অভীক মুখোপাধ্যায় এর হরর থ্রিলার গল্প সে পিশাচ হয়ে যায় Se pishach Hoye Jay পড়ুন এখনই।
সে পিশাচ হয়ে যায় Se pishach Hoye Jay
‘আমার বুকের ওপরে একটা পিশাচ এসে বসে থাকতে শুরু করল, প্রায়দিন রাত্তিরেই। সেই সব রাতে আমার ঘুমের মধ্যে অমন হয়। কান্না পায়। কী ভয়ানক তাকে দেখতে। আমি তার স্পর্শ জানি। গন্ধ চিনি। পায়ের শব্দ শুনি। সে আমাকে ভয় দেখায়। তারপর আমার ঘাড়ে নিজের লম্বা লম্বা দাঁত ফুটিয়ে রক্ত খায়। প্রথমবার ওই পিশাচ আমার কাছে আসে পাক্কা তিনশো আটান্ন দিন আগে। ভাদ্র মাসের বাইশ তারিখ।’
সেরা ৫০টি গল্প pdf – প্রফুল্ল রায় Sera Panchasti Galpa pdf – Prafulla Roy
মোহরের কথা পড়ে আমি অবাক হয়েছিলাম। তবে আমার অবাক হওয়া নিয়ে একদমই কৌতূহলী হবেন না। আমি প্রথম প্রথম অমন হরেক জিনিসে অবাক হই। তারপর ভাবতে বসি। এটা এমনভাবে না করে অমনভাবে করলে কত ভালো হতো…ইত্যাদি ইত্যাদি। যেমন এখন মনে হয় যদি তখন কান চাপা দিয়ে রাখতাম, চোখ বন্ধ করে রাখতাম, দেখেও না দেখার ভান করতাম, তাহলে জীবন অন্যরকম হতে পারত।
আপনি আবার ভাবছেন, শুরু করল মোহরের কথা দিয়ে, এবার নিজের ধানাইপানাই শেষ হওয়ার নাম নেই। আরে দাঁড়ান না। অত তাড়াহুড়ো কীসের? আমার কথা না বললে মোহরের কথায় আসা যাবে না। একটু আমার সঙ্গে পরিচয় করে নিন। তারপর নাহয়… আমি সংযুক্তা। গ্রামের মেয়ে। গ্রামের বিলুপ্তপ্রায় খেলা, আনুষঙ্গিক সমস্যা ও তার প্রতিকার’ নিয়ে থিসিস পেপার লিখছি। আপনি অবাক হলেন বিষয় শুনে অবাক হবেন না, প্লিজ! যারা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে তাঁদের আমি বহুবার হতাশ চোখে প্রশ্ন করেছি, গত দশ বছরে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আনুমানিক ক’টা খেলা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পড়েছে জানেন? পঞ্চাশেরও বেশি। হাঁ হয়ে যান তাঁরা।
আপনি অবাক হবেন না। এই বিলুপ্তির কারণটা খুব স্বাভাবিক হলেও অবিশ্বাস্য। গ্রামের জায়গা সংকুলান। গ্রাম আর পূর্ণ নেই। মেগা প্রোজেক্ট হচ্ছে। কারখানা হচ্ছে। খেলবে কোথায় বাচ্চারা? আর ভারী ভারী বই, হোমওয়ার্ক, সিলেবাসের বোঝা, স্কুলের ব্যাগ, একজ্যাম। খেলবে কখন বাচ্চারা?
ভাগ্যের কী পরিহাস দেখুন। গ্রামের খেলার বিলুপ্তি নিয়ে গবেষণাপত্র লেখার জন্য শেকড় ছেঁড়া হয়ে চলে আসতে হল শহর কোলকাতার বুকে। আমার গ্রামের ধুলোকাদা, বন্ধুবৃত্ত, ধীরেসুস্থে চলা জীবন, পানাপুকুর, বাঁশঝাড়—খুব মিস করি এখন। অবশ্য ওখানেও অপ্রাপ্তি ছিল। মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। সোমথ হতে না হতেই পাড়ার সিসিটিভি কাকিমা জেঠিমারা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে নিবেদিতপ্রাণা হয়ে উঠেছিলেন। আমি বাড়ির লোককে বললাম, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবে বিয়ে করব। সামনে তখন একটাই উপায়, চাকরি পাওয়া নতুবা নিজের পড়াটাকে চালিয়ে যাওয়া। সেই সূত্রে আমার ঠিকানা এখন তিলোত্তমা।
প্রথম কয়েক মাস বেশ উত্তেজনার মধ্যে দিয়েই কাটল। কলকাতা আগে এলেও এমন বাঁধা গরু ছাড়া পাওয়ার মতো করে তো আগে ঘুরে দেখিনি। শহরটাকে নতুন মনে হল। পারলে আকাশ ছুঁয়ে ফেলি। প্রথমে মহাজাতি সদনের কাছে একটা লেডিজ হোস্টেলে থাকা শুরু করেছিলাম। মানিয়ে নিতে অসুবিধে হল। বেরিয়ে এলাম। এবারে আমহার্স্ট স্ট্রিটে পেয়িং গেস্ট। খরচ বেশি। একটা রুম দুজনে শেয়ার করে থাকতে হবে। মাঝারি মাপের ঘরে দুটো খাট। বিছানা পাতা আছে। দুটো চেস্ট ইন ড্রয়ার। ভাগ্য ভালো ছিল যে, যখন গিয়ে উঠলাম, তখন ওই ঘরে অন্য পেয়িং গেস্ট নেই। আমি একাই।
তবে কপালে সবার নাকি সুখ সয় না। একদিন সন্ধেবেলায় কাজ সেরে সবে ঢুকছি এমন সময় বাড়ির মালকিন মিঠু কাকিমা আমাকে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি ওঁর ঘরে আমার বয়েসি একটা মেয়ে বসে। কামিজটা টকটকে লাল। সালোয়ার হলদে ফুল-ফুল ছাপ।
‘সংযুক্তা, এসো, বোসো,’ মিঠু কাকিমার আহ্বান। আঙুল দিয়ে চেয়ার দেখালেন। যা বললেন তারপর ‘সংযুক্তা, এ হল মোহর। তোমার নতুন রুমমেট। আজ থেকেই থাকবে।’
পুরোনো কেউ তো আগে ছিল না। নতুন বলার কী দরকার বুঝলাম না। আসলে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল। ঘর নোংরা করবে, রাতে আলো জ্বালিয়ে শোবে, হাজার বায়ানাক্কা। বিরক্তিটা বুঝতে না দিয়ে মুখে বললাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
দৃষ্টি চলে গেছে আবার মোহরের দিকে। এমনিতে বেশ সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে। কিন্তু মুখ শুকনো। বিবর্ণ ত্বক। হাতের আঙুলগুলো শীর্ণ। কিছু ঝিরিঝিরি চুল। একজোড়া ছলছল চোখ। মোহরের চোখের দিকে তাকিয়েই থতমত খেলাম। ওই চোখজোড়ায় একফোঁটা ভাষা নেই। কথা বলার ইচ্ছে নেই। ভেজা ভেজা অধ্য কড়া, বোবা দৃষ্টি। আমি বললাম, ‘হাই।’
মোহর ঘাড় হেলিয়ে বলল, ‘হাই।’
এরপরের কয়েক সেকেন্ড আমরা তিনজন একে অপরের দিকে নীরব দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বসে রইলাম। প্রত্যেকেই ভাবছি অন্যজনে নৈঃশব্দ্য ভাঙুক। শেষমেশ মিঠু কাকিমা বলে উঠলেন, ‘সংযুক্ত, যাও না, মোহরকে নিয়ে রুমে যাও। আমি চা করে দিয়ে আসছি।
মনের মধ্যে গুঁজে থাকা চরম অস্বস্তিটা যেন পালানোর পথ পেল। আমি উঠে রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। পেছনে মোহর। ঘরে ঢুকেই ফাঁকা পড়ে থাকা খাট-বিছানা দেখিয়ে বললাম, ‘এটা তোমার বেড।
‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ মোহরের গলাটা থমথমে।
আমি ব্যাগটা মেঝেতেই রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বললাম, ‘আমার বাড়ি আরামবাগের দিকে। কাবলে। নাম শুনেছ?’
মোহর মাথা নাড়ল, ‘উঁহু।’
“শহরে ঘুরলেও আমার শেকড় সেই গ্রামেই পড়ে আছে। থিসিস পেপার লিখছি, তাই এখানে থাকতে হচ্ছে। তোমার কথা বলো।’ “আমি গ্রামের মেয়ে। কাকদ্বীপের।’
” এখানে কী জন্যে?”
“আমি….আমি ট্রিটমেন্টের জন্যে এসেছি।’ দুবার চোখের পলক ফেলল মোহর। মিথ্যে বলছে।
‘ট্রিটমেন্ট।’
‘হ্যাঁ।’ মোহর নিজের বিছানায় বসেছে। মুখের পেশিগুলো কাঠ- কাঠ। বলে চলল, “ভয় নেই। ছোঁয়াচে নয়। আমার ঘুমের একটা সমস্যা আছে। এখানে কলকাতায় একজন ডাক্তারকে দেখাতে এসেছি। এখানে থেকে ট্রিটমেন্ট করাতে হবে।
কোনও এক অজানা কারণে আমি ওর সব কথা বিশ্বাস করলাম না। শুধু ডাক্তার দেখাতে মোহর শহরে আসেনি।
‘কীরকম সমস্যা হয় তোমার?’
‘আমি ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত সব শব্দ করি। ফাটা ঠোঁটে জিভ বোলাচ্ছে মোহর।
‘অদ্ভুত শব্দ।’
‘হ্যাঁ। তুমি শুনলেও যেন ভয় পেও না। ঠিক আছে?’ এই প্রথমবার মোহর আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করল।
“ঠিক আছে। আর শোনো, রাতে লাইট জ্বালিয়ে শোবে না। আলো। জ্বললে আমার ঘুম আসে না। কেমন?’
মোহর মাথা নাড়ল।
পরের ক’টা দিন নির্বিঘ্নেই কাটল। মোহরের প্রতি তাই আমার সন্দেহটা আরও বেড়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে কোনও শব্দ করতে শুনিনি। ভুলটা আংশিক ভাঙল ন’দিনের মাথায়। সেদিন বেস্পতিবার।
নদিয়ার একটা গ্রামে গিয়েছিলাম ওখানকার স্থানীয় একটা খেলার খবর পেয়ে। ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। এমনিতে পেয়িং গেস্টদের বেশি রাত করে ফেরা মানা থাকলেও আমাকে হার দিয়েছেন কাকিমা। লেখাপড়ার গুরুত্ব ভদ্রমহিলা বোঝেন। আমি ফিরলাম রাত ন’টায়। ঢুকেই হাতমুখ ধুয়ে কাকিমার কাছে খেয়ে নিলাম। রুমে ফিরে সোজা বিছানায়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিল।
মোহরের যাওয়া আগেই হয়ে গিয়েছিল। বিছানায় আধশোওয়া হয়ে বই পড়ছিল মোহর। আমায় দেখে মুখে একটা হাসি আনার চেষ্টা আমি হেসে শুয়ে পড়লাম। আর শক্তি ছিল না।
একটা অদ্ভুত শব্দে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। শানের মেঝেতে ধাতব কোনও বস্তু ঘষটাতে ঘষটাতে নিয়ে গেলে যেমন তীক্ষ্ণ একটা শব্দ হয়, কিছুটা তেমন শব্দ। শুয়ে শুয়েই বোঝার চেষ্টা করলাম কী
ঘটছে। চোখের পাতা খুলতে পারছি না।
মনে হচ্ছে কয়েক মন করে ওজন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুচোখের ওপরে। কোনওমতে ফোনটা নিয়ে দেখলাম, দেড়টা বাজে। ‘ধুত্তোর। ঘুম ভাঙার আর সময় পেল না? কী জন্যে ঘুম ভেঙেছে সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে আবার ঘুমোব বলে তোড়জোড় করছি এমন সময় শব্দটা আবার শুনলাম। কিইইইই… আমার গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল ভয়ে।
আচমকা ভয়ে শরীর জমে গেছে। ঘুম উবে গেছে চোখ থেকে। অতিকষ্টে উঠে বসলাম। ঘরে আলো জ্বলছে না। অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। পূর্ব দিকের জানলাটা হাট করে খোলা। গলির মাথার ছিটলাইট অন্য দিন ঘরের ভেতরে এসে পড়ে। আজ নেই। মনে হয় কারেন্ট অফ হয়ে গেছে।
মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে শব্দটার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। মোহরের বিছানা থেকেই শব্দটা আসছে।
যে দৃশ্য আমি দেখলাম, তাতে হাড় হিম হয়ে গেল। মোহর বিছানায় শুয়ে ধনুকের মতো বেঁকে উঠে গেছে। দুটো হাত, আর দুটো পা বিছানা ছুঁয়ে আছে। পিঠ ছাপানো খোলা চুল ঝালরের মতোই শূন্য থেকে দুলছে। দুই হাতের পাঞ্জা দিয়ে চাদরটাকে খামছে ধরছে আর ছাড়ছে মোহর। পা দুটো তালে তালে ঠুকছে বিছানায়। মাথাটা এধার থেকে ওধার হচ্ছে পেন্ডুলামের মতন। শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। আর এই সবকিছু ছাপিয়ে সবথেকে ভয়ানক যে ব্যাপারটা ঘটছে, তা হল ওই অপার্থিব শব্দটা। মোহরের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। এমন বীভৎস কোনও শব্দ আমি শুনিনি।
‘মোহর।’ আমি ডাকলাম। খুব ভয়ে ভয়ে।
কিইইইইই… !
সিঙ্গেল নোটে হচ্ছে শব্দটা। বুকে কাঁপন ধরানো একটানা হাই পিচের আওয়াজ। মনে হচ্ছে আমার সমস্ত স্নায়ু বিকল হয়ে যাবে। ফোনটা ডান হাতে ধরে আছি। টের পাচ্ছি আমার হাঁটু দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। দুটো বিছানার মধ্যে খুব বেশি হলে চার হাতের দূরত্ব, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কয়েক যোজন পথ। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। আমি ওর আরও কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওর শরীরটা এখনও সমানতালে দুলছে। যেন অদৃশ্য কেউ দোলাচ্ছে দেহটাকে। স্পষ্ট অনুভব করলাম ঘামের ফোঁটাগুলো আমার কক্সিস দিয়ে নীচে নামছে।
কিইইইইই….!
‘মোহর।’ আমি ওর কাঁধটা ধরে নাড়া দিয়েই শিউরে উঠে হাত সরিয়ে নিলাম। জমাট বরফের মতন তীব্র ঠাণ্ডা ওর শরীরটা। পেশিগুলো টানটান। মনে হচ্ছে কেউ ধরে এভাবে বাঁকিয়ে আর্চ বানিয়ে দিচ্ছে।
গভীর একটা শ্বাস টেনে সাহস করে আমি আবার কাঁধে হাত রাখলাম। ‘মোহর… মোহর, তুমি কি ভয়ের কোনও স্বপ্ন দেখছ?’ কি….!
‘মোহর।’ এবারে আমি গলাটা একটু চড়ালাম।
কিইইইইই….!
‘মোহর…মোহর….ওঠো মোহর… চোখ খোলো….. আমি ওর কাঁধ ধরে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁকুনি দিলাম। ওর দেহের থরথর কাঁপুনি আমি। স্পষ্ট অনুভব করছি। এক হাতে দেহের আর্চের অবস্থাটা বজায় রেখে অন্য হাত দিয়ে আমার হাতটাকে শক্ত করে ধরল। হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যাওয়া গাড়ির মতন ওর কাঁপুনি থেমে গেছে। আচমকাই মাথাটাকে স্লো-মোশনে আমার দিকে ঘোরাল মোহর। চোখে সাদা বলে কিচ্ছুটি নেই, সবটাই মিশকালো। আর তখনি আবার ও চেঁচিয়ে উঠল— কিইইইইই….!
ভোরের নরম আলো পূর্ব দিকের জানলাটা বেয়ে মুখে এসে পড়তেই চোখ খুললাম। মোহর আমার সামনে বসে। আমি ওর বিছানায় শুয়ে ছিলাম। মোহরের মুখে একরাশ দুঃখ।
‘সরি’ আমার চোখ খোলার পর ও প্রথম এটাই বলল। ‘ভেরি সরি। আমার জন্যে তোমাকে কাল অসুবিধেয় পড়তে হয়েছে। আমার মনে হয়েছিল ট্রিটমেন্ট চলছে, ওষুধ খাচ্ছি, আমার আর কিছু হবে না। কিন্তু… আয়াম ভেরি সরি।’ চোখের পাতা বন্ধ করছে আর খুলছে মোহর।
বিরক্ত হলাম। আবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে গেল গত রাতে ও কোন অবস্থায় ছিল। ‘তুমি আগে কেন বলোনি?’
‘বলিনি মানে? বলেছিলাম না, আমি ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত শব্দ করি। তুমি গ্রাহ্যি কোরো না।”
আমি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, ‘কী হয় তোমার? আগেও হয়েছিল নিশ্চয়ই?’
“হ্যাঁ। এটারই ট্রিটমেন্টের জন্যে কলকাতায় এসেছি। ডাক্তার বলেছেন, স্লিপ প্যারালিসিস।’
“স্লিপ প্যারালিসিস?’
“বোবায় ধরা। বোবায় ধরলে না ঘুমে না জেগে থাকা অবস্থায় চলে যায় মানুষ। দেখে, শোনে, অনুভব করে, কিন্তু পক্ষাঘাতের মতনই শরীরটা নড়তে চড়তে পারে না।’
‘ওহ্!’ আমি মাথা নাড়লাম। এই নিয়ে বিশদে জানা নেই। মনে হল সবটা মোহর ঠিক বলছে না। উঠে এসে নিজের খাটে বসতেই মাথা খুলল। ‘দাঁড়াও! তুমি বললে, তুমি নড়াচড়া করতে পারো না।’ ‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু তুমি তো নড়ছিলে। তোমার মাথাটা ঘড়ির পেন্ডুলামের মতন এধার থেকে ওধার হচ্ছিল। তোমার হাতগুলো দিয়ে চাদরটাকে খামচে খামচে ধরছিলে। পা দুটো তালে তালে বিছানায় ঠুকছিলে।’ চোখের তলার ডার্ক সার্কেলগুলোর অন্ধকার এবার ছড়িয়ে পড়ল মোহরের গোটা মুখেই। মোহর জোর করে হাসার মতন করল। ‘ও! তাই নাকি? হতে পারে যে এই প্যারালিসিসটা সারা শরীরে হয় না। হয়তো কাল রাতে যেমন হয়েছিল… হাত পা মাথায় কিছু হয়নি। হতে পারে…।’ গলাটা শেষের দিকে খাদে নেমে গেল।
হঠাৎ আমার চোখ গিয়ে পড়ল ঘড়ির ওপরে। এ মা। আমার দেরি হয়ে গেল যে।’
ব্রাশে মাজন লাগিয়ে নিয়ে ছুটলাম বাথরুমে। ঝটাঝট ব্রাশ, প্রাতঃকৃত্য, স্নান সেরে এসে কোনওমতে পোশাক গলিয়ে, চুলটাকে বেঁধে নিয়ে ব্যাগ তুলে দৌড়। সকালের খাওয়া বাইরেই সারতে হবে। যখন রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি, তখন মোহরের গলা শুনলাম।
“রাতে অদ্ভুত শব্দ শুনলে আহি কোরো না যেন…. ইয়ার প্লাগ কিনে
পুনরায় নিস্তরঙ্গভাবেই আমাদের জীবন কাটতে শুরু করল। আমিও ধরে নিলাম সেদিন যা ঘটেছিল তা মোহরের জীবনের একটা খারাপ দিন মাত্র। ওর প্রতি আর কোনও ক্ষোভ রাখিনি। তবে এর মাঝে একটা কাজ অবশ্য করেছি। ওর কথা সিরিয়াসলি নিয়েছি। একজোড়া ইয়ার প্লাগ কিনে এনেছি। প্রতি রাতে কানে দিয়ে আমি ঘুমোতে যাই। যেহেতু আমার কানে আর কোনও শব্দ প্রবেশ করে না, তাই ধরে নিয়েছি আর কিছু ঘটেনি, এবং জীবন নিস্তরঙ্গভাবেই কাটছে।
পচা ভাদ্র মাস। ভ্যাপসা গরম। সারাদিনে ঘেমেনেয়ে একশা। সন্ধেবেলায় রুমে ফিরে চান না করা পর্যন্ত শান্তি হয় না। রাতে খাওয়া সেরে আমি সেদিন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছি। তবে ঘুমোইনি। মোহর বিশেষ বাচাল মেয়ে নয়। হ্যাঁ, হুঁ, না এসব শব্দগুলো ছাড়া বিশেষ কিছু ও খরচ করে না। আমি একটা থ্রিলার বই পড়ছিলাম। সৈকত মুখোপাধ্যায়ের। বইটা দুর্দান্ত, কিন্তু নিদ্রার দেবী আমাদের রুমের জানলা বেয়ে আমার চোখে এসে ভর করলেন। রুমমেটটিকে শুভরাত্রি জানিয়ে কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে ঘুমোতে চলে গেলাম।
আচমকা মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেল। একটা তীব্র বরফশীতল হাওয়া আমার শরীরের সমস্ত লোমকে যেন স্পর্শ করে গেল। আমি উঠে বসলাম। কাঁপছি। কারেন্ট চলে গেছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে বাইরে। অনুভব করলাম, নিঃশ্বাস ফেললে শীতকালের মতন ধোঁয়া বেরোচ্ছে নাক মুখ দিয়ে। অদ্ভুত ব্যাপার। সারাদিন ভ্যাপসা, পচা গরম ছিল।
কলকাতা শহরে ভাদ্র মাসে প্রবল বৃষ্টি হলে হাওয়া একটু জোলো, একটু ঠান্ডা হতে পারে। তাই বলে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোনো শৈত্য! হাঁটু দুটোকে টেনে বুকের কাছে তুলে নিলাম। কাঁপুনি আসছে। দাঁতে দাঁতে ঠকঠক করছে আমার। এমন সময় একটা শব্দ কানে আসতেই ভয়ের শুয়োপোকা আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ওঠানামা শুরু করে দিল।
খুব আস্তে হচ্ছে শব্দটা। ঘড়ঘড়ে। একটা হরর মুভিতে এরকম সাউন্ড এফেক্ট ছিল। সিনেমাটা দেখার পর আমি বহুরাত ভয়ে ভালো করে ঘুমোতে পারিনি। সিনটা মনে পড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম যে, শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছি। দুকানে হাত দিয়ে ইয়ার প্লাগগুলো যথাস্থানে আছে কিনা দেখতে গিয়েই টের পেলাম ডানদিকেরটা খুলে গেছে।
ইষ্টনাম জপ করতে করতে মোবাইলের আলোয় ড্রয়ার খুলে একটা চাদর বের করে বিছানায় ফিরে আসব এমন সময় আবার ঘড়ঘড়ানি শব্দটা কানে এল। ভয়ে ভয়ে আমি মোহরের খাটের দিকে তাকালাম।
এ কী? দৃশ্যটা দেখে আমি দুবার চোখ কচলে নিলাম। মোহর ওর বিছানায় নেই। কোথায় গেল?
ডাকতে যাব এমন সময় আবার ওই ঘড়ঘড়ে শব্দটা ঘরের মধ্যেই হল। ভয় করছে। মন বলছে, শব্দের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ইয়ার প্লাগ কানে গুঁজে শুয়ে পড়ো। কিন্তু আমার কৌতূহলী মন আমাকে বিপথে চালনা করল।
আমি সভয়ে দেখলাম মেঝেতে শুয়ে ঠিক আগেরদিনের মতনই যন্ত্রণাকাতর মুখ নিয়ে বেঁকে ধনুক হয়ে রয়েছে মোহরের দেহটা।
রগের শিরাগুলো আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ফুঁসে ওঠা শিরা দিয়ে নীলচে রক্ত চলাচল করছে। অপ্রকৃতিস্থ হয়ে থাকা শরীরের মধ্যে ভয়ঙ্কর হল ওর চোখ দুটো। ওই চোখ দেখেই আমি আগেরদিন জ্ঞান হারিয়েছিলাম। চোখের তারা প্রসারিত হয়ে সাদা অংশ ঢেকে ফেলেছে। মিশকালো রঙ। হাতের বড় বড় নখ দিয়ে শানে আঁচড়। কাটছে। গা শিরশিরিয়ে উঠল আমার। মোহরের গলা থেকে গার্গল করার মতন ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে।
আমার মুখ থেকে হাঁফ ছাড়ার একটা শব্দ হল। ভয় পেয়ে পায়ের আঙুলগুলোকে সঙ্কুচিত করে ফেলেছি। কাঁপছে আমার সারা শরীর। এক পা, এক পা করে মোহরের দিকে এগোলাম। আস্তে-আস্তে নিচু হয়ে ওর গায়ে হাত দিতেই আবার সেই এক অনুভূতি। মনে হল ডিপ ফ্রিজের মধ্যে হাত ভরে দিয়েছি।
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। ঠোঁট চাটছি। মোহর কীভাবে আবার স্বাভাবিক হবে, সেটাই তখন একমাত্র চিন্তা। ও নিজের অস্বাভাবিকর নিয়ে মিথ্যে বলেছিল। ওর সঙ্গে কথা বলার পরে স্লিপ প্যারালিসিস রোগটা নিয়ে আমি ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলাম। সেখানে কোথাও ওর এমন অবস্থার কথা বলা নেই। মিঠু কাকিমাকে ডাকব? হঠাৎই মনে হল ওকে জাগিয়ে তোলাটাই প্রথম কাজ। বুক ভরে দম নিলাম। মোবাইলের আলো ঘরে ঘুরিয়ে আমার জলের বোতলটা কোথায় রেখেছি দেখে নিলাম আগে। মাত্র পাঁচ কদম দূরে। মনে হল পাঁচশো পা হাঁটছি। জলের বোতলটা নিয়ে ফিরে এসে সব জলটা ঢেলে দিলাম মোহরের মুখে।
বিরাট ভুল করলাম। জলটা মোহরের মুখে পড়ামাত্র ওর সারা শরীর বেয়ে যেন বিদ্যুতের তরঙ্গ খেলে গেল। একটা প্রচণ্ড খিঁচুনি শুরু হয়ে গেল ওর সারা দেহে। শরীরটা যন্ত্রণায় বেঁকেচুরে নীল হয়ে উঠতে লাগল। ঘড়ঘড়ে শব্দটা বন্ধ হয়ে গোঙানি শুরু হল এবার। আচমকাই মোহর পুরো উলটে হাঁটু গেড়ে বসল। ওর বুকটা হাপরের মতন ওঠানামা করছে। দুই হাত, দুই পায়ে ভর দিয়ে থাকা মোহরকে এখন হিংস্র পশুর মতন দেখাচ্ছে।
‘মোহর?”
আঁধার ভরা চোখ নিয়ে মোহর মুখ তুলে তেড়ে আসতেই আমার ফোনটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে নিভে গেল।
মোহর পরদিন ভোরেই রুম ছেড়ে চলে যায় আমার জ্ঞান ফেরার আগেই। মিঠু কাকিমা ব্রেকফাস্ট দিতে এসে বললেন, ট্রিটমেন্ট কাল শেষ হয়ে গেছে বলে মোহর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে চলে গেছে। সেদিন আর বেরোলাম না। সারাদিন শুয়ে রইলাম। আমি যা দেখেছি, তা কেউ বিশ্বাস করবে না। মিঠু কাকিমাকেও বলতে পারিনি তাই।
মোহরের জন্য চিন্তা হচ্ছিল। অজানা শঙ্কাও আমাকে গ্রাস করছিল। মোহরকে রাতে ওভাবে দেখার পর আমি যখন জ্ঞান। হারাই, তার পরেও নিশ্চয়ই অনেক কিছু ঘটেছে। আমি সামনে থাকলেও সাক্ষী হতে পারিনি। ভাবতে ভাবতে রাতে শেষ না করা বইটা আবার হাতে তুলে নিলাম। বইটা খুলতেই আমি অবাক। একটা কাগজ। একটা চিঠি। মোহর লিখে রেখে গেছে আমার নামে।
প্রিয় সংযুক্তা,
এভাবে জানিয়ে যেতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু তোমার মুখোমুখি হওয়ার মতন সাহস আমার নেই। আমি এখানে কোনও ট্রিটমেন্ট করাতে আসিনি। আমি মুক্তি খুঁজতে এসেছিলাম। পেয়েছি। ধন্যবাদ তার জনো। আমি জানি, পুরোটা পড়ার পর থেকে তুমি আমাকে ঘেন্না করবে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার সামনে আর কোনও পথ খোলা ছিল না।
আমার সঙ্গে এসব শুরু হয় প্রায় এক বছর আগে, আগে যেখানে পেয়িং গেস্ট ছিলাম—সেখানে। তোমার মতনই একটা রুমে আমি একা থাকতাম। একজন নতুন রুমমেট এল। মেয়েটা জার্মানি থেকে সদ্য ফিরেছিল। ওর ঝকঝকে অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারের বাইরেও ওর পোর্টফোলিওতে আরও একটা ব্যাপার ছিল, যেটা পরে জানতে পারি।
মেয়েটা রাতে ঘুমের ঘোরে অদ্ভুত শব্দ করত। আমি যেমন করতাম, ঠিক তেমনি। তোমার মতনই আমি ওকে হেল্প করার চেষ্টা করেছিলাম। তুমি যা যা করেছ, আমিও একদম সেসবই করেছিলাম। ওর মুখে জল ছিটিয়ে ওকে জাগানোর চেষ্টা করেছিলাম। সেদিন ও আমাকে আক্রমণ করেছিল। সেই থেকেই এই অদ্ভুত ভয়াল ব্যাপারটা আমার সঙ্গে ঘটতে শুরু করে।
আমার বুকের ওপরে একটা পিশাচ এসে বসে থাকতে শুরু করল প্রায়দিন রাত্তিরেই। সেই সব রাতে আমার ঘুমের মধ্যে অমন হয়। কান্না পায়। কী ভারী পিশাচটা। কী ভয়ানক তাকে দেখতে। আমি তার স্পর্শ জানি। গন্ধ চিনি। পায়ের শব্দ শুনি। সে আমাকে ভয় দেখায়। তারপর আমার ঘাড়ে নিজের লম্বা লম্বা দাঁত ফুটিয়ে রক্ত খায়। প্রথমবার ওই পিশাচ আমার কাছে আসে তিনশো আটান্ন দিন আগে। ভাদ্র মাসের বাইশ তারিখ। এটা আসলে একটা অভিশাপ। মেয়েটা আমাকে বলেছিল, ও একজনের থেকে শাপটা কুড়িয়েছে। জার্মানদের ভাষা থেকে তর্জমা করলে “ঘুম পিশাচ’। ওরা বলে ‘মারা’।
পিশাচ যার ওপরে ভর করে, তার প্রাণশক্তি চুষে খেয়ে তাকে ছিবড়ে করে ফেলে। বাঁচার উপায় একটাই, যখন পিশাচ ভর করবে, তখন যদি কেউ তাকে বাধা দেয়, এবং পিশাচ যদি সেই মুহূর্তে তাকে আক্রমণ করে, তবেই এই শাপ থেকে মুক্তি ঘটবে। সেই শাপ তখন বাধাদানকারী ব্যক্তিতে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে। মেয়েটার কথা প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পরে করতে বাধ্য হয়েছি।
আমি মরতে বসেছিলাম, সংযুক্তা। তুমি আমার যে রূপ দেখেছ, তা সমস্ত সারবস্তু চুষে নেওয়ার পরের অবস্থা। আমাকে দেখতে কী সুন্দর ছিল, আর কী হয়েছিল তা বলে বোঝাতে পারব না। ওই পিশাচের অত্যাচার আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আশা করি, তুমি আমার অবস্থাটা বুঝছ। আমি তাই মুক্তির পথ খুঁজেছি। তুমিও একদিন এভাবেই মুক্তি পাবে বলেই আমার বিশ্বাস। সেদিন অন্তত আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমার জন্যে অনেক শুভকামনা রইল।
ইতি মোহর।
সত্যি বলতে কী আমি মোহরের চিঠিটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। হ্যাঁ, আমি নিজের চোখে ওর করুণ অবস্থা দেখেছি। ভয়াবহ ছিল। সেসব দৃশ্য। কিন্তু কোনও পিশাচের জন্যে ওগুলো ঘটছিল, আর আমি বাধা দিয়েছি বলে তার ছায়া আমার ওপরে ভর করবে এসব আমি বিশ্বাস করিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার’ গ্রুপের সদস্য হওয়ার সুবাদে ঢের জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। কত পুরোনো দালান, জংলা জায়গায় রাত কাটিয়েছি প্রচলিত ভূতের খোঁজে। মোহর এসবে ভয় পায়, বিশ্বাস করে, আমি করব না। কোনও অজানা কারণে হয়তো ওর ঘুমের একটা সমস্যা আছে। ঘুম না হওয়াতে স্নায়বিক বৈকল্য দেখা দিয়েছে। তারই ফলের সাক্ষী হয়েছি।
মোহর চলে যাওয়ার পরে পাঁচ দিন ভালোই কাটল। রুমে আবার একলা। সমস্যাটা ষষ্ঠ দিনে হল। সরি, দিনে নয় রাতে।
ওই রাতে আচমকাই আমার ঘুম ভেঙে গেল। দম নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন খুব ভারী কিছু বা কেউ আমার বুকে চেপে বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন আমি একটু স্বাভাবিক হয়েছি, তখন জানলা দিয়ে এসে পড়া হলদেটে স্ট্রিট লাইটের আবছা আলোয় আমি একটা মুখ দেখতে পেলাম। ভয়ানক একটা চেহারা।
চোখ দুটো আংরার মতন লাল টকটক করছে। জ্বলছে যেন। গোটা মুখটাতে কর্কশ বাদামি রোঁয়া। মাথায় দুটো শিং পাক খেয়ে উঠেছে। ছুঁচলো কান। মুখের কাছটা তুণ্ডবৎ হয়ে শেষ হয়েছে। নাকের রঙ কালো। একজোড়া দাঁত নীচের চোয়াল থেকে বেরিয়ে উঠে এসেছে ঠিক বুনো শুয়োরের দাঁতের মতন। মাথাটা যতটা বড় বাকি শরীরটা সেই তুলনায় অনেকটাই ছোট। দেহের শেষভাগে একটা লেজ। লেজটা ঠিক চাবুকের মতন দেখতে। লেজের ডগাটা ঠিক যেন বল্লমের ফলা।
অত ভয় আমি জীবনে কখনও পাইনি। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে গলা থেকে সেভাবে কোনও শব্দই বেরোল না। নিজের কানকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শুধু একটা অস্পষ্ট অথচ তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা যাচ্ছিল… কিইইইইই…..
অসহায়ের মতন মনে-মনে বলে চলেছিলাম, “না না না…এ সত্যি হতেই পারে না।’
অপার্থিব ওই প্রাণীটাকে আমি বুক থেকে নামানোর জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করলাম। থুতু ছুঁড়তে চাইলাম – কিন্তু পারলাম না। হাত দিয়ে ঠেলতে চাইলাম, স্পর্শও করা গেল না।
ওটাই পিশাচ। মোহরের বলা সেই পিশাচ। পিশাচটা হাসতে শুরু করল। সে কী বিকট অট্টহাসি। উফ্! রোঁয়াওয়ালা ঠোঁট সরে দেখা দিল ইকড়িমিকড়ি অথচ ধারালো দাঁতের সারি। পিশাচ আমার ঘাড়ের কাছে মুখটা নামিয়ে আনল। ওর মুখ থেকে ভকভক করে ধেয়ে এল অসম্ভব দুর্গন্ধ। তখনি সাপের জিভের মতন চেরা লকলকে জিভখানা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আমার কানে ঢুকিয়ে দিল। পিশাচটা।
আগে যদি একটি বারের জন্যেও বুঝতে পারতাম মোহর আসলে নিজের শাপটা অন্যের ঘাড়ে চালিয়ে মুক্তির পথ খুঁজছে, তাহলে আমি ওই ভুল করতাম না। এখন প্রায়দিনই রাতে পিশাচটা এসে আমার প্রাণশক্তি শুষে খেয়ে যায়। এ এক অমানুষিক অত্যাচার। তিলে তিলে মরছি, আর রোজ অপেক্ষা করছি—আজ রাতে কি পিশাচ আসবে?
মিঠু কাকিমাকে এসব বলিনি। বলে কোনও লাভ হবে না। বিশ্বাস করবে না। একলা সহ্য করছি সব। আমার এখনও কোনও রুমমেট নেই। একদিকে ভালোই হয়েছে। রুমমেট থাকলেই আমার শাপটা কখন তার ওপরে গিয়ে বর্ষিত হবে কে জানে! আমি চাই না আমার জন্যে কারো ক্ষতি হোক। তবে কতদিন এই অত্যাচার সইতে পারব তাও জানি না। আমি কখনও মোহরকে সাহায্য করতে যেতাম না, যদি জানতাম যে, মোহর ঘুমোলে পিশাচ হয়ে যায়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.