মঞ্জরীর গায়ে হলুদ – শ্রীজাত Monjarir Gaye Holud by Srijato

মঞ্জরীর গায়ে হলুদ - শ্রীজাত Monjarir Gaye Holud by Srijato

শ্রীজাতের গল্প মঞ্জরীর গায়ে হলুদ Monjarir Gaye Holud পড়ুন নিচে থেকে। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

মঞ্জরীর গায়ে হলুদ - শ্রীজাত Monjarir Gaye Holud by Srijatoমঞ্জরীর গায়ে হলুদ

বিয়ে করলে সে মেসিকেই বিয়ে করবে, এটা মঞ্জরী ঠিক করে নিয়েছে। আজ নয়, অনেকদিন। এখন তো সে বড় মানুষ, এই ফাল্গুনে ষোলোয় পা দিয়েছে। যখন তার মাত্র পাঁচ কী সাড়ে পাঁচ বছর বয়স, তখনই সে মেসিকে মনে-মনে নিজের বর বলে মেনে নেয়। লিওনেল মেসি, ফুটবলের রাজপুত্র, মঞ্জরীর বর, বর্ধমানের জামাই। বর্ধমান বললে ব্যাপারটা গর্বের শোনায় ঠিকই, যদিও মঞ্জরীদের বাড়ি বর্ধমানের এক প্রান্তে, ধুলোমাটি উড়তে থাকা একখানা গ্রামে। সত্যি বলতে কী, বর্ধমান শহরেই সে মাত্র বারকয়েক গিয়েছে, বাবার হাত ধরে। কিন্তু হ্যাঁ, মেসির মতো একজনের সঙ্গে বিয়ে হলে কি আর গোটা বর্ধমানই তাকে চিনবে না?

ওই যে যখন তার পাঁচ কি সাড়ে পাঁচ, একসঙ্গে দুটো ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল। গ্রামে রন্টিদের বাড়িতে বেশি পয়সার কেবল লাইন নেওয়া, সেখানে খেলার চ্যানেলগুলো দেয়। ইন্ডিয়ার খেলা হলে লোকজন জমে, কাপে কাপে চা বানায় রন্টির মা। তা কোনও একবার ভাইফোঁটায় বোনহীন রন্টিকে ফোঁটা দেওয়ার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভাইহীন মঞ্জরীকে। রন্টির দাদা ঘণ্টি তখন টিভি চালিয়ে হাঁ হয়ে ইউরো কাপ ফাইনাল দেখছে। বসার ঘরেই টিভি, মঞ্জরী তার মায়ের হাত ধরে, একটা রেকাবিতে চন্দন বাটা, দুব্বো ঘাস, এইসব নিয়ে ভিতরের ঘরে ঢোকার আগেই একজনকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। রাজপুত্রের মতো দেখতে সেই লোকটা সারা মাঠে আগুন জ্বেলে দিয়ে ছবির মতো একটা গোল করে সোজা মঞ্জরীর দিকে তাকাল। সো-ও-জা।

বিষহরি pdf – তমোঘ্ন নস্কর Bishhari pdf – Tamoghna Naskar

এ খেলা কোথায় হচ্ছে মঞ্জরী জানে না, এই রাজপুত্তুর কে, সেও তার জানা নেই। তার সঙ্গে কেবল ক্যামেরার মারফত একখানা চোখাচোখি হয়ে গেল সেই ফরসাপানা যুবকের। ওই দুপুরেই মেসিকে নিজের হিরো বানিয়ে ফেলল মঞ্জুরী আর সন্ধেবেলা টারজানের অ্যাডভেঞ্চার বইটা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করল, এই রাজপুত্তুরের কাছে একদিন না একদিন পৌঁছতেই হবে। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

এখন এই যে মন দেওয়া, কাউকে নিজের নায়ক বা আদর্শ বলে মেনে নেওয়া, এইটা সে সদ্য শিখেছিল। মীরাবাঈয়ের আখ্যান পড়ে। যিনি সেই ছোট্টটি থেকে কৃষ্ণকে নিজের সখা হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। ইস্কুলে পড়ানো হয়েছে এইসব। তা নিয়ে আলাদা করে কোনও মাথাব্যথা ছিল না মঞ্জরীর। কিন্তু রন্টিদের টিভিতে স্বয়ং মেসিকে দৌড়ে বেড়াতে দেখে সে বুঝতে পারল, এই লোকটাই তার কৃষ্ণ। বাঁশি আর ময়ূরের পালক খুলে খেলতে নেমেছে, এমনকী ভাল করে দেখলে স্টেডিয়ামের বাইরে গোরুর পালও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে নির্ঘাত। মীরারও বছর পাঁচেক বয়স ছিল তখন, এখন মঞ্জরীরও তাই। মন দেওয়ার আদর্শ সময়। টুক করে নিজের মন, মেসিকে দিয়ে বসে থাকল মঞ্জরী।

নামটা তার রেখেছিলেন মা। এই গ্রামে আর কারও নাম মঞ্জরী নয়। এমনকী, টাউনের দিকেও মঞ্জরী নামের কাউকে তারা চেনে না। তাই এ গ্রামে মঞ্জরীর এমনিতেই গর্ব করার একটা ব্যাপার আছে। মা বরাবর খুব চুপচাপ মানুষ, ঘরকন্না আর বই নিয়ে থাকেন। বাবা একটা ছোট্ট সরকারি চাকরি করেন আর বাদবাকি সময়ে রেডিয়ো শোনেন। একা একা বসে। বাবার সঙ্গে মায়ের বেশি কথা নেই, এটা খেয়াল করে দেখেছে মঞ্জরী। আর যেটা খেয়াল করেছে সেই ছেলেবেলা থেকেই, মায়েরও একজন সথা আছেন। ক্যালেন্ডারে তাঁকে দেখা যায়।

আলখাল্লা পরা, ইয়াবড় দাড়ি তাঁর। মা দু’বেলা তাঁর পুজো আচ্চা করেন, মন থেকে তাঁকেই আদর্শ বলে মানেন, এরকম সন্দেহ মঞ্জরীর বারকয়েক হয়েছে। পরে অবশ্য ‘সহজ পাঠ’-এর সবক’টা ভাগ পড়ে লোকটাকে তারও ভাল লেগে গিয়েছে। মনে-মনে তাঁকে নিজের মায়ের নায়ক বলে ভাবতে এখন আর মন্দ লাগে না তেমন। সে হোক গে তিনি মায়ের সখা, মঞ্জরীর মন বাঁধা আছে স্পাইক পরা পায়ের গোছে, যেভাবে গাছের গুঁড়িতে বাঁধা থাকে মানতের ঢিল। মেসি হয়তো সহজ পাঠ লিখতে পারবে না, কিন্তু রবি ঠাকুরই কি ওইরকম গোল দিতে পারতেন? মনে মনে এই লড়াইটা চালিয়ে নিজেকেই বেশি নম্বর দেয় মঞ্জরী।

তাদের বাড়িতে অবশ্য কেউ কোনওকালে মাঠে নামেনি। বাবার দিকেও না, মায়ের দিকেও না। মেসির প্রতি এই যে উদাত্ত পূর্বরাগ মঞ্জরীর, তা কিন্তু হাতে-কলমে মাঠে নেমে ফুটবল খেলার থেকেই এসেছে। চার বছর বয়স থেকেই পায়ের কাছে যা পেত মঞ্জুরী, সটান লাথি মারত। এলেবেলে লাথি নয়, বাড়ির উঠোনে একটা কাঠি দিয়ে দেওয়ালে দুটো দাগ কেটে তার মধ্যেকার স্পেসে টিপ করে মারত। অব্যর্থ টিপ ছিল মঞ্জরী’র বাঁ পায়ে, ওই চার বছর থেকেই। এই করে সে একটা কাচের ফুলদানি, দুটো চায়ের কাপ, একটা বাহারি ছাইদান আর তিনখানা সর্ষের তেলের শিশি ভাঙার পর বাধ্য হয়ে তাকে একটা ছোট্ট ফুটবল কিনে দেওয়া হয়েছিল। অতএব মেসিকে যখন সে ভাইফোঁটার দুপুরে নিজের মন দেয়, ততদিনে তার নিজের উঠোনে একশোর বেশি গোল হয়ে গিয়েছে। গোলকিপার ছাড়া অবশ্য।

তাদের ইস্কুলে একটা দেদার মাঠ আছে, কিন্তু সেখানে কেউ ফুটবল খেলে না। চড়কতলার বড় মাঠটায় বিকেলের দিকে অনেকে দল করে করে খেলতে নামে ঠিকই, কিন্তু মেয়েরা কেউ নেই। মেয়েরা তা হলে খেলবে কোথায়? এহেন প্রশ্নে আর ঘ্যানঘ্যানানিতে বাবা আর মাকে প্রায় উন্মাদ করে দেওয়ার পর তাঁরা খোঁজ নিয়ে জানলেন, বর্ধমান টাউন আর তাঁদের বাড়ির মাঝামাঝি একটা আকাদেমি আছে ঠিকই, সেখানে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও ফুটবল শেখানো হয়। মাসে একবার কলকাতা থেকে কোচ আসেন, বাকি সময়টা এখানকার ছেলেমেয়েরাই শেখায়।

এর পর মঞ্জুরীকে আটকে রাখা ছিল অসাধ্য! মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

আটকানোর ইচ্ছে অবশ্য তার মায়ের ছিলই না, বাবা একটু ইতস্তত করেছিলেন কেবল। তাঁর দিকের লোকজন, বিশেষত দিদি আর জামাইবাবুরা বেশ গোঁড়া, বাড়ির মেয়ে ফুটবল লাগাচ্ছে, তাও আবার আকাদেমিতে ভর্তি হয়ে, এ কথা শোনার পর দিদি-জামাইবাবুদের মুখগুলো কীরকম হয়ে উঠবে, সে কথা ভেবেই পিছিয়ে এসেছিলেন মঞ্জরীর বাবা। কিন্তু বছরদশের খুদে মঞ্জুরী টানা দেড়দিন নির্জলা অনশন জারি রাখায় বাধ্য হন আকাডেমিতে নাম লিখিয়ে আসতে। সেই থেকে টানা ছ’বছর, একদিনের জন্যেও আকাডেমির ক্লাস মিস করেনি। মঞ্জরী। মা তাকে নিয়ে যান, নিয়ে আসেন। মাঠের পাশে ‘গীতবিতান’ হাতে বসে থাকেন, মাঝেমধ্যে মেয়ের হল্লা শুনে চোখ তুলে দেখেন, আরও পাঁচজন মেয়ে তার উপরে আদর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, হাসেন একবার, তারপর আবার বইয়ে মুখ ডোবান।

কিন্তু কথা হচ্ছে, সব সিনেমায় ভিলেন থাকে, আর জীবন তো কিছুতেই সিনেমার বাইরে হতে পারে না। এখন, মঞ্জরীর ষোলো বছরের ফুটফুটে সিনেমায় ইন্টারভ্যালের ঠিক আগে ভিলেনের রোল নিয়ে তাদের বাড়িতে থাকতে এলেন বড় পিসিমা। পিসেমশাইও এলেন, কিন্তু পিসির হেডমাস্টারি ব্যক্তিত্বের পাশে রেলের চাকরি থেকে সদ্য রিটায়ার করা পিসেকে প্রায় টেরই পাওয়া যায় না। পিসে নিজেও অবশ্য নিজেকে খুব একটা টের পাওয়াতে চান না, ছোট থেকে এইটাই মনে হয়েছে মঞ্জরীর। পিসি যা বলেন, তাতে “হ্যাঁ হুঁ” দিয়ে আবার খবরের কাগজ পড়তে বসে যান পিসেমশাই, মঞ্জরী খেয়াল করে দেখেছে।

অবশ্য পিসেমশাইকে দোষ দিয়ে আর লাভ কী, বড় পিসিমার মুখের উপর কাউকেই কোনওদিন কথা বলতে শোনা যায়নি। ভাইবোনেদের তিনি প্রায় মায়ের মতোই কোলে- পিঠে করে কড়া শাসনে বড় করেছেন, তাই পিতা-মাতা গত হওয়ার পর সবচেয়ে বড় এই দিদিটিকেই মা-বাবার মিশেল বলে মেনে নিয়েছেন বাকি ভাইবোনেরা। বড়দি কিছু একটা বললেন মানে, বললেন। ব্যস। তার নড়চড় হবে না। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

এখন মুশকিল হচ্ছে, এহেন বড়দি তাদের বাড়িতে এসেও কিছুএকটা বললেন। আর তাই নিয়েই। যত ঝামেলা ম ঞ্জুরীর সিনেমায়। মানে, জীবনে। সুটকেসটুটকেস নিয়ে পিসে আর পিসি তো থাকতে এলেন, তা ভাল। লুচি ছোলার ডাল আর ফুলকপির তরকারি খেলেন, তাও ভাল। কিন্তু যেদিন কাতলা মাছের ঝোল রাঁধলেন মা, সেইদিন খাওয়ার পর মুখে পান ঠুসে পিসিমা বললেন, “মেয়েটা যে ধিঙ্গি হয়েছে, সেদিকে নজর আছে তোমাদের, হ্যাঁ ?”

এরকম ডায়ালগ আগে সিনেমায় শোনা যেত। এখন সিনেমা এগিয়ে গিয়েছে, কিন্তু জীবনে শোনা যায় বটে। বাবা-মাকে চুপ করে থাকতে দেখে পিসি একবার পিসের দিকেই তাকালেন, পিসে সঙ্গে-সঙ্গে নিয়মমাফিক ধুয়ো দিয়ে বললেন, “সেদিকে নজর আছে?” বলেই আবার খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

“চারপাশের অবস্থা তো দেখছ। মেয়েদের কোনও সিকিওরিটি নেই।
কোথাও। তায় আবার তোমাদের মেয়ে ফুটবল খেলে বেড়ায়। খেলাধুলোর বয়েস কি আছে ওর?”
মা কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, পরদর আড়াল থেকে দেখল মঞ্জরী. কিন্তু বাবার ইশারায় চুপ করে গেলেন। পিসিমা অবশ্য চুপ করবার লোকই নন। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

“শোনো, এই তোমাদের জামাইবাবুরই দূরসম্পর্কের আত্মীয়। ভাল বাড়ি, লোকজন ভাল। ছেলে বি এ পাশ, কন্ট্রাক্টরি করে। বর্ধমানে নিজেদের ফ্ল্যাট কিনেছে গত মাসে। লাখে একখানা পাত্র। আমি কিন্তু ভেবেই ফেলেছি। তোমাদের নিজেদের যখন কোনও গা নেই…” এইবার মা মুখ খুললেন, ভারী আলতো স্বরে।
“তা কিন্তু নয় বড়দি। এই তো মাধ্যমিক দেবে। লেখাপড়া করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক, তারপর না হয় আমরা…..
মায়ের আলতো স্বরের কথা শেষ হতে পায় না।

“ওসব সিনেমায় হয়। নিজের পায়ে দাঁড়ানো অত সোজা নয়, বুঝলে? তার উপর তোমাদের মেয়ের পায়ে তো আবার ফুটবল। নাইনের রেজাল্ট কেমন হয়েছে সে কি আমরা জানি না?” মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

নাইনের রেজাল্ট তার খারাপ হয়েছে বটে, মঞ্জরীর মার্কশিটের কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও মনে পড়ল যে এবার আকাদেমির ফাইনাল ম্যাচে সে হ্যাটট্রিক করেছে। তিন নম্বর গোলটা কর্নার কিক রিসিভ করে হেড দিয়ে ডাইভ। কনুইয়ের কাছটা সঙ্গে-সঙ্গে ছড়ে গিয়েছিল। রক্ত মুছে উঠে দাঁড়াতে দেখল বল জালের ভিতর হাবুডুবু খাচ্ছে আর সকলে দৌড়ে আসছে তার দিকে। দূরে, ফেন্সের বাইরে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন এই প্রথমবার তাঁর হাতের হলদেটে মোটা বইটা রাখা আছে বেঞ্চের উপর। পকেটে মুড়ে রাখা মেসির ফোটোটা বের করে একবার চোখ বুজে কপালে ঠেকিয়েছিল মঞ্জরী।
“কিন্তু বড়দি…”
এবারের গুটিশুটি গলাখানা বাবার।

“ওর বয়েসটাও তো ভাবতে হবে। আগেকার সেদিন তো আর নেই যে পনেরো-ষোলোয় বিয়ে দিয়ে দিলাম আর মেয়ে সংসার করতে চলে গেল। আইন বলে একটা ব্যাপার আছে। সোজা থানা-পুলিশ হয়ে যাবে।”
“তা আইন ভাঙতে বলছেটাই বা কে? দেখাদেখিটা হয়ে থাক এখন, দু’বছর পর ছেলেরও উন্নতি হবে, মেয়েরও আঠারো পুরবে। ব্যস, তখন তো আর বাধা থাকছে না কোনও। নাকি?” মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

শেষ প্রশ্নটা পিসের দিকে তাকিয়ে করায় তিনি এক ঝটকায় খবর কাগজ থেকে মুখ তুলে মেশিনের মতো করে বললেন, “বাধা থাকছে না কোনও।” “তা হলে ওই কথাই রইল….” মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

মা আর বাবার থমথমে মুখের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বড় পিসি বললেন, “আমি ছেলের বাড়িকে বলে দিচ্ছি, সামনের রোববার এসে একবার দেখেশুনে যাবে’খন। কথা বলে রাখতে তো দোষ নেই। ভাল ছেলে হাতছাড়া করলে পরে তোমরাই পস্তাবে। আমার আর কী, তিনকাল এসে এককালে ঠেকেছে…” পিসিমা শোয়ার ঘরে যাওয়ার জন্য উঠলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “ও হ্যাঁ, ও বাড়ির আবার নিয়ম হচ্ছে, কথা পাকা হয়ে গেলে ওরা মাছ আর বরের গায়ের হলুদ পাঠাবে। গায়ে হলুদটা হয়ে থাকল, তারপর যখন সব…” মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

সেইদিন রাতে নিজের বিছানায় যে-ডাইভটা দিয়েছিল মঞ্জরী, সেটা মাঠে দিলে তার গোটাসাতেক পাঁজর তো ভাঙতই। এমনিতেই বাড়িতে সে কম কথা বলে, সেটা আরওই কমে গেল এর পর। পিসিমা আর পিসেমশাই তো চলে গেলেন দিনদুয়েক পরেই, এগিয়ে আসতে থাকল হতচ্ছাড়া সেই রোববারখানা। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

মঞ্জরী দেখল বাবা দিব্যি বাজার থেকে বড় কাটাপোনা নিয়ে আসছেন, মা নাজু বানাতে লেগেছেন, বাড়ি জুড়ে একটা বেশ হইহই ব্যাপার, কিন্তু চুপচাপ হইহই যাকে বলে। জিনিসটা তার মোটেই ভাল লাগল না। পিসিমা নয় ভিলেনের রোল পেয়েছেন এ যাত্রায়। বাবাকে সে বরাবরই নয় দূর থেকে বোঝার চেষ্টা করে এসেছে। কিন্তু মা? তিনি কী বলে নারকেলটারকেল কুটে একেবারে নাড়ু বানাতে লেগে গেলেন?
“মা, আমি কিন্তু বিয়েটিয়ে করব না।”

শনিবার বিকেলে, গুড়ের গন্ধে ম ম করতে থাকা রান্নাঘরে কথাটা বলল মঞ্জরী। মা কড়াই থেকে চোখ ফিরিয়ে একবার তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর বললেন, “চিন্তা কোরো না। যা হবে, তোমার ভালর জন্যই হবে।”
রাতে খুব একচোট অভিমানী কান্নাকাটি করার পর সে কাগজের শেষ পাতায় ভিকট্রি সাইন দেখানো মেসির ফোটোটা দেখল একবার, বুকে জড়িয়ে শোয়ার আগে। মেসিও দাড়ি রাখছে, মায়ের সেই সহজ পাঠ লেখা ঠাকুরের মতো। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

সে রাতটা এমনিতে ঘুম আসার কথা নয় মঞ্জরীর, কেননা পরদিনই দুপুর-দুপুর সেইসব অলুক্ষুণে লোকজনেরা আসবে তাদের বাড়ি। মঞ্জরীর ফোটো দেখে নাকি তাদের ভারী পছন্দ, তারা একেবারে গায়ে হলুদের সরঞ্জাম রেডি করেই রেখেছে, এ খবরও পৌঁছেছে তার কানে। রোববারের মতো একটা দিন। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

যে এরকম খারাপ হতে পারে, তা মঞ্জরী ভাবতেই পারে না। আরও কীসব দুঃখের কথা ভাবতে-ভাবতে তার ঘুম এসে গেল কখন।মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

স্বপ্নে সে দেখল, বরের মুকুট পরা একটা অচেনা লোক ঘোড়ার পিঠে চেপে বরযাত্রী নিয়ে আসছে, তার গায়ে রেফারির জার্সি। একটা লম্বা মাঠে রাত্তিরবেলা লোকজন জড়ো হয়েছে, গোলপোস্টের নীচে ছাদনাতলায় ও পাড়ার ভটচাজজেঠু বিয়ে দেবেন বলে সহজ পাঠ খুলে বসে আছেন। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

এর মধ্যে কোত্থেকে একজন হোমরামতো দারোগাকে ধরে এনে বড়পিসিমা মঞ্জরীকে বলছেন, “প্রণাম করো, ইনি তোমার মেসিমশাই।” কনের সাজ পরা মঞ্জুরী প্রণাম করে সোজা হতেই দেখছে, টোপর পরা সেই রেফারি বরের সঙ্গে তার শুভদৃষ্টি হচ্ছে। সকলে তাকে পিড়িতে তুলে ঘোরাচ্ছে, আর সে মুখ থেকে পানপাতা অল্প সরাতেই সেই রেফারি বর বুক পকেট থেকে ইয়েলো কার্ড বার করে তাকে দেখিয়ে বলছে, “আগে গায়ে হলুদটা হয়ে যাক!” মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

গোটা গা ঘামে ভিজে গিয়ে ধড়মড় করে জেগে উঠতেই মঞ্জরী দ্যাখে, দিব্যি সকাল হয়ে গিয়েছে, আর মা তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলছেন, “ঝটপট তৈরি হয়ে বসার ঘরে এসো। ওঁরা এসে গিয়েছেন।” মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

সে কী, তাদের না দুপুরে আসার কথা ছিল? কী শয়তান লোকজন! জলখাবারটাও এ বাড়িতেই সারবে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠে এক লাফে বাথরুমে ঢুকে পড়ল মঞ্জরী। কান্নাকাটি করে আর লাভ নেই, একবার মন শক্ত করে সামনে গিয়ে দুটো কথা বলে এলেই ছুটি। তার মানেই তো আর বিয়ে নয়। পুজোয় একটা দারুণ কামিজ কিনে দিয়েছিলেন মা, সেইটা চাপিয়ে, ছোট চুলে চিরুনি বুলিয়ে বসার ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল মঞ্জুরী। এ তো সেই ভদ্রলোক, যিনি আকাদেমির ফাইনাল খেলার দিন কোট পরে চেয়ারে বসেছিলেন! সঙ্গে তাদের আকাদেমির কোচস্যার আর দু’জন এমনি স্যারও এসেছেন।

বাবা আর মা দাঁড়িয়ে আছেন চেয়ারের পাশে। সকলে মঞ্জরীকে ঘরে ঢুকতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। খটকা হল মঞ্জরীর। স্বপ্নটা কি শেষ হয়নি এখনও? নিজের কনুইয়ে চিমটি কাটতেই এত জোরে লাগল যে সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চেঁচিয়ে ফেলাটা আটকাল কোনও রকমে। নাহ, ডাহা সত্যি ব্যাপার!

“এসো মঞ্জরী, তোমার জন্য দারুণ একটা সারপ্রাইজ আছে। তোমার বাবা আর মাকে আমরা জানিয়েছিলাম আগেই, ওঁরাই বললেন, আমাদের মুখ থেকে শুনলে তুমি আরও খুশি হবে,” বললেন কোচ স্যার। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

মঞ্জরী ঘুমছাড়ানো আলতো পায়ে সকলের সামনে এসে থম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না, ব্যাপারখানা কী। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

সেই ভদ্রলোককে এবার কোচ স্যার বললেন, “সিলেক্টর সাহেব, আপনিই বলুন। এই হল মঞ্জরী।” সেদিনের সেই কোটপরা লম্বাপানা ভদ্রলোক এবার বললেন, “সেদিন তোমার হ্যাটট্রিক আমার মনে থাকবে মঞ্জুরী। শোনো, সামনের জুন মাসে কলকাতায় একটা আন্ডার এইটিন এগজিবিশন ম্যাচ হবে, আধ ঘণ্টার। শুধু জেলার মেয়েরা খেলবে। বর্ধমান থেকে একজনকেই সিলেক্ট করা হয়েছে, আর সেটা তুমি, বুঝলে?”

এক মুহূর্তে সব দুঃখ-কষ্ট- অভিমান ভুলে গিয়ে দু’হাতে ছোট্ট তালি দিয়ে একটা ভুভুক লাফ মেরে নিল মঞ্জুরী। সে একা সিলেক্টেড? গোটা জেলা থেকে? ইশ, ভাবাই যাচ্ছে না!
“আজ একবার আমাদের সঙ্গে শহরে যেতে হবে এখন তোমায়। মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

রেজিষ্ট্রেশনের জন্যে। ওবেলা বাবা তোমাকে নিয়ে আসবেন, কী, গিয়ে যাবে তো?”
মঞ্জুরী হাসিমুখে যতটা পারে ঘাড় হেলিয়ে দিল। বাবা আর মা নিজেদের মধ্যে মিটিমিটি চোখ চাওয়াচাওয়ি করছেন, যেন সারপ্রাইজের আরও বাকি আছে কিছু। কোচ স্যার
আবার সেই সিলেক্টরসাহেবকে বললেন, “স্যার, আসল কথাটা এবার বলুন।” মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

সিলেক্টর সাহেব হেসে বললেন, “এগজিবিশন ম্যাচটা কেন হচ্ছে জান তো? মেসি আসছেন কলকাতায়। যুবভারতীতে ফেলিসিটেট করা হবে। ওঁর সামনে তোমরা খেলবে আধঘণ্টা। খেলার শেষে প্রত্যেক প্লেয়ারের সঙ্গে হাত মেলাবেন উনি, কথা দিয়েছেন। কী, খুশি তো?” মঞ্জরীর গায়ে হলুদ

মঞ্জরী আবার একটা স্বভাবসিদ্ধ ডাইভ দিল, এবার মায়ের বুকে। শীতকালে গাল বেয়ে নামতে থাকা গরমজল তার মন্দ লাগছে না। “ওদের তা হলে কী বলবে মা?” মায়ের কাঁধে মাথা রেখেই ফিসফিস করে জানতে চাইল মঞ্জরী। দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডার থেকে মায়ের সখা সেই ঠাকুরও তখন অল্প- অল্প হাসছেন দাড়ির ফাঁক থেকে। মা-ও ভারী আলতো নিচু স্বরে তার কানে ঠোঁট রেখে বললেন, “বলব, ছেলে আগে আমার মেয়ের মতো একখানা হ্যাটট্রিক করুক, তারপর পাকা কথা হবে।”

মঞ্জুরী হাতের চেটোয় গরম চোখ মুছে নিয়ে হাসিমুখে ফিরে তাকাল সকলের দিকে। কোচস্যার প্যাকেট থেকে টাটকা জার্সি বের করেছেন ততক্ষণে, গাঢ় হলুদের পিঠে সিঁদুরে লাল দিয়ে ইংরেজিতে তার নামের বানান লেখা।
কোচ স্যারের হাত থেকে জার্সিটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে শোয়ার ঘরে ছুটে এসে নিজের গায়ের উপর সেটা মেলে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়াল মঞ্জরী। কাঁচা হলুদের গায়ে ডিসেম্বরের নরম রোদ ঝলসে উঠছে। জার্সিটাকে বুকে জড়িয়ে আর- একবার সে ডাইভ মারল নিজের বিছানায়। মেসিকে সে ভালবাসে। সবচেয়ে বেশি ভালবাসে সারা পৃথিবীতে। হাত মেলানোর সময় একবার বলতেই হবে, “দাড়িটা চট করে কেটো না কিন্তু! দিব্যি দেখাচ্ছে।”
ছবি: রৌদ্র মিত্র

মঞ্জরীর গায়ে হলুদ সমাপ্ত।

Be the first to comment

Leave a Reply