণ তো ভালো নয়। বিলাইটা রাস্তার উপরে ছিল। কীভাবে এদিকে এল! তুমি কি মাছটাছ কিনেছ নাকি? না হলে কীসের গন্ধে ব্যাটা এরকম উঠে এলা
আমার মাথা তখন গরম হয়ে আছে। তবে মোবাইলের টর্চ মেরে দেখেছি – গিট বাঁধা প্লাস্টিকগুলোর কোনও ক্ষতি হয়নি। আঁচড় টাঁচড়ও দিতে পারেনি। সবে হয়ত উঠেছিল। তবে এবারে আর মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। বললাম, “বিড়ালের আর দোষ কী তোমার মান্ধাতার আমলের রিক্সার চেন রাস্তায় পড়ে গেলে? মাছের গন্ধে বিড়াল তো আসবেই। চালাও এখন।”
চাচা এই পরিস্থিতিতে বিশেষ সন্তুষ্ট হল বলে মনে হল। না। অবশিষ্ট পথ বিড়বিড় করতে করতে প্যাডেল চালাল।
বাড়ির সামনে নামিয়ে আমতা আমতা করে চাচা বলল, দাদাবাবু একটু সাবধানে থাকবে। তোমার সাথে মাছ ছিল তুমি বলেনি। জানলে মুদির দোকান থেকে একটু নুন লঙ্কা চেয়ে নিতাম। বর্ষার খাল পারিয়ে এলাম, কত কী ভেসে আসে… ভালো ঠেকছে না গো দাদা। বিলাই এরকম উপরে আমার মাথা খানিকটা ঠাণ্ডা হয়েছে ততক্ষণে। লোকটাকে দু চার কথা বলার জন্য একটা অনুতাপের ভাব এসেছে। দশটা টাকা বেশি ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “চাচা কিছু মনে করো না, তখন মাথাটা গরম হয়ে গেছিল। তুমি দোকানে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিজেকে চাঙ্গা করে নাও গো। বৃষ্টিতে একদম ভিজে গেছ।”
কিন্তু চাচার সেদিকে নজর নেই। তার নজর তখন পিছন নিকে নিবন্ধ।
সে দিকে তাকিয়ে এই প্রথমবার আমার গাটা শিরশির করে উঠল। গ্রামে আমাদের তিনটে বাড়ি পর কমল কাকাদের বাড়ি। বাড়ির খোলা দালানে বুড়ো পাগলিটা বসে আছে, তাকে ঘিরে বিড়ালগুলো জটলা করছে।
দৃশ্যটা খুব স্বাভাবিক। আমরা এতে অভ্যন্তও। কিন্তু…. আজ যেন বিড়াল দেখেই অস্বস্তি হল।
কাকারা বর্ধমান টাউনে চলে গেছে বহুদিন হল। এই গ্রামের বাড়িটা তালাবন্দি হয়ে পড়ে আছে। বাড়ির সামনে খোলা দালানে পাগলিটা আছে প্রায় মাসতিনেক হল। বিড়ালগুলো সঙ্গেই ওর বেসাতি। পাগল, তার মেয়েমানুষ, আবার এই করোনা পরিস্থিতি বলে গ্রামের মানুষ খুব একটা তাড়া দেয়নি ওকে।
কমল কাকার ছোট ছেলেটা একদিন বাইক নিয়ে এসেছিল। সেও দেখে আপত্তি করেনি।
তাই বুড়ি এখানেই থাকে। বনপাশ টাউন তো দূর, মফস্বলও নয়। একেবারেই গঞ্জ। তাই মানুষজন এখনও অতখানি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়নি। এর ওর বাড়ি থেকে বেঁচে যাওয়া খাবারটা দিয়ে যায় মানুষ। পাগলি আর বিড়ালে ভাগ করে খায়। তবে আজকের এই পরিস্থিতিতে বিড়ালগুলোর লক্ষণ ভয়ের উদ্রেক করেছিল।
ভয়টা চমকাল খুট করে দিল খোলার আওয়াজে। আমাদের কথা শুনে ছোট বোন বেরিয়ে এসেছে। প্লাস্টিকগুলো আলগোছে বোনের হাতে তুলে দিয়ে সোজা বাইরের উঠোন লাগোয়া চান ঘরে ঢুকলাম আমি। করোনা আবহ’তে এখন এই নিয়মটা আমি মেনে চলছি। বাইরে থেকে এলে একেবারে এই চান ঘর থেকে স্নানটান সেরে জামা কাপড় ভিজিয়ে তবে ঘরে ঢুকি। একে তো ঠাকুরমা আছেন। বাবা মা’র বয়স হয়েছে আর দ্বিতীয়ত, প্রমিতা মানে আমার স্ত্রী দ্বিতীয়বারের জন্য গর্ভবতী। এই অবস্থায় কোনরকম ঝুঁকি নেওয়া উচিত-ই নয়।
স্নানঘর থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম মা তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি জুড়েছে। কারণটা কী ঠিক বোধগম্য হল না। হুড়াস হুড়াস করে জল ঢেলে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে আসতেই মা হামলে পড়ল, “তোর আক্কেল জ্ঞান কী হবে না বাবু! বউমার এই অবস্থা, তার মধ্যে ভর সন্ধ্যাবেলায় তুই মাছ কিনে আনলি? জানিস …”
“থাক থাক ৩ নাম আর মুখে উচ্চারণ করতে হবে না।” ঠাকুরমা বেরিয়ে এসে মাকে থামিয়ে দিলেন। “তুমি বরং গোটা দুই মাছ আগে ভেজে তুলে দাও। আমি খিড়কি দিয়ে বাইরে গিয়ে রেখে আসি। আর ও প্রসঙ্গ তুলোনি। আর বউমারে ওইসব মাছ খেতে দিওনি।”
সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি একেবারেই ভালো কাটল না। প্রমিতাও দেখলাম কেমন চুপ মেরে গেছে। আমার সাথে সেভাবে ভালোভাবে কথা বলছে না। ধুস, বিরক্তিকর… একটা ভয় যেন ঘরের মধ্যে ঢুকে গেছে।
আমিও সারাজীবন গ্রামে বড় হয়েছি, গ্রামেই থাকি। মাছ নিয়ে আসার টুকটাক সংস্কার যে আমার মধ্যে নেই তা নয়। কিন্তু এতখানি ভয় পাওয়ার কী কারণ আছে তা বুঝলাম না। বিশেষ করে এই আজকালকার দিনের মেয়ে, সারাদিন ইউটিউব আর ফেসবুক করা প্রমিতা যে ভিতর ভিতর এতখানি ভিতু তা তো জানতুম না! দিব্যি গ্র্যাজুয়েশন করা মেয়ের এত সংস্কার!
আমারও যেমন কপাল, কৃষি সমবায় দপ্তরে চাকরি করে হোম ব্রাঞ্চে দশটা বছর কাটিয়ে দিলাম। ইচ্ছা করে প্রমোশন নিলাম না। আর শেষে কিনা করোনা কালেই প্রমোশন দিয়ে বর্ধমান পাঠাল! না বর্ধমানে যাব, না এতরকম ঝক্কি হবে। ধুত্তোর! তবে কাজের কথা একটাই মুন্নির পুতুলটা বেশ পছন্দ হয়েছে। স্যানিটাইজ করে দিতে পুতুলখানা জড়িয়েই ঘুমিয়েছে।
খেতে বসেও গুমোট কাটল না। দেখলাম কারুরই মাছ খাওয়ার বিশেষ ইচ্ছে নেই। শুধু শুধু পাঁচশ’ টাকা গচ্ছা গেল। তবে এই গুমোট যে শুধু শুধু নয় তা টের পেলাম খানিকক্ষণ পরেই।
ঘুমটা এসেছে আধঘন্টা হয়েছে কী হয়নি এমন সময় আচমকাই চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। চিৎকারটা করছে আমার ছোট ভাই অমিত! অমিত নিচের তলায় ডান দিকের শেষ ঘরটায় থাকে। ওখানেই নিরিবিলিতে পড়াশোনা করে আর বারান্দায় টিউশনি করে। চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে, স্বভাবতই বেশি রাত অবধি জেগে পড়াশোনা করে।
কিন্তু অমিতের এরকম করে চিৎকার করার কারণটা কী? কী হল? তড়িঘড়ি আলো জ্বালিয়ে ওদিকে ছুটছিলাম, প্রমিতা হাত চেপে ধরল। তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। পাশের ঘর থেকে বোনকে প্রমিতার কাছে বসিয়ে নিচে গেলাম। মা, বাবা, ঠাকুরমা, মেজো – সবাই উঠে এসেছে।
দেখি বাংলার মুখ pdf – তমোঘ্ন নস্কর Dekhi Bangalr Mukh pdf – Tamoghna Naskar
অমিতের ঘরে ঢুকে দেখি অমিত ঠকঠক করে কাঁপছে আর জানলার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। ছুটে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকার। এদিকের ল্যাম্পপোস্টগুলোর বাল্ব বর্ষাকালে জ্বলে না। জল ঢুকে যায়। টর্চ মারলাম, কিছু নেই! লম্বা ইঁটের রাস্তা বাড়ির পিছন দিয়ে চলে গেছে। যতদূর আলো যায় নীরব, নিস্তব্ধ, নিঝুম।
অমিত একটু সুস্থ হয়ে বলল রাত্রিবেলা গুমোট লাগছিল বলে পিছন দিকের জানলাটা খুলে দিয়েছিল। পিছন দিক দিয়ে খুব একটা বৃষ্টির ছাঁট আসে না। তাই এই জানালাটা খুলেছিল। পড়তে পড়তে হঠাৎই খচমচ করে আওয়াজ পায়। জানালার দিক দিয়েই আসছে আওয়াজটা। জানালা দিয়ে টর্চ মারে এবং তাতেই ও দৃশ্যটা দেখতে পায়। কেউ একজন উবু হয়ে ঠাকুরমার রেখে যাওয়া মাছ খাচ্ছিল! ও আলো ফেলতেই সে লাফিয়ে সড়সড় করে দত্ত’দের পোড়ো পাঁচিল বেয়ে পালিয়ে যায়। এই দেখেই তার চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল।
মেজভাই তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরিয়ে দেখতে যাচ্ছিল। ভেবেছিল, নির্ঘাৎ এ পাগলির কাজ। কিন্তু ঠাকুরমা বাধা দিলেন। বললেন, “রাতে পিছন দিকে কেউ কেন আসতে যাবে? পাগলি তো আর কমলদের বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারবে না। তোমার কি মনে হয় এমন বাদলার রাতে এত ঘুরে আমাদের বাড়ির পিছনদিকে পাগলি আসবে! যা হওয়ার তা হয়েছে! দত্ত’দের এই পোড়ো ঘরটাই আগামী দিনে আমাদের বুকের কাঁটা হবে। এখন ঠাকুর নাম নিয়ে সবাই শোও গে’ যাও।”
সে রাতে ছোটকে আর একা ছাড়া হল না। মেজো ওর সঙ্গে শুল। কিন্তু সারারাত কিছুতেই ঘুম এল না আমার। রাত্রে যতবারই চোখ বুজি, ছোটর সেই চিৎকার যেন কানে ভেসে আসে।
ভোররাতের দিকে একবার প্রস্রাব পেল। বিয়ের পরে উপরের ঘরে আমি লাগোয়া বাথরুম বানিয়েছিলাম। সেখানেই ঢুকলাম আর সেখানে ঢুকেই আমার দ্বিতীয় ঘা’টা লাগল।
বাথরুম থেকে সাত হাত দূরত্বে দত্ত’দের ঝোলা বারান্দা। মাঝে কেবল ফুট ছয়েকের গলি রাস্তা। পুরানো জায়গায় যা হয় ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি।
বাথরুমে বসে পরিষ্কার শুনলাম, ঝোলা বারান্দায় কেউ জোরে জোরে পা ফেলে হাঁটছে। রীতিমত ‘ধপ’ ‘ধপ’ করে আওয়াজ হচ্ছে। দত্তদের বাড়িটা পোড়ো। অন্তত আমি আমার জন্ম থেকে এই বাড়িতে কোনদিন কাউকে আসতে দেখিনি। এত রাতে ওই বিপজ্জনক ঝুল বারান্দা দিয়ে কে হাঁটতে পারে – তা ভেবে উঠতে পারলাম না! পা’টা শিরশির করে উঠল। কোনমতে হাত বাড়িয়ে জানালার শার্সিখানা টেনে বন্ধ করে দিলাম।
এরপর আমাদের বাড়িতে শুরু হল উৎপাত। এমন উৎপাত যে বাড়িতে টেকা দায় হয়ে গেল। ঠাকুরমা শোওয়ার আগে একবার বাইরে যান। ঠাকুরমার আমাদের ইংলিশ ল্যাট্রিন পছন্দ হয় না। তাই বাইরের কলঘরে যান।
সদ্যই খেয়ে উঠেছি। তখনও কেউ শুইনি। সবাই আমরা বারান্দায় পায়চারি করছি। ঠাকুরমা আমাদের সামনে দিয়েই উঠোনে কলঘরের দিকে যাচ্ছেন। বাবা উঠোনে দু’পা নেমে ব্রাশ করছেন। এমন সময় হঠাৎ করেই যেন ঝড় উঠল। ঝড় বলা ভুল, শুধু আমাদের পাঁচিলের লাগোয়া কয়েতবেল গাছটায় যেন সাড়া জাগল। তারপরে সপাটে নেমে এল কিছু। বাবা কোনমতে ঠাকুরমাকে টেনে সরিয়ে নিলেন। জিনিসটা উঠানে পড়ে ফট করে ফেটে গেল। দেখলাম একখানা কয়েতবেল ছুঁড়ে মারা হয়েছে। আর একটু এদিক ওদিক হলেই ঠাকুরমার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যেত। কিন্তু… এত রাতে কে-ই বা এই কয়েতবেল গাছে উঠবে? আর কে-ই বা কয়েতবেল ছুঁড়ে মারবে! আর প্রবৃদ্ধা ঠাকুরমার মাথায় ছুঁড়ে মেরে লাভটা কী হবে! আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
শুধু এক প্রচণ্ড ভয়ে আমাদের গোটা বাড়িই ঘর ঘর করে কাঁপতে লাগল। আমরা বুঝতে পারছি, যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু উপায় কী! ঠাকুরমা ঘরে ঢুকে বললেন, অসিত তুমি সেদিন কাজটা ভালো করোনি। মাছের সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডেকে আনলে আমাদের ঘরে….. এখন ত্রাণ পাব কীভাবে আমি জানি না। এরপরের ঘটনাটা ঘটল মেজভাইয়ের সঙ্গে। মেজভাই দোকান ছেড়ে একটু সন্ধ্যারাতে বাড়ি ফিরত। সেদিন সাইকেল নিয়ে পিছন দিক দিয়ে ফিরছিল। আমাদের বাড়ি আসার আগে হঠাৎ করেই দেখে, একজন মহিলা আমাদের খিড়কির দিক দিয়ে বেরিয়ে দত্ত’দের পাঁচিল বেয়ে টিকটিকির মতো করে উঠে গেলেন। তারপরই ওপারে ‘ধপ’ করে আওয়াজ। সেই দেখে ও আর সাহস পায়নি সোজা সাইকেল ঘুরিয়ে সামনে দিয়ে ঘরে এসেছিল।
রারে তেড়ে জ্বর এল। না করোনার ভয় পাইনি, কারণ আমরা বুঝতে পারছিলাম আমাদের সঙ্গে যা ঘটছে – তা ঠিক ঘটছে না। অন্তত জনাসাতেক লোকের মুখ থেকে আমরা এর মধ্যেই শুনে ফেলেছি আমাদের বাড়ির পিছন দিকে তাঁরা এক মহিলাকে ঘুরতে দেখেছেন। আবছায়া সেই মহিলা আমাদের বাড়ির পিছন দিয়ে ঘুরে বেড়ান। পথচারীর দেখা পেলেই মুহূর্তে উধাও। রাতে নাকি আমাদের খিড়কির দিক দিয়ে কান্নার আওয়াজ আসে। মানুষজন পিছনের রাস্তা দিয়ে চলা বন্ধই করে দিল।
এমনকি যে পাগলি এতদিন ধরে কমল কাকুদের বারান্দায় শুত সেও কিনা আমাদের বাড়ির পাশ থেকে সরে গিয়ে, দূরে পথের ধারে একটা গুমটির ভিতর আশ্রয় নিল! তার বিড়ালগুলো রাতবিরেতে আর ঘোরাঘুরি করে না, শুধু মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড ভয়ে কেঁদে ওঠে।
পাড়ার মধ্যিখানে অবস্থান হয়েও আমাদের বাড়িখানা যেন একলা হয়ে পড়ল। কী এক প্রচণ্ড ভয়ে আমরা সারারাত থরথর করে কাঁপি।
ভরদুপুরে মেলে দেওয়া আমাদের জামাকাপড় হঠাৎ হঠাৎ করে উধাও হয়ে যেতে লাগল! সেই জামাকাপড় আমরা দত্তদের পাঁচিলের উপরে, বাগানে পড়ে থাকতে দেখতাম। কোনও কোনদিন আমাদের উঠোনের তারের উপরে প্রচণ্ড ঝনঝন করে আওয়াজ উঠত। কোনদিন ছাদের উপরে দাপাদাপি শুনতাম। মেজো বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধই করে দিয়েছে। এখন ছোট আর বাবা পালা করে দোকানে যায়। মেজো, মা, বোন আর ঠাকুরমার কাছে বসে থাকে। আমার অবস্থা আরো সঙ্গীন। গর্ভবতী স্ত্রী আর বাচ্চা মেয়ে নিয়ে কী যে করব কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
শেষমেশ শ্বশুরবাড়িতে জানালাম। উদ্দেশ্য বাড়িতে একটু লোকজন বাড়ানো। শ্যালক, শ্যালিকাটি অনলাইন কলেজ করছে। ভ্রমণে তাদের সমস্যা নেই। যদি দিনকয়েক থাকে, বাড়িটা একটু ভরাট থাকে। আমরাও দুটো লোক বাড়লে সাহস পাই। যাক কিছুদিন, দেখা যাক কী হয়।
শ্বশুরবাড়ি থেকে লোকজন এসেছে দেখে আমি অফিসে গিয়েছিলাম। যথারীতি তিনদিন কাটিয়ে ফিরছি। আবার তবেত চাচার রিক্সা পেয়েছি। মন মেজাজ খারাপ, তাই অপেক্ষা না করেই এটাতেই উঠে পড়েছি। চাচা এটা ওটা বলছেন, কিন্তু সেদিকে নজর নেই।
বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে হঠাৎ করেই কেমন যেন অস্বস্তি শুরু হল। তবেয়ত চাচাও রিকশাটা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ আমাদের সদর দরজা দিয়ে একজন মহিলা এলোচুলে হনহন করে বেরিয়ে এলেন। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে যেন কেমন দৌড়ে কমল কাকুদের বাড়ির পিছনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। দূরের গাছগুলোয় পাখিরা কলকলিয়ে উঠল।
আমি রিক্সা থেকে নেমে, “এই কে আপনি…” বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়াতে যাচ্ছিলাম। তবেয়ত চাচা আমার হাত ধরে ফেলল, “বাবু তুমি কী করতে যাচ্ছ। এখনও কি বুঝতে পারছনা ও কী! এই দরজা দিয়ে কি মানুষ বাহির হয়?”
এতক্ষণে আমি দরজার দিকে তাকালাম। দরজা সামান্য আলতো ফাঁক করা। ভালো করে দেখলে বোঝা যায় এ ফাঁক নয়। কাঠের পুরানো দরজা অল্প ফাঁক হয়েই থাকে, এ তাই। তবে এই ফাঁক দিয়ে কুকুর, বেড়াল ছাড়া আর যাই হোক মানুষ বাইরে আসতে পারে না।
নিমেষে আমার শরীর ঘেমে উঠল। আমি চাচার হাত ধরে রিক্সার পাদানির ওপর ধপ করে বসে পড়লাম।
চাচা হাত ধরে বলল, “ক’দিন হচ্ছে বাবু? যদি আমার খুব ভুল না হয়, সেদিন থেকেই এই অশান্তি শুরু হয়েছে?” আমি কিছু বলতে পারলাম না। আস্তে আস্তে মাথা নাড়লাম কেবল।
চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “কত কী রয়েছে। তাদের কত খিদে, চাওয়া, ইচ্ছা রয়ে যায়। আমরা কতটুক আর নিতে পারি। তাই তো আমাদের একটু সামলে থাকতে হয়। মারা যাবার পরে মানুষের কী আর ভালো মন্দ জ্ঞান থাকে? তাদের তো আমরাই… যাক গে যাক, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, উপায় ভাবতে হবে। ”
এমন সময়ে বাড়ির ভিতর থেকে বিষম শোরগোল উঠল। আমি আর চাচা রিকশা থেকে নেমে দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। আমাদের দেখাদেখি আশেপাশের বাড়ি থেকেও প্রতিবেশীরাও চলে এসেছেন। বাবা দরজা খুলে দিলেন। ভিতরে তখন কান্নাকাটি পড়ে গেছে।
ঠাকুরমা উঠানে পড়ে আছেন। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। হাত পা সমানে ছটফট করে যাচ্ছেন। জানা গেল, মশা হয়েছে বলে ঠাকুরমা ডিমের ট্রে আনতে এসেছিলেন উঠানে। তারপর আচমকাই চিৎকার ও ‘ধপ’ করে আওয়াজ পান।
ঘটনাটির সময় যা বুঝলাম আমরা যে সময় ওঁকে দেখেছি, সেই সময়ই ঘটেছে। কিন্তু এখন ভাবার কী করা যায়। প্রতিবেশীরা যে যার মতো বিধান দিতে লেগেছেন। কেউ বলছেন মুন্সী, কেউ বলছেন কহড়া…..
চাচা স্থির ছিল না। কলতলা থেকে মগে করে জল এনে, ছড়া দিতে লেগেছিল উঠানে। তারপর হাতের চেটো দিয়ে ঠাকুরমার পাশে বিঘতখানেক জায়গা মুছে নিয়ে নিজে হাত পা ধুয়ে বসে পড়েছিল। এরপর বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়া শুরু করল আর সেই সাথে ঠাকুরমার শরীরের ইঞ্চি ছয়েক উপরে হাত রেখে বোলাতে লাগল বাতাসে।
মুহূর্তে জায়গাটা আঁশটে গন্ধে ভরে উঠল। যেন মাছ বাজারে এসে পড়েছি আমরা। চাচা মন্ত্র পড়া থামাল না। মিনিটপাঁচেক পর উঠে দাঁড়িয়ে, কানে মাথায় হাত স্পর্শ করে বলল, “বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।”
(অর্থাৎ – আমি এলাম ও বেরলাম আল্লাহ্। তুমিই একমাত্র আমার সহায়। শয়তান থেকে আমাকে রক্ষা কর। দূরে রাখ। (মিশকাত-২৪৪৩)
মুহূর্তেই সব গন্ধ কেটে গেল। সব যেন স্বাভাবিক হয়ে গেল আবার। চাচা বলল, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম- নিয়ে সূরা পড়ছি। সব বাধা কেটে যাবে। শুধু কারণটা জানা লাগব। উনি সাড়ে এলেই সব জানা যাবে।”
মিনিট দশেক পরে ঠাকুরমার সাড়ে ফিরে এসেছিলেন এবং শুনিয়েছিলেন এক আশ্চর্য কাহিনী। ঠাকুরমা ডিমের ট্রেগুলি তুলে লাইটারটি দিয়ে আগুন ধরাতে যাবেন এমন সময় তার সামনেটায় যেন হঠাৎ করেই সব অন্ধকার হয়ে যায়। আর সেই অন্ধকার থেকে তিনি একটি খঙখণ্ডে গলার আওয়াজ পান। যেন অন্ধকারের একটা নিরেট চোঙা থেকে আওয়াজটা ভেসে আসছে। তবে সে আওয়াজ চেনা যায়। এ আর কারুর নয়, রানু পিসির আওয়াজ। রানু পিসি আমাদের দূর-সম্পর্কের পিসিমা হন। আমার নিজের পিসির ননদ। আমার পিসির সঙ্গে প্রায়ই আসতেন। আসলে অকাল বৈধব্যের পর দাদাদের বাড়িতেই থাকতেন। সেই জন্য বউদিদের সঙ্গে তাঁদের বাপের বাড়িতেও তাঁদের বোনের মতো আসতেন। আমরা সবাই… বিশেষ করে আমার ঠাকুরমা বড় ভালোবাসতেন রানু পিসিকে। নিজের মেয়ের থেকে আলাদা দেখেননি কখনও।
সেই রানু পিসি এসেছেন। তবে পিসি হয়ে নয়, প্রেত হয়ে…
রানু পিসি মারা গেছেন আজ মাসতিনেক হল। সেই মারা যাওয়াটাও বড় মর্মান্তিক। পিসির কোনও সন্তানাদি ছিল না, হওয়ার সুযোগও হয়নি। পিসেমশাই বিবাহের তিনমাসের মাথাতেই মারা যান। আমার পিসি পিসেমশাইরা আস্তে আস্তে কলকাতায় দাদাদের কাছে ফ্ল্যাটে উঠে এলেও রানু পিসি গ্রামের বাড়িটা আগলে পড়েছিলেন। পিসিরা দুই দাদা বহুবার বলেছেন… কিন্তু উনি সম্ভবত ডাইপোদের সংসারে নতুন করে উঠতে চাননি। পৈত্রিক ভিটায় দাদাদের পাঠিয়ে দেওয়া হাতখরচে আর চাষের টাকা দিয়ে দিব্যি চালিয়ে নিতেন।
পিসিদের গ্রামটাও আমাদের দু’ তিনটে স্টেশন পরে। বাবা কাকারা বলেন, আগে যখন ট্রেন ছিল না এত, খালপাড় দিয়ে গেলে সোজা বামদিকে হেঁটে গেলে এক বেলায় পৌঁছান যেত।
দাদারা প্রতিবছর দুর্গাপূজা এবং অন্যান্য ছুটিছাটায় বাড়ি আসতেন। পিসি পিসে দু’মাসে একবার আসতেনই। এছাড়াও আমরা কাছাকাছি ছিলাম, খোঁজখবর নিতাম। এতদিন কোনও সমস্যা হয়নি। গোল বাধাল করোনা।
মানুষ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। পিসির সাথে আমরা বহুদিন দেখা করতে পারিনি। তারপরে শুরু হল লকডাউন। পিসি জ্বরে পড়লেন, অথচ আমাদের জানাতে পারেননি। সম্ভবত ইচ্ছে-করেই জানাননি। সম্ভবত চাননিযে আমরা এই পরিস্থিতিতে ওঁকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হই। তাছাড়া প্রমিতার গর্ভবর্তী হওয়ার খবরটা উনি জানতেন। যখন জানলাম, চেষ্টা শুরু করলাম, থানা পঞ্চায়েত পারমিশন করাতে-করাতে দেড়দিন চলে গেল। যখন পৌঁছালাম ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অসুস্থ মানুষটাকে খাবার দেয়নি কেউ। অথচ দাহের বেলা বড় রোগের ভয়। দাদারা শ্মশানে গেল। আমি প্রমিতার জন্য যেতে পারলাম না। দূর থেকে দেখলাম। পঞ্চায়েতের লোকজন পিপিই কিট পরে বডি দাহ করছে।
দাদাদের বেশি কাছে যেতে দিল না। তা ছাড়া সার সার মৃতদেহ দেখে নিজেদেরই অসুস্থ লাগছিল। কেউ-ই আর এগোল না। ওরাই দাহ করে অস্থি ইত্যাদি লাঠিতে করে জলে ভাসিয়ে দিল। আধাখ্যাঁচড়া ভাবে, কেমন এক অস্বস্তি আর অসহায়তার মধ্যে দিয়ে চলে গেলেন মানুষটা।
শ্রাদ্ধশান্তি কিছুই ভালোভাবে করা যায়নি। দাদারা শুনেছিলাম কলকাতায় ফিরে গিয়ে কোনমতে গঙ্গার ঘাটে কাজ সেরেছিলেন। ভেবেছিলেন লকডাউন উঠে গিয়ে পরিস্থিতি ঠিক হলে ব্রাহ্মণ ডেকে ভালোভাবে কাজ করাবেন। কিন্তু কাজটা যে কিছুই হয়নি তা বুঝতে পারছিলাম।
পিসি মুক্তি পাননি। ঠাকুরমা বড় ভালোবাসতেন, হয়ত বারে বারে ঠাকুরমার কাছেই ফিরে আসতে চাইছিলেন। ঠাকুরমাকে কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছিলেন। এইবার চাচা বললেন, “জানো তো বাবা, এইজন্য নদী খাল পাড় দিয়ে মাছ মাংস বয়ে আনতে নেই। শেষটা যেহেতু ওখানেই হয়, তাই প্রেতযোনিরা ঘুরে বেড়ান ওর আশেপাশেই। এখন এর ব্যাখ্যা নাই। আমাদের বাপ-দাদারা তাই করে আসছে। সম্ভবত উনিও তাই ছিলেন। এবার কীভাবে তোমার ওপরই নজর পড়ল? আর কেনই বা তুমি সেদিনই রাশ হালকা করে মাছ নিয়ে এলে, তা একমাত্র ওপরওয়ালাই জানেন। হয়ত তাঁর ইচ্ছা ছিল যে মানুষটা মুক্তি পাক। প্রেতযোনি বেশিদিন আমাদের দুনিয়াতে থাকলে, এই দুনিয়ার সমতা ভাঙে। বাতাসের ক্ষতি হয়। তাই হয়ত তোমাকে দিয়েই আনালে।
দ্বিতীয় ব্যাপার হল তোমার বাড়িতে গর্ভবতী স্ত্রীলোক আছেন। গর্ভবতী কেউ থাকলে বাস্তুর বাঁধন আলগা হয়। এইসময় খানিকটা বিধিনিষেধ পালন করতে হয়। জানোই তো, সন্তান জন্ম খোদাতালার পবিত্র চমৎকার। তাই শয়তান এইসময় খুব লকড়া করে। তোমার ঘরের বাঁধন আলগা ছিল, উনি আস্তানা নিয়েছেন। এখন আর করার কিছু নেই। বাস্তুর বাঁধনটিকে পোক্ত করে বেঁধে ফেলতে হবে। সে আমি করে দেবো। তোমরা বেঁধে দেওয়ার সাতদিনের ভিতর তোমাদের মতে উনার একটা ব্যবস্থা করো। কাল সকালে আমি আবার আসব।”
সেদিন রাতে আমরা শুনলাম কান্নার শব্দ। কেউ যেন আমাদের বাড়ির পিছনদিকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এতদিন লোকের মুখে শুনেছিলাম, এবার নিজেরা শুনলাম কান্নার আওয়াজ। সবথেকে আশ্চর্য লাগল, মানুষটা যখন বেঁচে ছিলেন তখন তাঁর গলার আওয়াজ কত আপন ছিল, আজ মানুষটা কাঁদছেন আর আমাদের কষ্ট হওয়া দূর, উল্টে একটা প্রচণ্ড ভয় লাগছে! গোটা ঘরশুদ্ধ লোক সে রাতে ঠাকুরঘরে কাটিয়ে দিলাম।
পরদিন বেশ কিছু সরঞ্জাম নিয়ে চাচা এলেন। সঙ্গে চাচার দুই ছেলে। খানিকক্ষণ কিছু প্রক্রিয়া করার পর ঘরটি বেঁধে দিয়ে গেলেন। বেঁধে দেওয়া বলতে আমাদের বাস্তুর চার কোণে চারটি মাঝারি কীল পুঁতে দিয়ে গেলেন। পিছন দিকের দত্তদের পাঁচিলে একটি বড় কীল আর জুতা ঝুলিয়ে দিলেন। একইরকম ভাবে আশেপাশে দু’চারটে যে বড় ঝাঁকড়া গাছ ছিল তাদের গায়ে পুরানো ছেঁড়া চপ্পল আর পেরেক গেঁথে চাচা ঘরের ভিতর ঢুকলেন।
আমাদের কালো সুতায় বাঁধা গোটা দশেক তাবিজ দিয়ে বললেন, “আগামী এক মাস হাতে রাখবে। তারপর কোনও পুকুরে গিয়ে পাড়ের দিকে মাটিতে পুঁতে দিয়ে চান করে উঠে আসবে।”
আমরা টাকা দিতে চাইলাম।
চাচা হাঁ হাঁ করে উঠলেন, বললেন, “এসব আমি নিতে পারব না। এ বিদ্যা গুরুর দান। আমার পীরবাপের কাছ থেকে পাওয়া। বাপ কারুকে ঝাড়িয়ে তারিয়ে পয়সা নিত না। আমিও নেই না। পয়সার জন্য রিকশা চালাই, ওপরওয়ালার কৃপায় ওতেই আমার চলে যায়। কিন্তু আমি সাত দিনের বেশি বেঁধে রাখতে পারব না। এরমধ্যে তোমরা তোমাদের ধর্মমতে ওঁর শান্তির জন্য যা যা করার করে ফেলো।
আর দিতেই যদি চাও, কাজ হয়ে গেলে বাবার মাজারে একটা চাদর চড়িও।”
***
আজ আরও চারমাস পেরিয়েছে। প্রমিতা আর পুচুকে নিয়ে সকালে ঘরে ঢুকেছি। ঠাকুরমা এলেন। তোয়ালে মোড়া পুচুকে কোলে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “খোকা, ভালো নাম কী রাখবি জানি না, তবে ডাকনামটা ‘রুনু’ রাখিস।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.