কে বাঁশি বাজায় pdf – বিনোদ ঘোষাল Ke Bashi Bajay pdf – Binod Ghoshal best pdf

কে বাঁশি বাজায় pdf - বিনোদ ঘোষাল Ke Bashi Bajay pdf - Binod Ghoshal best pdf
কে বাঁশি বাজায় pdf - বিনোদ ঘোষাল Ke Bashi Bajay pdf - Binod Ghoshal best pdf

বিনোদ ঘোষাল এর নজরুলের জীবনের প্রথমাংশ অবলম্বনে লেখা Ke Bashi Bajay pdf কে বাঁশি বাজায় pdf ডাউনলোড করুন ও Ke Bashi Bajay pdf কে বাঁশি বাজায় pdf পড়ুন।

কে বাঁশি বাজায় pdf - বিনোদ ঘোষাল Ke Bashi Bajay pdf - Binod Ghoshal best pdf
কে বাঁশি বাজায় pdf – বিনোদ ঘোষাল Ke Bashi Bajay pdf – Binod Ghoshal best pdf

Ke Bashi Bajay pdf কে বাঁশি বাজায় pdf  একটি অলৌকিক যাত্রাপথে

স্টেশন রােডের ধারে আমার বাবার একটা ফটো-বাঁধাইয়ের দোকান ছিল। সেখানে এমন বেশ কিছু ফটো ছিল যা বাবা কখনই বিক্রি করতেন না। অনেক সময় কোনও ছবির জন্য বেশি টাকার প্রলােভন আসত বিশেষ খরিদ্দারের থেকে। বাবা উত্তরে সামান্য হাসতেন। শুধু। গরিব ফটো-বাঁধাইওলা, ঘরে নিত্য অভাব। কিন্তু যে মানুষ ছবির নেশায় ছবি বাঁধাইয়েরই দোকান করে বসে তাকে লােভ দেখানাে খুব কঠিন। তাে সেই না-বিক্রি করা ছবিদের মধ্যে একটি সাদাকালাে ছবি ছিল, যেখানে টাকমাথা এক বৃদ্ধ মাথা নিচু করে আপন মনে দুইহাতে কাগজ মােড়াচ্ছেন। সেই বৃদ্ধ আমার কোনও পরিচিত মুখ ছিলেন।

একদিন বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই ফটোটা বিক্রি করাে না কেন? কার ছবি? বাবা উত্তর দিলেন, ‘তুই যার ছবি আঁকতে ভালবাসিস। কাজী নজরুল ইসলামের। শেষ বয়সে এমন হয়ে গিয়েছিলেন। কাউকে চিনতে পারতেন না। শুধু বসে কাগজ ছিড়তেন এইভাবে।

আরজ আলী সমীপে pdf – আরিফ আজাদ Aroj Ali Somipe pdf – Arif Azad

কী কষ্ট যে পেয়েছিলাম সেদিন! ঘন ঝাঁকড়া চুল, দীঘল চোখওলা যে মানুষটার ছবি আঁকি বারবার, বিশেষ করে ওই পদ্মফুলের পাপড়ির মতাে চোখদুটো আঁকার লােভে, সে এমন হয়ে গিয়েছিল! বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল খুব। একদিন দোকান থেকে ছবিটা নিয়ে এসেছিলাম আঁকব ভেবে। পারিনি আঁকতে। খুব কষ্ট লেগেছিল আঁকতে গিয়ে। ছবিটা রয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। বাবা একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী রে, আঁকলি না?’
আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আমার নজরুলের কাঁধপর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল, যে মাথা ঝাঁকিয়ে “কারার ওই লৌহকপাট গায়।” ওই গানটি আসলে আমার খুব প্রিয় ছিল। সারাক্ষণ গাইতাম।

অজানা দ্বীপে ড্রাগন pdf – স্বপন কুমার Ajana Dwipe Dragon pdf – Swapan Kumar

আমার কথা শুনে বাবা খুব হেসেছিলেন সেদিন। তারপর বলেছিলেন, ‘তুই যে বছর জন্মালি সেই বছরই নজরুল চলে গিয়েছিলেন।’
ওই কথা শুনে দশ বছর বয়েসি বুকের ভেতর কেমন যেন একটা করে উঠেছিল। ঠিক কী, তা আজও বলতে পারব না। ব্যাস, নজরুলের সঙ্গে সম্পর্ক আমার এইটুকুই।

এরপর দীর্ঘবছর কেটে গিয়েছে। ঘটে গিয়েছে অনেক কিছু। চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধুই বাংলায় সাহিত্যচর্চা করব এই সিদ্ধান্ত নিয়ে লেখালেখির চেষ্টা করছি। আজ থেকে বছর তিনেক আগের কথা। আনন্দবাজার পত্রিকায় বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের জীবনের নানা অজানা কাহিনি নিয়ে একটি ধারাবাহিক কলাম লেখার সুযােগ পেলাম। প্রতি মাসে একটি করে লেখা লিখছি। কখনও তারাশঙ্কর, কখনও কালীপ্রসন্ন, কখনও সতীনাথ বা ত্রৈলােক্যনাথ। এদের জীবনগুলাে জেনে মুগ্ধ হচ্ছি। জোর পাচ্ছি মনে। এমন সময় হাতে একটি বই এল কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের নানা কথা বিষয়ক। বেশ ভাল লাগল। আনন্দবাজার পত্রিকায় তৎকালীন সহসম্পাদককে জানালাম নজরুলের জীবনের কিছু ঘটনা নিয়ে একটি ফিচার লিখতে চাই। সম্পাদক বললেন, বেশ লেখাে। কাজটির জন্য আমি নজরুলের জীবনবিষয়ক আরও দুই-একটি বই সংগ্রহ করে পড়তে গিয়ে চমকে উঠলাম।

এ যে সমুদ্র! এমন জীবনকে তিনপৃষ্ঠার ফিচারে বাঁধা অসম্ভব। আমার যেন নেশা লেগে গেল ওই জীবনটায়। আরও কিছু বই জোগাড় করলাম, পড়লাম। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করল এক অন্য চিন্তা। এমন ধূমকেতুর মতাে জীবনটা এতকাল জানতামই না। তার মানে আমার মতাে অনেকেই জানে না! ছােটবেলা থেকে শুধু জেনে এসেছি কাজী নজরুল ইসলাম হলেন বিদ্রোহী কবি। কিন্তু এখনও কেউ বলেননি, ওঁর মতাে রােমান্টিক কবি বাংলাদেশে খুব কম জন্মেছেন। নজরুল— যে কবি কখনও লেটোগানের দলে ঘুরে মুখে মুখে গান গেয়েছেন, রেলের গার্ডসাহেবের বাবুর্চি হয়েছেন, কাঁধে বন্দুক নিয়ে লড়াই করতে গিয়েছেন আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে জেল খেটেছেন।

ভারতবর্ষের ক’জন কবি-সাহিত্যিকের এত ঘটনাবহুল জীবন রয়েছে আমার জানা নেই। আমি পুরাে ডুবে গেলাম মানুষটাকে জানতে গিয়ে। ততদিনে আমার হাতে খানতিনেক নজরুল-জীবনীও চলে এসেছে। হঠাৎ একদিন মনে হল দুখু মিয়ার গােটা জীবন নিয়ে একটা মস্ত উপন্যাস লিখলে কেমন হয়?

জীবনে ঝুঁকি নেওয়াটা আমার বরাবরের নেশা। তাই এবারেও অন্যথা হ’ল না। হাতে মাত্র পাঁচটা বই সম্বল করে ফোন করলাম সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকার ‘রােববার’ বিভাগে। এই ‘রােববার’ পত্রিকাটি প্রয়াত বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘােষের সম্পাদনায় শুরু থেকেই বাংলার সাহিত্যমনস্ক পাঠকের কাছে পরম আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। এবং তার প্রয়াণের পর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় পাঠকমহলে একইভাবে আদৃত। সাপ্তাহিক এই পত্রিকাটিতে ধারাবাহিক লেখার সুযােগ পাওয়া যে কোনও তরুণ লেখকের কাছে শ্লাঘার বিষয়। রােববারের সহসম্পাদক ভাস্কর লেটকে নিজের আর্জি জানালাম। তিনিও সানন্দে রাজি। বললেন, কী লিখবেন তার একটা সংক্ষিপ্তসার পাঠান। আমি খােশমেজাজে রাজি হয়ে গেলাম। তারপর ফোনটা রাখার পরই প্রথম মনে হল, আচ্ছা কীভাবে লিখব? প্রথমত আগে কোনওদিন ধারাবাহিক উপন্যাস লিখিনি।

তারপর যাকে নিয়ে লিখব ভেবেছি তার জীবনের ব্যাপ্তি দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে গভীরতায় সাগরের মতাে, কোথা থেকে শুরু করব আর কোথায় থামব? কী ফর্মে লিখব কিছুই জানি না। তবু সংক্ষিপ্তসার একটা লিখলাম। নজরুল জীবনী দেখে পুরাে জীবনের একটা সারসংক্ষেপ লিখলাম। পাঠালাম। মাস খানেক পর ফোন এল। আপনি লেখা শুরু করে দিন। আগামী মাসের মধ্যে তিনটে এপিসােড জমা দিয়ে দিতে হবে আপনাকে। সম্পাদক ফোন রাখলেন আর আমার হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেল।

এবার কী হবে? কীভাবে লিখব? কোনও মানুষের জীবনী রচনা করা বা তাকে নিয়ে গবেষণাপত্র তৈরি করা এক কাজ আর সেই মানুষকে নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ উপন্যাসে সেই মানুষটিকে একটি রক্তমাংসের চরিত্রের রূপ দিতে হবে। পাঠকের চোখের সামনে সে যেন হেঁটে চলে বেড়ায়, হা-হা করে হাসে, ঘুমােয়, কথা বলে, কাঁদে, রাগ করে—এসব যেন পাঠক দেখতে পায় সেইভাবে লেখককে লিখতে হবে। কিন্তু পাঠককে দেখানাের আগে স্বয়ং লেখককে তাে দেখতে হবে। লেখক নিজেই যদি তার চরিত্রকে দেখতে না পায় তাহলে সে লিখবে কাকে নিয়ে? বাংলায় এতগুলি ভাল ভাল নজরুল-জীবনী রয়েছে। জীবনীকাররা কী অসামান্য পরিশ্রম এবং আন্তরিকতা দিয়ে সেই কাজগুলি করেছেন, তাই আমার আর নজরুল-জীবনী লেখার সাধ এবং সাধ্য কোনওটাই ছিল না, আমি চেয়েছিলাম জীবনীর আড়ালে নজরুলকে নিয়ে একটি কাহিনি লিখতে।

কারণ একটাই, শুধু জীবনী সাধারণ পাঠক অকারণে পড়তে চান না। কিন্তু গল্প পড়ার আগ্রহ চিরকাল মানুষের বেশি। আমি যদি গল্পের আদলে নজরুলের জীবনকে লিখি তাহলে আরও বেশি মানুষ হয়তাে এই অসামান্য জীবনটিকে জানার সুযােগ পাবেন, আগ্রহ পাবেন।

কিন্তু মাথার ওপর আমার আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি কিছুতেই দুখু মিয়াকে মনে মনে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার লেখার ঘরের দেওয়ালে ততদিন সেই সাদাকালাে ছবিটি পাকাপাকি জায়গা নিয়েছে, আমার মােবাইলে, ডেস্কটপের ওয়ালপেপারে নজরুল। সারাক্ষণ নজরুলের গান শুনছি, তাঁর লেখাগুলি পড়ছি, তাঁকে নিয়ে লেখাগুলি পড়ছি। বইয়ের সন্ধানে এদিক ওদিক ছুটছি। আমার বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছে হাত পেতে বলছি, কাজীর ওপর একটা কাজ করতে চলেছি। আমাকে প্লিজ কোনও ভাল বইয়ের সন্ধান থাকলে বলাে। পাঠাও।’ দুই বাংলার বন্ধুরা তাঁদের সাধ্যমতাে বই, তথ্য ইত্যাদি দিয়ে আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে চলেছেন। আমি পড়ছি। কিন্তু একটা লাইনও লিখতে পারছি না। কারণ তাঁকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। এদিকে দিন ঘনিয়ে আসছে। এপিসােড জমা দেওয়ার।

এর মধ্যেই আমার পেশাগত জীবনে ঘটল এক চূড়ান্ত বিপর্যয় যা আমাকে মনেপ্রাণে চূড়ান্ত অস্থির এবং বিব্রত করে তুলল, সেই ঘটনা এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক বলে আর করলাম না। কিন্তু আমার মানসিক অবস্থা আরও শােচনীয় হয়ে উঠল। রাতের ঘুম গেল চলে। একদিন অনেক রাত। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছি। আর শুয়ে থাকতে পারলামনা। ছাদে চলে এলাম। আমাদের বাড়ির লম্বা ছাদ। আকাশে তখন শেষ রাতের চাঁদ। পায়চারি করছি। মনে মনে ভাবছি নজরুলের কথা। তার সঙ্গে ভাবছি,এই কাজ আমি পারব না। এর মধ্যেই সম্পাদকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের অক্ষমতা জানিয়ে দিতে হবে। আচমকাই স্পষ্ট দেখলাম আমার থেকে দশ পা দূরে আমার মুখােমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছেন কবি। একটা সাদা ধুতি লুঙ্গির মত করে পরা, গায়ে গােল গলার হাফহাতা গেঞ্জি। বৃদ্ধের মাথা সামান্য নিচের দিকে ঝোঁকানাে।

তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে। উনিও আমার সঙ্গে পায়চারি করছেন! আমি চমকে উঠলাম। ওই অলৌকিক মুহূর্তটুকুকে বিশ্বাস করে ফেললাম এক লহমায়। ঘােরের মাথায় চলে এলাম নিজের লেখার টেবিলে। ল্যাপটপ অন্ করে প্রথম লাইনটি লিখলাম, একটু আগে ভাের নামল। ব্যাস্, তারপর ওই একবেলার মধ্যে লিখে ফেলেছিলাম পুরাে দুই হাজার শব্দ। একবারের জন্যও থামতে হয়নি।

পরে ভেবেছি, বুঝেছি ওই মুহূর্তটি নেহাতই আমার দৃষ্টিভ্রম ছিল। কিন্তু ওই ভ্রমবশতই কবিকে এক সেকেন্ডের জন্য যে দেখতে পাওয়া, যেন ওই স্ফুলিঙ্গটুকুরই অপেক্ষা করছিলাম। তারপর টানা একবছরের অধিক সময় ধরে লিখলাম রােববার পত্রিকায়। শুরু থেকেই পাঠকমহল থেকে বিপুল সাড়া পেতে শুরু করলাম। কত রকমের প্রতিক্রিয়া যে পেয়েছি। কত মানুষ জানিয়েছেন তাঁদের ভাললাগা। পত্রিকার সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল একবছরের। কিন্তু একটি বছর যখন শেষ হতে চলল তখন টের পেলাম ওই বিশাল জীবনের অর্ধেকও লিখে শেষ করতে পারিনি। কিন্তু ততদিনে আমার রক্তে, শিরায়, আত্মায় নজরুলকে বইতে শুরু করেছি। আমি সারাক্ষণ আমার দুখু মিয়ার সঙ্গে থাকছি। একসঙ্গে খাই, ঘুমােই, গল্প করি। আর তিনি নিজের কথা গড়গড় করে বলতে থাকেন, আমি তাঁকে লিখতে থাকি। তাঁর উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার ঘাড়ে, গলায়, হাতের ওপর এসে পড়ে।

কী অসাধারণ এক অনুভূতি যা আমি কাউকে বােঝাতে পারব না। কারও সঙ্গে দুটো কথা বলার পরেই দুখু মিয়ার প্রসঙ্গ এনে ফেলি। কবে যেন ভুলেই গেলাম কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার বিদ্রোহী কবি, যাঁর নাম, যাঁর গান-কবিতা আজও দেশ বিদেশের মানুষের মুখে মুখে ঘােরে। রবিঠাকুরের পাশেই একবাক্যে যাঁর নাম উচ্চারিত হয়। এ যেন আমারই গড়ে তােলা সন্তান, আমার পরম বন্ধু। তার আর কোনও পরিচয় নেই। আমি তাঁকে ভাত বেড়ে দিই, ঘুম পাড়াই, তার পাশে বসে তাঁর গান শুনি।

এক এক রাতে আমি দুখু মিয়া ও তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বেড়াই, কখনও শৈলজানন্দ, কখনও পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, কখনও মুজফফর আহমদ। এক অবিচ্ছিন্ন ঘাের লাগা জগতে আমি থাকতে শুরু করে ফেলেছি ততদিনে। কিন্তু একবছর শেষ। আর সংবাদ প্রতিদিনের রােববারে লেখার উপায় নেই। কিন্তু ততদিনে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমার দুখু মিয়ার পুরাে জীবনকে আমি যেমনভাবে দেখতে পাচ্ছি তেমনভাবেই লিখব। লিখেই চলব।

আসলে লিখতে গিয়ে আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরেছিলাম কাজী নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিবিশেষ নন, তিনি একটি সময়ের নাম। তাঁর জীবদ্দশায় পৃথিবীতে ঘটেছে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, নভেম্বর বিপ্লব, ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধর মতাে উল্লেখযােগ্য ঘটনা। শুধু তাই নয় নজরুলের জীবনে বিভিন্ন সময়ে বহু বিশিষ্ট মানুষ তাঁর কাছে এসেছিলেন। ইতিহাসে তাঁদের অবদানও কম নয়। সুতরাং নজরুলকে লেখা মানে এই সকল ঘটনা এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলির জীবনকেও কম বেশি নিয়ে আসতে হবে, নইলে লেখাটি সম্পূর্ণতা পাবে না। তাই এসবের কারণে এক বছরে আমি সামান্যই লিখতে পেরেছি, ঢের বাকি রয়ে গিয়েছে।

আমি নজরুল গবেষক নই, বিশেষজ্ঞও নই। সেই যােগ্যতাও আমার নেই। নজরুলের জীবন ও তাঁর কাজকে নিয়ে বহু বিশিষ্ট মানুষ যেসকল কাজ করে গিয়েছেন বা এখনও করে চলেছেন তাঁদের কাজগুলিকেই আমার মাথায় করে বা বলা ভাল সেই মানুষগুলির পায়ের কাছে বসেই আমার নজরুল-শিক্ষা। কবিকে নিজের মতাে করে দেখার চেষ্টা, দেখানাের চেষ্টা করেছি মাত্র।
কাজটির জন্য আমার অনেক পরিচিত এবং অপরিচিত বন্ধু তাঁদের অকৃপণ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কখনও বই কিনে দিয়েছেন, দুর্লভ বই এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়েছেন। এই ভূমিকায় তাদের নাম উল্লেখ করলাম না কারণ কাজটি এখনও শেষ হয়নি। আরও অনেক মানুষের সাহায্যপ্রাপ্তি আমার বাকি রয়েছে।

তাই পরবর্তী পর্বের শেষে সেই উদার মানুষগুলির নাম এবং যে অজস্র গ্রন্থ, পত্রপত্রিকা থেকে আমার লেখার রসদ সংগ্রহ করেছি এবং ভবিষ্যতে করব, সেই অমূল্য তথ্যসূত্রগুলি অবশ্যই উল্লেখ করব। তবে এই পর্বে অবশ্যই ধন্যবাদ দেব রােববার পত্রিকার সম্পাদক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সহযােগী সম্পাদক ভাস্কর লেট এবং সংহিতা সান্যালকে। ভাস্কর আমাকে নিরবিচ্ছিন্ন স্বাধীনতা দিয়েছিল লেখাটির ক্ষেত্রে। সংহিতা প্রতি সপ্তাহে আমাকে নির্দিষ্ট সময়ে কিস্তি জমা করার কথাটি খুব মােলায়েমভাবে মনে করিয়ে দিত। ওদের আন্তরিকতা যেমন মনে রাখার, সংবাদ প্রতিদিনের কাছেও আমার অনেক কৃতজ্ঞতা ‘কে বাজায় বাঁশি’ ধারাবাহিকভাবে বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

প্রথম কিস্তিটি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র কলেজস্ট্রিটের জীবন্ত কিংবদন্তি, পঁচাশি বছরের কর্মঠ তরুণ প্রকাশক মাননীয় সবিতেন্দ্রনাথ রায় (ভানুবাবু) স্বয়ং আমাকে ফোন করে বললেন, ‘বিনােদ, তােমার এই উপন্যাসটি আমাকে দাও।’ পরের দিনই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর হয়ে গেল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মিত্র ও ঘােষ-এর মতাে প্রকাশনা থেকে এই বই প্রকাশ পাওয়ার সুযােগ দুখু মিয়ার ইচ্ছে ছাড়া সম্ভব ছিল না।

অবশেষে প্রথম পর্ব বই আকারে পাঠকদের কাছে এল। এই উপন্যাসে আমি যেমন তথ্যনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা করেছি তেমনই নেহাতই উপন্যাসের প্রয়ােজন ছাড়া অবান্তর প্রসঙ্গে যাইনি, কারণ কাজীর জীবন নিয়ে এমনিই অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে, আমি চাইনি আরও বিভ্রান্তি বাড়ক। একজন গবেষক যখন কোনও ব্যক্তির জীবনকে গবেষণা করে তার জীবনী রচনা করেন সেখানে তিনি কল্পনার আশ্রয় নিতে পারেন না। কারণ জীবনী তথ্য চায়, কল্পনা নয়। তার ফলে মানুষটির প্রকৃত চরিত্র কেমন ছিল তা ধরতে অনেক সময় সমস্যা হয়ে যায়। কিন্তু একজন সাহিত্যিক সেই সুযােগটি নিতে পারেন, তিনি গবেষকের কাজ ধার নিয়ে তার সঙ্গে নিজের কল্পনা মিশিয়ে সেই চরিত্রকে এমনভাবে রচনা করতে পারেন যাতে পাঠক সেই চরিত্রকে নিঃশ্বাস নিতে দেখতে পান।

আমিও ঠিক সেই স্বাধীনতাটুকুই নিয়েছি, আর আমার উদ্দেশ্যও ওই একটিই, কাজী নজরুল ইসলামের জীবনকে আধুনিক প্রজন্মের কাছে একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে হাজির করা, যাতে তারা দুখু মিয়াকে বন্ধু ভাবতে পারেন, এই মহৎপ্রাণ, অসম্ভব শক্তিশালী বাঙালি পুরুষটি যে শুধু ‘বিদ্রোহী কবি’ নয়, আরও অনেক কিছু, তা অনুভব করতে পারেন।

আমার সেই চেষ্টা যদি সিকিভাগও সফল হয় তাহলে সেই কৃতিত্ব কাজী নজরুল ইসলামের। গত দুইবছর ধরে আমার আট বছর বয়েসি ছেলে যখনই আমার লেখাপড়ার ঘরে আসে, দেখতে পায় ঘরভর্তি নজরুল ইসলামের বই এবং তার বাবা ভুরু কুঁচকে লিখছে অথবা পড়ছে। প্রথম দিকে জিজ্ঞাসা, নজরুল কে? কী করতেন?’ ইত্যাদি। তারপর নজরুলের মুখের ছবি আঁকা ইত্যাদির পর শুরু হল আমার সংগ্রহ করা বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি। মাঝেমাঝে বিরক্তও হতাম। আবার কখনও গল্প বলতাম। দুখু মিয়ার জীবনের গল্প। ও মন দিয়ে শুনত, একদিন দেখি নিজেই ঝিঙেফুল থেকে কবিতা আবৃত্তি করছে। তারও কিছুদিন পর স্কুলে ওকে গান গাইতে বলা হয়েছিল। ও গেয়েছে ‘কারার ওই লৌহকপাট।’ সবাই নাকি সেই গান শুনে খুব হাততালিও দিয়েছে। সেই হাততালিগুলাে আমি সারাক্ষণ শুনতে পাই।

ক’দিন আগে স্কুল থেকে ফিরে ছেলে আমাকে বলল, “জানাে বাবা, আজ বন্ধুরা বড় হয়ে কে কী হতে চায় বলছিল, আমি বলেছি আমি নজরুল ইসলামের মতাে হতে চাই।’ এই তাে আমার পাওয়া! এখন আমার শুধু ভয় একটাই। এই কাজটি যেদিন শেষ হবে সেদিন দুখু মিয়া যেন আমাকে ছেড়ে চলে না যান, তাঁকে ছেড়ে আর আমি থাকতে পারব না।
বিনোদ ঘোষাল

Ke Bashi Bajay pdf download link

Download / Read Online

Be the first to comment

Leave a Reply