আয়নার মতো – তন্দ্ৰা বন্দ্যোপাধ্যায় Aynar Moto by Tandra Bandyopadhyay

আয়নার মতো - তন্দ্ৰা বন্দ্যোপাধ্যায় Aynar Moto by Tandra Bandyopadhyay
আয়নার মতো - তন্দ্ৰা বন্দ্যোপাধ্যায় Aynar Moto by Tandra Bandyopadhyay

তন্দ্ৰা বন্দ্যোপাধ্যায় এর ভয়ংকর হরর আয়নার মতো Aynar Moto পড়ুন। আয়নার মতো Aynar Moto গল্পটি বিভা ভূত ভুতুম উৎসব সংখ্যা ১৪৩০ (২০২৩) পিডিএফ Biva Bhut Bhutum Utsav Sankhya 1430 pdf থেকে নেওয়া হয়েছে।

আয়নার মতো - তন্দ্ৰা বন্দ্যোপাধ্যায় Aynar Moto by Tandra Bandyopadhyay
আয়নার মতো Aynar Moto cover

আয়নার মতো Aynar Moto কাহিনী সংক্ষেপঃ

ছোটোপিসি মারা যাওয়ার পর, তার একমাত্র মেয়ে নৈঋতি-র ঠাই হল মামা-বাড়িতে। ত্রিধারাদের বেশ বুঝতে পারছিল আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয় নৈঋতি। এক অভিশপ্ত অতীতও রয়েছে তার। তারপর?

আয়নার মতো Aynar Moto গল্পঃ

আমার পিসতুতো বোন নৈঋতি যখন আমাদের সঙ্গে থাকতে এল তখন ওর বয়স এই সাত-আট হবে। ওর ইতিহাস একটু অন্যরকম।

ওর মা, মানে আমার ছোটোপিসি অনিন্দিতা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন যাকে, শুনেছি সে ছিল সব দিক দিয়েই অযোগ্য, কিন্তু সুদর্শন ও কথাবার্তায় চতুর। বাড়ির সকলের প্রবল অমত ছিল মনে হয় সংগত কারণেই। ছোটোপিসি মোহমুগ্ধ হয়ে ভুল করেছিলেন নিশ্চয়ই, বাপের বাড়ির সঙ্গে সব সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন। আদরের সুন্দরী ছোটোমেয়ের এই ব্যবহারে আমার সেকেলে দাদু-ঠাকুমা অত্যন্ত আঘাত পেয়েছিলেন। বাড়ির অন্য সবাইও। প্রাথমিক রাগ, ক্ষোভ ও অভিমানের পর ছোটোপিসির খোঁজ করা হয়েছিল, বিশেষ করে বাবা ও জেঠু অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। সম্ভবত ইচ্ছে করেই অন্তর্ধান করেছিলেন পরিচিতদের জগৎ থেকে। বন্ধুবান্ধবেরাও কিছু জানত না।

অবশ্য এসবই আমার শোনা কথা। তখন আমি নেহাতই ছোটো, বিশেষ কিছু মনে থাকার কথাও নয়। খুব আবছা মনে আছে ছোটোপিসিকে। দাদাভাই অর্থাৎ জ্যেঠতুতো দাদা অরিত্রর বয়স একটু বেশি ছিল, তবে তারও স্মৃতি অস্পষ্ট। তবে একটু বড়ো হয়ে আভাসে ইঙ্গিতে বুঝেছিলাম, ছোটোপিসি বাড়িতে অত্যধিক আদর পেয়ে কিছুটা বিগড়ে গিয়েছিলেন, স্বভাব যাকে বলে দুর্দমনীয় তা-ই হয়ে উঠেছিল। পছন্দের প্রেমিকটিকে যে পরিবারের কেউ মেনে নেবে না সেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরে কাউকে না জানিয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে। অবশ্য দাদু-ঠাকুমা কখনও ছোটোপিসির নাম করতেন না এটা জানি, অন্যরাও প্রকাশ্যে ও-প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেত। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কৌতূহলও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাপা পড়ে গিয়েছিল। তেরো-চৌদ্দো বছর পরে- তখন আমি কলেজে পড়ি যখন ছোটোপিসির হদিশ পাওয়া গেল, ততদিনে দাদু-ঠাকুমা গত হয়েছেন। ছোটোপিসিই খবর পাঠিয়েছিলেন।

উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক আধা শহরের সরকারি হাসপাতালে যখন জেঠু আর বাবা পৌঁছোলেন তখন ছোটোপিসি মৃত্যুশয্যায়। তাঁর স্বামী নাকি কিছুদিন আগেই মারা গেছেন। তাঁর অসুখী তিক্ত দাম্পত্যজীবনের বঞ্চনা, হতাশা ও কঠিন সমস্যার ইতিহাস এবং কেন তিনি পিতৃগৃহে ফিরে যাননি—এ নিয়ে তিনি কী এবং কতটা বলেছিলেন তা আমি ঠিক জানি না। তবে এর পর অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি মারা যান। তার আগে তাঁর একমাত্র সন্তান নৈঋতির ভার বাবা-জেঠুকে নিতে অনুরোধ করেন।

স্বভাবতই সবটা জেনে পরিবারের সকলে খুব বিচলিত ও বিষণ্ণ হল। এর পরের কয়েক দিন যা যা করণীয়, কর্তব্য ও প্রয়োজন সেরে বাবা-রা ফিরে এলেন, ছ-সাত বছরের নৈঋতিকে নিয়ে। সে নাকি গত কয়েকদিন তাদের পাশের ঘরের ভাড়াটে এক বৃদ্ধার কাছে ছিল। বাবা আর জেঠুর সঙ্গে মা, জেঠিমা ও বড়োপিসির- তিনি তাঁর শ্বশুরবাড়ি মালদা থেকে এসেছিলেন— আলোচনা শুনে বুঝেছিলাম ছোটোপিসিদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল এবং পিসির স্বামী-লোকটাকে পিসেমশাই বলে ভাবতে পারছিলাম না-বিশেষ উপার্জন করতেন না, নেশা-ভাং এবং নানা রকম আনুষঙ্গিক চরিত্রদোষও ছিল। পরিবারের ওপর অত্যাচারও করতেন। কেউ সাহায্য করার ছিল না, ওই বৃদ্ধাই যা একটু দেখাশোনা করতেন।

“অনু নাকি প্রায়ই অসুস্থ থাকত, তখন মেয়েটা ওঁর ভরসাতেই থাকত মনে হয়… বাপটা তো অমানুষ ছিল একটা” কথাটা বলে জেঠু নিশ্বাস ফেলেছিলেন, বাবা মুখ নীচু করে ছিলেন। “একটু আগেও যদি জানতে পারতাম…ভবিতব্য। তা-ও, মেয়েটা এখানে অন্তত বেঁচে যাবে একটা স্বাভাবিক জীবন পেয়ে।” মা, জেঠিমা দেখলাম আঁচলে চোখের জল মুছছেন। আমারও কান্না পাচ্ছিল। ইশ ওইটুকু মেয়ে!

নৈঋতির হাত ধরে মা ওকে আমার কাছে এনে বললেন, “এই দ্যাখো, তোমার একজন দিদি, ওর নাম ত্রিধারা। তুমি ওকে তিতিদি বলে ডেকো, কেমন?” সস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন একটু।

আমি দেখলাম ও খুব রোগা, ফর্সা, চুলগুলো একটু বাদামি, বড়ো বড়ো চোখদুটোও তাই। আমি ওকে দোতলায় নিজের ঘরে নিয়ে গেলাম, ভাব করব বলে। বুঝতে পারলাম মেয়েটি শান্ত, চুপচাপ, খুব কম কথা বলে।

কয়েকটা কথার পর ওকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বললাম, “এই যে দ্যাখো, এটা তোমার ঘর। পছন্দ হয়েছে? এই যে তোমার বাথরুম। তোমার জন্যে নতুন সাবান, শ্যাম্পু, ক্রিম, তোয়ালে, টুথব্রাশ সব আছে দ্যাখো। আর আমাদের দুটো ঘরের মাঝখানে এই যে দরজা, খোলা রাখতে পারো।” নৈঋতি ঘরটা দেখল, চোখে একটু বিস্ময়। মাথাটা হেলাল

কিন্তু কিছু বলল না। আমি বললাম, “একা ঘরে থাকতে তোমার ভয় করবে না তো?”

আমার দিকে তাকাল না ও। শুধু বলল, “আমার ভয় করে না।” ওর গলা কোমল, নীচু।

“ও… তা, ভালো তো। এই যে বিস্তি-মাসি তোমার জিনিসপত্র বাক্স-ব্যাগ সব এনে রেখেছে। এসো গুছিয়ে দিই। আর যা যা দরকার লাগবে, আমায় বোলো, সব কিনে দেব। তোমার যা কিছু প্রয়োজন হবে, ইচ্ছে হবে, আমায় বলবে, ঠিক আছে তো?”

“আচ্ছা, তিতিদি।”

“কাল-পরশু দোকানে যাব তোমায় নিয়ে, তুমি পছন্দ করে সব কিনো।” ওর জিনিসপত্র জামাকাপড় খুবই অল্প ও সামান্য। আমার ভারি মায়া হচ্ছিল।

বললাম, “আজ খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়বে চলো। ক্লান্ত আছ।”

মা-জেঠিমা ওকে যত্ন করে খাওয়ালেন। জেঠিমা বললেন, “এটা তোমার বাড়ি এখন, নিজের মতো করে থাকবে। কী কী খেতে ভালোবাসো বলবে।” বাবা বললেন, “আর তিন-চার মাস পরে স্কুলের নতুন সেশান আরম্ভ হবে, তখন ভরতি হবে। ততদিন বাড়িতে পড়াশোনা কোরো, তোমার তিতিদিদি তোমায় পড়া দেখিয়ে দেবে। তোমার অরিদা হোস্টেলে থেকে কলেজে পড়ে জানো তো। তোমার বড়োমামার ছেলে নৈঋতি মাথা হেলাল শুধু। নিজে থেকে সত্যিই খুব কম কথা বলে মেয়েটা। ওপরে গিয়ে ওর বিছানা-বালিশ চাদর সব ঠিক করে দিলাম। বললাম, “দুটো ঘরের মাঝখানে এই আলোটা জ্বালা থাক, নইলে অন্ধকারে… নতুন জায়গা তো, ভয়-টয় করে যদি….।”

এবার ও আমার দিকে তাকাল, বলল, “অন্ধকারে ঘুমোবার অভ্যেস আছে আমার। আমায় ঘরে বন্ধ করে রাখত যে।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “কে রাখত? কেন?”

“বাবা। বাবা খুব রাগি ছিল। মা-র অসুখ করত তো খুব, তখন আমি কাঁদতাম আর বাবা আমায় ছোটো ঘরটায় বন্ধ করে রাখত, খেতে দিতে ভুলে যেত। ওঘরে আলো ছিল না। মাকড়সা আর আরশোলা ছিল। তারপর বাবা ঘুমিয়ে পড়লে তারাঠামা চুপি-চুপি এসে দরজা খুলে দিয়ে আমায় খেতে দিত, মাকে সাবু করে দিত।”

আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। ওকে কি সান্ত্বনা দেওয়া উচিত? আস্তে করে শুধু বললাম, “তুমি শুয়ে পড়ো এখন, রাত্তিরে কিছু দরকার হলে আমায় ডেকো।”

পরের দিন ওকে বললাম, “আমি কলেজে পড়ি। সন্ধেবেলা আমরা একসঙ্গে বসে পড়াশোনা করব। তুমি বই পড়তে ভালোবাসো?”

“হ্যাঁ।”

“আমার ঘরে ছোটোদের বইও আছে, তুমি পড়তে পারো। তোমাকে বই কিনে দেব, কেমন? নৈঋতি, আচ্ছা তোমার কোনো ডাক-নাম নেই? ”

“বাবা আমায় ‘নেই” বলত। বাবা চায়নি আমি জন্মাই, তাই। মা বলত…” থেমে গেল। তারপর বলল, “আর তারা-ঠাকমা বলত, ডাকনাম দিয়ে কাউকে বেঁধে রাখা যায় না।”

“উনি তোমাদের পাশেই থাকতেন, না?”

“হ্যাঁ তো। তারা-ঠাকুমা অনেক কিছু জানত। বাবা মরে যাওয়ার পরে আমার খুব অসুখ করেছিল একবার, মা খুব কাঁদত, তখন তারাঠামা মা’কে বলেছিল, তোর গিঁটটা খুলে দিয়ে তোর মেয়েরটা এখনকার মতো বেঁধে দিচ্ছি, কিন্তু পরে কী হবে বলা যায় না। আগেও দিয়েছিলাম ওর জন্মের পর, তার ফল দেখলি তো…।” থেমে গেল।

কথাটা কেমন যেন লাগল, বুঝতে পারলাম না ঠিক। তবে আর কিছু বললাম না।

মা’রা ওর ডাকনাম দিলেন ‘নীরু’। ও বেশ মানিয়ে নিল এ-বাড়িতে। খুব শান্ত, গলা তুলে কথা বলে না কখনও। চাহিদা বলে কিচ্ছু ছিল না ওর। যা দেওয়া হত খেয়ে নিত, কোনোদিন কিছু চেয়ে খেতে দেখিনি। একবার প্রশ্ন করতে বলেছিল, “তোমরা আমাকে তো সবই দিয়েছ। আমার তো আর কিছু চাই না।” ওইটুকু মেয়ের মুখে কথাটা কেমন অদ্ভূত লেগেছিল। বাবা বলেছিলেন, “ বোধহয় ও কখনও সেভাবে যত্ন বা মনোযোগ পায়নি। সময় লাগবে একটু। হয়তো অস্বস্তিবোধ করে।”

“এখন ওকে নিজের মতো করে থাকতে দেওয়া হোক। এতটা মানসিক ট্রমা, সামলে নিতে সময় তো লাগবেই।” জেঠিমার এই মতটাই মেনে নেওয়া হল বাড়িতে।

ও যেন ছায়ার মতো মিশে থাকত ওর পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে, সকলের মনোযোগের বাইরে একটা নিজস্ব বৃত্তে। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত হলেও, আমি খেয়াল করলাম, সত্যি । পারিবারিক বা সামাজিক জমায়েতে নীরুর উপস্থিতি আক্ষরিক অর্থেই কেমন যেন বোঝা যেত না। অবশ্য ঠাহর করে দেখলে ঠিকই দেখা যায়, ওই তো ও চুপচাপ বসে বড়োপিসির পাশেকোণের সোফাটায়, লেস দেওয়া ফিকে সবুজ ড্রেসটায় সুন্দর মানিয়েছে, বড়োপিসি কী যেন বলছেন ওকে… অথচ আমি ঠিক জানি আমি যদি কাল কাউকে জিজ্ঞেস করি, খুব কম লোকই পারবে বলতে নীরু কী রঙের জামা পরেছিল, কোথায় বসেছিল। সত্যনারায়ণ পুজোর পরের দিন সকালে আমি ইচ্ছে করেই বললাম, “বড়োপিসি কাল নীরুর সঙ্গে কীসের গল্প করছিলে গো, খুব হাত-পা নেড়ে?”

মুহূর্তের জন্য ওঁকে কেমন বিভ্রান্ত দেখাল। বললেন, “গল্প…?” আর একটু দুরে ফলের রসের গ্লাস হাতে বসে থাকা নীরু বলল, “মাসি আমায় পড়াশোনা নিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন।” বড়োপিসি বললেন, “হ্যাঁ, ওই….।” কে যেন ডাকতে উঠে গেলেন। আর আমি তাকিয়ে দেখলাম নীরু আমার দিকে চেয়ে আছে, চোখের দৃষ্টিতে ঈষৎ বিস্ময়, যেন অপ্রত্যাশিত কিছু দেখেছে।

খুব মেধাবী ছিল ও। সেটা ওর পড়াশোনার তত্ত্বাবধান করতে গিয়ে বুঝেছিলাম। আর এই বয়সেই কিছু অ-প্রথানুগ বই পড়ে ফেলেছিল, যেমন কাশীদাসী মহাভারত, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কিছু পুরাণ গোছের বই, সেকেলে লেখকদের কিছু লেখা এবং এটা অদ্ভুত পাঁজি। বলেছিল এগুলো নাকি ওর তারাঠামার ঘরে থাকত ।
একদিন আমি আমাদের দোতলার বারান্দায় নীরুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বলছিলাম, “সামনের ওই যে হলদে বাড়িটা দেখছিস, ওঁদের বাগানে গোলাপ কী সুন্দর ফোটে দেখবি।” আর নীরু হঠাৎ বলল, “ওই বাড়ির বারান্দায় আজকাল একটা বাঘ ঘুরে বেড়ায়।” বলে ফেলে যেন নিজেই চমকে গেল।

আমি অবাক হয়ে বললাম, “বাঘ? কোথায়? মানে, বাঘ? ” “ওই তো ওদের বাড়ির লাল বারান্দাটায়। ছাদের আলসে দিয়ে হাঁটে। সদর দরজায় বসে থাকে।”

“নীরু, কী যে সব বলিস না! স্বপ্ন দেখেছিস নাকি!” আমি হেসে ফেলি। ততদিনে অবশ্য আমি নীরুকে ‘তুই’ বলছি। নীরু হাসে না। ঘাড় হেলিয়ে সামনের বাড়িটার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, “না। স্বপ্ন নয়। আমি ঠিকই দেখেছি।” আস্তে আস্তে ঘরের ভেতরে চলে যায়। আমি ঈষৎ বিচলিত বোধ করতে থাকি। আমার কি কাউকে কিছু বলা উচিত। কী বলব? নীরু নানারকম ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে এবং নিরাপত্তার অভাবের ফলে ভয়ের প্রতিমূর্তি দেখছে। এটা ছাড়া কী আর হতে পারে? পরে সেরকম কিছু বুঝলে বরং…. এর পরের দিন সামনের বাড়ির দোতলার বড়োকর্তা ঘুমের মধ্যে মারা গেলেন। উনি সপরিবারে ওপরে থাকতেন। নীচের ছোটোকর্তারা যখন ফোন করে আমাদের জানালেন, নীরু একবার আমার দিকে তাকিয়ে ওপরে চলে গেল।

“সাড়ন হার্ট অ্যাটাক” পরে কে যেন বলছিল। আমি ওপরে গিয়ে দেখি নীরু বই পড়ছে। আমি বললাম, “নীর…।” আর ও কেমন নৈব্যক্তিক গলায় বলল, “বাঘ এসেছিল। তোমায় বলিনি?”
আর আমি যেন দেখতে পেলাম, রায়জেঠুদের বারান্দায় গুঁড়ি মেরে বসে অপেক্ষা করছে চাবুকের মতো একটা বাঘ …. না কি বাঘ নয়, অন্য কিছু?
নীরু আবার বইয়ের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল। আমি একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সরে এলাম।

একদিন আমি আর নীরু কাছের দোকান থেকে টুকটাক জিনিস কিনে ফেরার পথে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। আমার বন্ধু সীমাশ্রী আর সুপান্থের সঙ্গে দেখা হতে দাঁড়িয়ে একটু কথা হল। স্কুলের বন্ধু ছিল, এখন আর নিয়মিত দেখা হয় না। কীরকম যেন আলগা, ছাড়া ছাড়া ভাব মনে হচ্ছিল ওদের, যেন কিছু নিয়ে খুব বিচলিত। ওরা চলে যেতে আমি দেখলাম নীরু ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
“কী দেখছিস রে ওদিকে?” শপিং-এর ব্যাগটা হাত-বদল করে জিজ্ঞেস করলাম।
অন্যমনস্কভাবে বলল, “ওদিকে একটা গেট আছে…।” “কোথায় রে?”

“ওই তো, ওই দিকে সামনে, রাস্তায়। তোমার বন্ধুরা, একজন পেরিয়ে গেল, আর একজন আটকে গেল….।”
“রাস্তায় আবার কীসের গেট! ওদিকে তো মিষ্টির দোকান, মুদিখানা আর গ্যাস কোম্পানির অফিস… কে পেরিয়ে গেল, কোনজন ? ”
“সেটাই বুঝতে পারলাম না…,” হঠাৎ সচেতন হয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, “ও কিচ্ছু না, তিতিদি, চলো বাড়ি যাই।”

আমার মনে কেমন যেন একটা ধাঁধা লেগে রইল। দু’চার-দিন পরে এক ছুটির বিকেলে আমার পাড়ার বান্ধবী মধুস্মিতা ফোন করল। প্রাথমিক কথার পর বলল, “এই, ত্রিধারা, সুপান্থর কথা শুনেছিস, কী ভীষণ দুঃখের…।”
সচকিত হয়ে বললাম, “কী হয়েছে রে… সেদিনই তো সুপান্থ আর সীমাশ্রীর সঙ্গে দেখা হল রাস্তায়, একটু কেমন যেন মনে হচ্ছিল ওদের হাবভাব।”
“আরে অনেক কাণ্ড। ওদের সেই ক্লাস সেভেন থেকেই লুকিয়ে প্রেম… আমরা তো জানতামই।”
“হ্যাঁ, সে তো…।” আমি আমার ঘরের জানলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মেঘ ঘনিয়ে এসেছে।

“ইদানীং দু-জনেরই বাড়ি থেকে জানতে পেরে গিয়ে বিরাট ঝামেলা বেঁধেছিল। ওই সব জাত-ধর্মের ব্যাপার, খুব গোঁড়া দু-পক্ষই। সীমাশ্রীর ফ্যামিলি তো জানিসই, জোর করে কোথায় যেন ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল আর সুপান্থকে ওর বাড়ির লোকজন ক্যানাডায় ওর দাদার কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিল।”
“সত্যি, এরা সব… এত কড়াকড়ি আজকালকার দিনেও।” “শোন ত্রিধারা, তারপর… দু-জনেই নাকি সুইসাইড প্যাক্ট করেছিল, ঘুমের ওষুধের ওভারডোজ। সুপান্থর দাদুর ওষুধ, বাড়িতে ছিল। পরশু রাত্রেই দু-জনেই খেয়েছিল। হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল, সীমাশ্ৰী বেঁচে গেছে কোনোরকমে, কিন্তু সুপান্থ, সুপান্থকে আর…।”

আমি চমকে বললাম, “সে কী রে।” মধুস্মিতা থেমে গেল, কাঁদছিল বোধহয়। ওদের বাড়ি সীমু- সুপান্থদের বাড়ির পাড়াতেই, ওরা ছোটোবেলাকার চেনা বন্ধু সব।
বাইরে জোরে একটা বাজ পড়ল, বৃষ্টি শুরু হল ঝমঝম করে। ফোন রেখে দিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলাম চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে। খানিকক্ষণ পরে একটা শব্দ পেয়ে দেখি “নীরু, এখানে
দরজার কাছে নীরু এসে দাঁড়িয়েছে। বললাম, ‘ এসে বোস।”
ও পায়ে পায়ে এসে আমার খাটে বসল।

“নীরু, তুই কী দেখেছিলি রে সেদিন রাস্তায় ? গেট, বললি
না?”
“হ্যাঁ।”
“আমার বন্ধুরা সেদিকে যাচ্ছিল? তারপর কী হল ঠিক ? একজন পেরিয়ে গেল? কে… কোনজন?”
“ঠিক বুঝতে পারিনি, দু-জনেই কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, তারপর একজন রয়ে গেল… তারপর মিলিয়ে গেল সব… আমি, আমি এরকম দেখি মাঝে মাঝে।”
আমি উঠে বসলাম। “ওদের মধ্যে একজন মারা গেছে। কী করে দেখিস… মানে, কেন….।” কীভাবে প্রশ্ন করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
তারাঠামা আমায় বলেছিল আমি দেখতে পাব। সেই থেকে দেখতে পাই…। সব সময় না। কখনও-কখনও।” বাইরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। তারপর মেঘের গর্জন। নীরু নিজের মনেই বলছিল, “ঠাকমা বলেছিল ওটা
নখদর্পণের মতো।”

“নখদর্পণ? সেই যে নখের ওপর দেখা যায়, কী হবে, কী হয়েছিল, দূরের কোনো জায়গায় কী হচ্ছে, সেইরকম। কিন্তু তুই তো…।”
“এটা অন্যরকম…।”
আমার নিজেরই মনে হল, এইটুকু মেয়ের সঙ্গে এ কী আলোচনা করছি। কিন্তু বয়সের তুলনায় নীরুকে অনেক বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মনে হয়। ওর দিকে তাকালাম, সেই অদ্ভুত দূরমনস্ক দৃষ্টি ওর চোখে, যেটা আমি লক্ষ করেছি আগেও।
“মা’র যখন অসুখ করত, শুয়ে থাকত, ঘুমোত ওষুধ খেয়ে, যন্ত্রণা হত কিনা! আমি বসে থাকতাম একলা মা’র পাশে। আমার ভয় করত। বাবা অনেক রাত্তিরে ফিরত….. সবাই বলত, নেশা করে এসেছে। খুব চ্যাঁচামেচি করত, আমায় মারতে যেত, বই ছিঁড়ে দিত, পাশের একটা ঘরে বন্ধ করে রাখত…. সেখানে আলো ছিল না।”
আমার চোখে জল আসছিল। কিন্তু নীরুর গলা কেমন নির্লিপ্ত ।

“তারাঠামা আমায় শিখিয়ে দিয়েছিল কী করে অন্য কোথাও চলে যাওয়া যায়। যখন ভয় করত, কষ্ট হত তখন খুব মন দিয়ে ভাবলে আমি চলে যেতাম।”
“কীরকম জায়গা রে?”
“অন্যরকম সব জায়গা… সেখানে সব কিছু আলাদা।” নীরু যেন একটু ভেবে ভেবে বলল।

“আর ওই যে দেখিস ওই বাঘটা, গেটটা, সেসব?” “ওগুলোও দেখতে পেতাম। ইচ্ছে করে নয়। এমনিই। কখনো-কখনো। ঠাকুমা বলত, ওগুলো ছবি। কী হবে, হতে পারে, তার ছবি। কিংবা আয়না। একবার দেখেছিলাম….।” “কী রে?” বাইরেটা অন্ধকার, বৃষ্টি পড়ছে আর আলোটা কেমন দপদপ করে উঠে ভোল্টেজ কমে এল। শুনতে পেলাম একতলায় সিঁড়ির নীচ থেকে রান্নার লক্ষ্মীমাসি বলছে, “অ মা কারেন যাবে নাকি গো! ও বড়োবউদি মোম আচে তো? হেরিকেনগুলো বের করব ?” বলতে বলতে অন্যদিকে চলে গেল।

“নীরু একটু চুপ করে রইল, তারপর বলল, “দেখেছিলাম, আমাদের ঘরের সিলিং-এ উলটো হয়ে কে যেন আটকে আছে। আমায় দেখছে। তারপর মিলিয়ে গেল। আবার মাঝে মাঝে দেখতাম। ঠাকমা বলল, ও কিছু না, শুধু ছবি।” আমার গা-ছমছম করে উঠল। অজান্তেই একবার সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে নিলাম। নীরু কেমন একটু হাসল। বলল, “তার পরেই বাবা… মরে গেল। সবসময় নেশা করে শরীর নাকি শেষ, ডাক্তার মা’কে বলেছিল, আমি শুনছিলাম। মা কাঁদেনি, চুপ করে ছিল। ঠাকুমা আমাদের রান্না করে দিয়েছিল। বলেছিল, খেয়ে নে। রীত-নিয়ম ওসব মিছে কথা। গিট খুলে গেছে, বেশ হয়েছে।”

নীচ থেকে মা চেঁচিয়ে ডাকলেন, “তিতি, এই তিতি । নীরু। কোথায় তোরা !”
নীরু উঠে দাঁড়াল। “তুমি নীচে যাও তিতিদি। আমি এইসব কথাগুলো… কাউকে বলি না, তুমিও বলবে না তো? আমি এখন একটু নিজের ঘরে থাকি?”
“আচ্ছা।”

বললাম না কাউকে। আমাকে বিশ্বাস করে কথাগুলো বলেছে, তার অমর্যাদা করা ঠিক হবে না। কিন্তু এ সবই কী ও হ্যালুসিনেট করছে, কিন্তু তা-ও তো ঠিক নয়, মানে ওই বাঘটা, গেটটা…। ইশ কী দুঃসহ শৈশব ছিল ওর, আমরা যদি জানতাম, তবে ছোটোপিসিই বা কিছু জানাননি কেন? কোনো কারণ ছিল কী?

দিন কাটতে থাকল। নীরু স্কুলে যেতে শুরু করল। পড়াশোনা নিয়ে কিছু অসুবিধে হল না ওর। শিক্ষিকারা বললেন, অঙ্কে খুব দখল এইটুকু বয়সেই। তবে বড্ড চুপচাপ, বন্ধুত্ব করে না বিশেষ। ওর ইতিহাস তাঁরা জানতেন, স্বভাবতই সহানুভূতি বোধ করে বলেছিলেন, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে আশা করা যায়। বাড়িতে ও যেমন ছিল তেমনই রইল, শান্ত, প্রায় নিঃশব্দ চলা-ফেরা, গলার আওয়াজ শোনাই যায় না। জেঠু একবার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “নীরু, তোর তো গলাই শুনি না রে! তুই আছিস কী নেই, বোঝাই যায় না!”
নীরু সরে গেল। আমার মনে পড়ে গেল, নীরুর বাবা ওকে ‘নেই’ বলে ডাকত।

***************************

অভিভাবকরা ভেবেচিন্তে ওর কাউন্সেলিং করালেন। নীরু যথারীতি কোনো আপত্তি করল না, তবে ও সব কথা খুলে বলবে বলে আমার মনে হল না। কাউন্সেলর ও ডাক্তারদের মতে, অল্প বয়স থেকে নানারকম প্রতিকূল পরিস্থিতি, মানসিক চাপ, বাবা- মা’র অসময়ে মৃত্যু-এসবের প্রভাব স্বভাবতই পড়েছে নীরুর ওপর। তবে ও বয়সের তুলনায় বুদ্ধিমতী এবং স্থিতিশীল স্বভাবের, বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বৃহত্তর সামাজিক বৃত্তে নিজের জায়গা করে নেবে। সুতরাং আপাতত চিন্তার কিছু নেই, স্বাভাবিকভাবেই থাকুক। বেশি অসুবিধে হলে তখন দেখা যাবে। অর্থাৎ- সেরকম কিছুই বললেন না তাঁরা।

আমার নিজস্ব জীবনের পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব, গানের ক্লাস, বই-সিনেমা- রেস্টুরেন্ট আড্ডা এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, নীরু সম্বন্ধে কৌতূহল আমার মনে স্থায়ী হয়ে ছিল। সেইসঙ্গে একটা মায়া, সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ। মেয়েটা কেমন যেন রিমোট। কাছে থেকেও দূরে। সেই যে বলেছিল, ও অন্য কোথাও চলে যেতে পারে, সেটা কি ওর কল্পনা ? একদিন রাত্রে ওর ঘরে উকি মেরে দেখি, টেবিলে বসে কী পড়ছে। বললাম, “ঘুমোসনি এখনও ?”
ও বইটা রেখে দিল। “আজ ঘুম আসবে না।” ‘কেন রে?”
“আজ রাত্তিরটা অন্যরকম তো, তাই।”
“অন্যরকম, মানে?”

“আজ অন্ধকারটা কেমন টলটলে, জলের মতো। আলোগুলো ভেঙে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে উড়ে যাচ্ছে, মুঠো করে ধরা যায়। এইরকম রাত্তিরে কত-কী দেখা যায়, জানো?” দেখলাম ও জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। পরদাটা অল্প হাওয়ায় দুলছে একটু-একটু। বাইরের কৃষ্ণচূড়া গাছটার ডালপালা ঝুপসি হয়ে আছে।
আমি ওর খাটে বসে পড়ে বললাম, “কী যে বলিস তুই মাঝে মাঝে, কিচ্ছু বুঝতে পারি না। আচ্ছা নীরু, তুই যে এইসব দেখিস, এসব তোর কাউন্সেলরকে বলেছিলি ?” “না। বলে কী হবে?”
এর অবশ্য কোনো উত্তর নেই।

“আয়, এখানে বোস। তোর চুল আঁচড়ে একটা বিনুনি করে দিই। বেশ চুলের গোছ তোর।”
বিনা বাক্যব্যয়ে চিরুনি নিয়ে আমার কাছে এসে বসল। আমি চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বললাম, “তুই যখন সকলের সঙ্গে থাকিস, তোকে কেউ লক্ষ করে না কেন রে? তোর সঙ্গে কথা বলতেই ভুলে যায় তাই না? ইচ্ছে করে করিস এটা তুই, আমি জানি।”
সামনের বড়ো আয়নাটায় দেখি নীরু একটু একটু হাসছে। কেমন দুর্বোধ্য হাসি। যেন অন্য কিছু একটা মনে হচ্ছে ওর, যেটা আমি বুঝতে পারব না।
“এই নীরু, বল না রে।”
আমি ওর বিনুনির নীচটা একটা লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে দিলাম। ও চিরুনিটা আমার হাত থেকে নিয়ে ঘুরে বসল।

দেখলাম ও আর হাসছে না। চোখে সেই সুদূর দৃষ্টি।
বলল, “আমার বাবাকে আমি খুব ভয় পেতাম। খুব বদমেজাজি ছিল। যখন ঘরে থাকত আমায় দেখলে রেগে যেত। বকত, চ্যাচাতো। মা আমাকে আগলাবার চেষ্টা করত কিন্তু পারত না। তাই আমি একেবারে চুপ করে থাকতাম…।”
আমি আলতো করে ওর গায়ে একটা হাত রাখলাম। নীরু বলে চলল, “আমি এক কোণে বসে পড়তাম, খেলতাম নিজে নিজে, তা-ও বাবা রেগে যেত, মা খুব কষ্ট পেত। বাবা আমায় একটা কাপ ছুড়ে মেরেছিল, মাথায় লেগেছিল। তখন তারাঠামা বলল, আয় তোকে নেই হয়ে থাকা শিখিয়ে দিচ্ছি। তাহলে তোকে কেউ লক্ষও করবে না, রাগ করবে না, বকবে না… তুই নিশ্চিন্তে থাকবি।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “নেই হয়ে থাকা? সেটা আবার কী রে?”
ও আমার চোখের দিকে তাকাল। বলল, “বাবা আমায় ‘নেই’ বলে ডাকত, তোমায় বলিনি? তাই আমি ‘নেই’ হয়ে থাকা শিখে নিলাম। ঠাকুমা বলেছিল, যদি তুই মন থেকে চা কেউ তোকে না দেখুক, তবে তুই ইচ্ছে করলে তাদের সামনে থেকেও আড়াল হয়ে যেতে পারবি। তোর কথা তাদের মনেই থাকবে না। ”
“নীরু, তুই কি চাস সেটা?” “কখনো-কখনো।”
“কেন রে? এখানে তোর ভালো লাগছে না?”
“হ্যাঁ, তোমরা তো সবাই খুব ভালো। মামিমারা কত যত্ন করেন, তুমিও। অরিদা কলেজ থেকে এসে কত মজার গল্প করল আমার সঙ্গে।”
“তারপর ভুলে গেল, তাই না।”

আমরা দু-জনেই হাসলাম। আমি বললাম, “আমি কিন্তু তোর কথা মনে রাখি। ভুলে যাই না।”
“জানি।” নীরুর চোখে একটা অদৃশ্য পরদা নেমে এল। “আমি জানি তো, তিতিদি। তাই তো….!”
“কী ?”
“কিছু না।” মুখ ফিরিয়ে নিল। মানে ও নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলবে না।
“তোর কোনো বন্ধু হয়নি স্কুলে?”
“না।”
“কথা বলিস না ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে ?”
“বলি তো। বলব না কেন।”
আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, “শুতে যা এবার।”

সেবারে শীতের ছুটিতে ঠিক হল আমরা সবাই দেওঘর বেড়িয়ে আসব, ওখানে আমার মামার বাড়ি, খুব ভালো লাগে ওখানে যেতে আমার। আমরা, মানে মা, জেঠিমা, আমি আর নীরু। বাবা আর জেঠু দুদিন থেকে ফিরে আসবেন, নাকি অনেক কাজ আছে, অত ছুটি পাবেন না। আর দাদাভাই মানে অরিদা বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় যেন বেড়াতে যাবে। দেওঘরে দিম্মা থাকেন আমার ছোটোমামাদের সঙ্গে। ওঁরা খুব ভালোবাসেন আমাদের, জেঠিমার নিজের মা নেই, তাই দিম্মা বলেন, “মন্দিরাও ঝুমুর মতো আমার আর এক মেয়ে।” উনি ভারি স্নেহশীলা, নীরুরও গায়ে হাত বুলিয়ে কত আদর-টাদর করলেন।

ছোটোমামার চার বছরের দুই যমজ ছেলেমেয়ে টুপু আর টিকুকে খুব খানিক চটকে মটকে আদর করলাম, কী মিষ্টি যে হয়েছে দু’টো চমৎকার কাটছে দিনগুলো। দক্ষিণের বড়ো ঘরটায় আমি আর নীরু শুই। একদিন দুপুরে রোদে পিঠ দিয়ে বসে কমলা লেবু খেতে খেতে গল্প করব বলে নীরুকে ডাকতে এসে দেখি, ও জানলার ধারে দাঁড়িয়ে কী দেখছে।

“কী করছিস রে?” “কিছু না….।”

“কী দেখছিস এত?”

“আমি দেখলাম, এই জায়গাটা আসলে অন্যরকম হতে পারে। অন্য কোথাও, যেখানে এসব কিছু অন্যরকম।” আমি ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম। এই ধরনের অদ্ভুত কথা ও বলে মাঝে মাঝে

“তুই এটা তোর সেই নখদর্পণে কী দেখলি?”

“নখদর্পণ নয় ঠিক। বলিনি তোমায় তিতিদি? আমি…. আমার মাথার মধ্যে যেন একটা দরজা খুলে যায় … সামনে একটা আয়না হয়ে যায়, তখন দেখি।”

“আচ্ছা, কী দেখলি বল তো?”

বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, “ওই ওখানে কুয়োটা নেই, একটা পুকুর আছে, তাতে খুব বড়ো বড়ো ফুল ফুটে আছে, বেগুনি রঙের সরু সরু পাপড়ি। পেছনে একটা খুব উঁচু দেওয়ালের মতো, তার গায়ে কী সব ছবি আঁকা… পাশ দিয়ে একটা ভাঙামতো পাথরের রাস্তা, সেটা কীরকম এক সময়ে এক-এক দিকে চলে যাচ্ছে… দূরে কোথায় যেন একটা ঘণ্টা বাজছে, বেজেই যাচ্ছে…।” “আর এই বাড়িটা, এটা আছে ?”

“আছে, কিন্তু এটাও অন্যরকম। যেমন এই ঘরটা… একটা খুব বড়ো গোলমতো জায়গা। কিচ্ছু নেই, শুধু মেঝেতে
নকশা করা, দেওয়ালগুলোতে অনেক খোপ করা, জানলাগুলো চোখের মতো। কেমন ভয় করছিল, তাই যাইনি।” হঠাৎ ঘোর কেটে গিয়ে যেন একটু অপ্রতিভ হল।
আমি বললাম, “যাইনি মানে? তুই কী ওসব জায়গায়,মানে যেগুলো দেখিস… সেখানে সত্যি সত্যি চলে যেতে
পারিস নাকি?”
“হ্যাঁ তো। বলেছি তো তোমায়।”
“যাঃ, তাই কখনও হয়। মানে হয়তো তুই সব কিছু কল্পনা করছিস, ভেবে নিচ্ছিস, হতেও পারে, কিন্তু চলে যাওয়া যায় না রে।”
নীরুর টানা টানা ভ্রূ-দুটো একটু কুঁচকে গেল। বলল, “যায়। আমি গিয়েছি…. কিন্তু ঠাকুমা বলত খুব সাবধান, একবার ওসব জায়গায় হারিয়ে গিয়ে যদি আয়না ভেঙে যায়, তাহলে আর ফেরা হবে না।”
“নীরু…।”

“কিন্তু আমি যাব একদিন… যদি আমার ভালো লাগে খুব জায়গাটা… যদি, যদি মা’কে দেখি সেখানে, তবে… জানো তিতিদি, আমি একবার মা’কে দেখেছিলাম, তোমাদের বাড়িতেই, খুব হাসি-খুশি ছিল, কত গয়না গায়ে, কী সুন্দর দেখাচ্ছিল। বাড়িটা একটু অন্যরকম, তোমরা সব ছিলে, আরও কারা সব ছিল, একটা ছোটো ছেলে, একজন বুড়োমানুষ… আমার যেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আয়নাটা কেমন অন্ধকার হয়ে গেল আর আমি ফিরে এলাম । খুব কান্না পাচ্ছিল আমার…।”
আবার যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিল নীরু। আমার এবার কেমন নার্ভাস লাগছিল, ওর বাহু ধরে নাড়া দিলাম, “নীরু, শোন!”

সামনের রাস্তা দিয়ে হর্ন বাজিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। নীরু এবার চমক ভেঙে আমার দিকে তাকাল।
“চলো নীচে যাই তিতিদি। কমলা লেবু খাবে না? আর নারকেল নাড়ু ?”
“নারকেল নাড়ু কোথায় পাবি? দিম্মা তো বলেছেন পরশু বানাবেন, কাল জটা-দা নারকেল পাড়বে।”
কিন্তু নীচে গিয়ে দেখি পাশের বাড়ির মজুমদারগিন্নী এসেছেন, মস্ত পেতলের কৌটোয় নারকেল নাড়ু নিয়ে। গুছিয়ে বসে বলছেন, “এই তোমাদের জন্য আনলুম ক’টা, আজ বানিয়েছি, কাল নারকেল নামিয়ে কুড়িয়ে রেখেছিলুম।” দিম্মার ডিবে থেকে পান নিতে নিতে সখেদে বললেন, “আজকাল কি আর তেমন ফলন আছে কোনো কিছুর গা!

কী সময় পড়েছে মা। কই গো সবাই এসে নাড়ু নাও । ওমা এই তো তিতি, দিব্যি সোন্দর হয়েছে তো, বিয়ের যুগ্যি যাকে বলে, সম্বন্ধ-টম্বন্ধ দেখছ না কি দিদি? তা ইটি কে গা, চিনতে পারলুম না তো?”
দিম্মা হেসে বললেন, “ও ঝুমুর ননদের মেয়ে, ভারি লক্ষ্মী। আর আজকাল কী আর সম্বন্ধ করে বিয়ে হয় গো ।” আমি আর নীরু টুক করে প্রণাম সেরে ক’টা নাড়ু নিয়ে কেটে পড়লাম। মজুমদারগিন্নী এমনিতে লোক মন্দ নয়, তবে বড্ড কথা বলেন আর খুব কৌতূহল।

ক’দিন পরে আমরা ত্রিকূট পাহাড়ে পিকনিক করতে গেলাম । মুড়ি-পেঁয়াজি- জিলিপি খেয়ে টুপু-টিকুর সঙ্গে একটু ছুটোছুটি করলাম, বল খেললাম খানিক, এদিক-ওদিক ঘুরে দেখলাম । গাছের ছায়ায় শতরঞ্চি বিছানো হয়েছে, আমি আর নীরু এসে ধুপ করে বসে পড়লাম, বাচ্চাদুটো জটাদার হাত ধরে আর একটু ঘুরতে গেল। ওদিকে বিরাট হাঁড়িতে রান্না বসানো হয়েছে, মায়েরা সব ওখানে। ছোটোমামিমা খুন্তি নাড়তে নাড়তে কী যেন গল্পে খুব হাসছেন। হাতের সোনার চুড়ি রোদ্দুরে ঝিকমিক করছে। দিম্মা বাড়ি থেকে আনা একটা টুলে বসে ডিবে থেকে পান মুখে দিলেন।
নীরু গাছে ঠেস দিয়ে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। বললাম, “আমরা এখানে কত এসেছি ছোটো থেকে। কী সুন্দর না জায়গাটা? তোর ভালো লাগছে ?” “হ্যাঁ।”
“নীরু, তোর তো এখানে, আমাদের কাছে থাকতে ভালো লাগছে, তাই না?”
“হ্যাঁ তো।”

“তবে, তবে তুই অন্য কোথাও চলে যেতে মাস কেন রে?”
রান্নার জায়গা থেকে রান্নার সরলাপিসি একটা কাগজের গেলাসে চা, আর বাটিতে করে নোনতা বিস্কুট নিয়ে এসে রাখল। “গিন্নিরা বলতেছে রান্নার খানিক দেরি হবে। আর কিছু খাবে তোমরা ? ”
আমি ‘না’ বলতে চলে গেল ব্যস্ত পায়ে।
“এই যে, চা-বিস্কুট নে নীরু।”
নীরু হাসল, “চা তো খাই না!”
“আজকে খা, কিচ্ছু হবে না। এবার বল তো, চলে যেতে চাস কেন?” আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম, নীরুর মনের ওইসব কী বলব, বিভ্রমের সম্বন্ধে ওকে প্রশ্ন করে ব্যাপারটার অযৌক্তিকতা স্পষ্ট করার চেষ্টা করব।

গাছের ওপর পাতার আড়াল থেকে একটা পাখি মাঝে মাঝে কুব-কুব করে ডাকছে। জটাদাকে টুপু কী যেন বলছে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে। চমৎকার গন্ধ ভেসে আসছে মাংস রান্নার। একটু দূরে একটা সাদা খয়েরি কুকুর বসে, উৎসাহভরে ল্যাজ নাড়ছিল। নীরু ওর দিকে একটা বিস্কুট ছুড়ে দিল।
তারপর বলল, “আসলে এটা যে আমার জায়গা নয়, তাই।”

“দুর সে আবার কী রে! তুই তো আমাদের ফ্যামিলির মানুষ রে। তোকে তো আমরা সবাই ভালোবাসি, বাসি না ?”
“না, তা তো বলছি না। আমার তো জন্মানোর কথাই ছিল না। জন্মাবার পর পর আমি তো মরেই যাচ্ছিলাম। বাবাও চায়নি আমায়, শুধু মা…মা চেয়েছিল খুব। আর তারাঠামা আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু মা’কে বলেছিল, আমি নিয়ম ভেঙে গিট বেঁধে দিলাম, কী হবে জানি না।”
অস্পষ্টভাবে মনে পড়ল ও আগেও এরকম কী বলেছিল। “তার পরেও একবার ওই—গিঁট বেঁধে দিয়েছিলেন না উনি, তুই বলেছিলি।”

“হ্যাঁ, তার পরে তো মা মরে গেল। ঠাকুমা বলেছিল, দু’বার বেঁধেছি, আর পারব না। আর বাঁধলে সব সুতো জড়িয়ে যাবে।”
“কীসের সুতো?” আমি বাটি থেকে আর একটা বিস্কুট কুকুরটাকে ছুড়ে দিলাম।
নীরু একটু সতর্কভাবে বলল, “কী জানি!”
“তারাঠাকুমার জন্যে তোর মন কেমন করে, না রে?
দেখতে যেতে ইচ্ছে করে?”
“ঠাকুমা তো ওখানে নেই আর এখন।” “কী করে জানলি? কোথায় গেছে?”
“অন্য কোথাও।”

“তুই বলছিলি তোর জন্মাবার কথা ছিল না। কে বলেছে রে এসব কথা তোকে!”
নীরু আমার দিকে চেয়ে রইল একটু। তারপর বলল, “আমি জানি। আমি আমার জায়গা খুঁজে নেব। আয়না ভেঙে যাবে, আর ফিরতে হবে না।” কথাগুলো সেই উজ্জ্বল শান্ত দুপুরে কেমন অদ্ভুত শোনাল। যেন একটা ছোটো মেয়ে নয়, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক রহস্যময়ী বলছে অনেক দূর থেকে।
“হ্যাঁ রে নীরু, ছোটোপিসি, মানে তোর মা, আমাদের কথা তোকে বলেছিলেন কখনও ?”
“না, একবার শুধু বলেছিল, আমি যেখানে থাকতাম সেখানে আমার আর যাওয়া হবে না।”

আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় টুপু আর টিকু দৌড়ে এসে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। “তিতিদিদি, নীরুদিদি… এই দ্যাখো জটাদাদা ঝুড়িতে করে আমাদের কত্তো কুল পেড়ে দিয়েছে। ওদিকে কী ভালো একটা কুলগাছ আছে।” ছোটোমামিমা এসে বললেন, “আচ্ছা অনেক হয়েছে…. এবার আয় তো তোরা, হাত-মুখ মুছিয়ে দিই, খেতে হবে না? ইশ কী ধুলো মেখেছিস।… আর তিতি, নীরু তোরাও আয়, খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”

কলকাতায় ফিরে আসার পর আমি চিন্তায় পড়লাম। নীরু এইসব যে বলে, তার অর্থ কী? ওর মনের গভীরে নিশ্চয়ই অনেক জটিলতা। ট্রমাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সম্ভবত। ওর কি সাহায্য প্রয়োজন ? আরও কাউন্সেলিং কিংবা থেরাপি, কিংবা… কিছু না করলে যদি মানসিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এত কম কথা বলে মেয়েটা, কী যে ভাবে বোঝাই যায় না। কিন্তু ও যেগুলো দেখতে পায় সেগুলো তো সত্যিও হয় তাই না? আর সেই—নেই হয়ে যাওয়াটা? কী জানি বাপু। আমার দু-চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে এটা শেয়ার করব? নাঃ সেটা উচিত হবে না… পারিবারিক ব্যাপার….।

আমি অনেক ভেবেচিন্তে মা’কে আড়ালে কিছুটা বললাম, সবটা নয়, অনেকটা বাদ-টাদ দিয়ে, সংক্ষেপে। মা শুনে ভাবনায় পড়লেন, উদবিগ্নভাবে বললেন, “হুমম…. নীরুর সেরকম কোনো কষ্ট আছে বলে তো মনে হয় না, তবে আছে নিশ্চয়ই, বড্ড চুপচাপ তো, বোঝা মুশকিল। ওইটুকু মেয়ে, আহা! মা নেই, বাপও তো যা ছিল একটি… হ্যাঁ রে তিতি ও কান্নাকাটি করে না কি? ”

“না না, সেসব কিছু না। এমনিতে তো স্বাভাবিক থাকে, তবে ওইসব ভাবে। কাউকে বলতে আমায় বারণ করেছে কিন্তু, শুধু আমায় বিশ্বাস করে বলে ওর মনের কথাগুলো।”

“ঠিক আছে, কিছুদিন যাক… এখনই এ নিয়ে কাউকে কিছু বলে কাজ নেই, আবার যদি হিতে বিপরীত হয়! হয়তো এসব আপনা থেকেই কেটে যাবে আস্তে আস্তে।”

তারপরে আর এক ঝামেলা হল। ক’দিন পরে কলেজ থেকে ফিরলাম গায়ে জ্বর, মাথা ব্যথা নিয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে মুভি দেখতে গিয়ে বেশ ভিজেছিলাম। মা, জেঠিমা বকুনি দিলেন খুব। বাবা বললেন, “চুপচাপ শুয়ে থাক গিয়ে… ভাইরাস হতে পারে।” জেঠিমা রাত্রে জোর করে স্যুপ খাওয়ালেন, তারপর জ্বরের ট্যাবলেট খাইয়ে ঘরের ছোটো আলো জ্বেলে বললেন, “খবরদার বলছি এখন বই পড়বি না । চোখ বুজে ঘুমো তো!”

মা বললেন, “তোর কাছে শোব আজ ?”

বিরক্ত হয়ে বললাম, “একদম না। আমি কি ছোটো মেয়ে নাকি। কিছু হলেই এমন করো না তোমরা। কালকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবো দেখ।”

মা’রা ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। দেখি নীরু ওর আর আমার ঘরের মাঝখানের দরজাটায়, আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বললাম, “নীরু! যা শুয়ে পড় তোরও না ছোঁয়াচ লাগে আবার।”

অল্প আলোয় ওর মুখের ভাব বোঝা গেল না। মাথা হেলিয়ে নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলে গেল। কিন্তু রাত্রে আধো-ঘুমে মনে হল ও আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

পরের দিন জ্বর আরও বাড়ল। গায়ে, মাথায়, গলায় ব্যথা । কিছু খেলেই বমি আসছে। পাড়ার ডাক্তারবাবু আমাদের ছোটো থেকে চেনেন। সন্ধেবেলা এসে দেখে বললেন, “মনে হচ্ছে ভাইরাস, চারদিকে হচ্ছে এখন। কী তিতি, কলেজে বন্ধুদের কারও এরকম হয়েছে নাকি?”

আমার জন্য প্রেসক্রিপশন লিখলেন। কিন্তু জ্বর কমল না। মুখ বিস্বাদ, কিচ্ছু খেতে পারছি না। দু-দিন কাটল। ডাক্তারবাবুর মুখ গম্ভীর হল। আর একজন ডাক্তার এসে দেখলেন, ইঞ্জেকশন দিলেন, রক্ত নেওয়া হল। কেমন যেন ঘোর-ঘোর লাগছে, সব কিছু আবছা হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। বাড়ির সকলের মুখ শুকনো। মা আর জেঠিমা পালা করে শিয়রে বসে আইসব্যাগ দিচ্ছেন। আঃ কী ঠান্ডা! মা’র মুখ বিবর্ণ। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে শুনছি মা ফিশফিশ করে জেঠিমাকে বলছেন, “কী হবে দিদিভাই? ডাক্তারবাবু বললেন কাল-পরশুর মধ্যে জ্বর না কমলে হয়তো হসপিটালে রিমুভ করতে হবে, যদি…।” “আঃ চুপ কর ঝুমু, কাঁদছিস কেন। অলুক্ষুণে কথা ভাববি না একদম।” জেঠিমার গলা কেঁপে গেল।

বাবার গলা, “এরকম করলে তোমরা দু-জনেই অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। খাওয়া-ঘুম ছেড়ে দিয়েছ দু-জনে। অসুখ করেছে, সেরে যাবে।” যেন নিজেকেই বোঝাচ্ছেন।

আমি আবার কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি যেন। …ইশ কী রোদ উঠেছে! সেই গেটটা, যেটার কথা নীরু বলেছিল, আমি, সীমাশ্রী, মধুস্মিতা আরও কারা কারা যেন গেটটার সামনে, সুপান্থ বলছে, আয় পেরিয়ে যাই, ওদিকে রোদ নেই, বৃষ্টি পড়ছে…

“তিতি, এই তিতি, একটু জল খাবি? হাঁ কর তো?” কে

যেন বলছে… মা?

ত্রিকূট পাহাড়ে গাছের নীচে বসে আছি, কুলগাছ… চারদিক

কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া, নীরু বলছে তিতিদি খুব সাবধান, এখানে বাঘ আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি….

একবার একটু চোখ খুলে দেখি মা, জেঠিমা। জেঠু আমার মাথায় একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে। পাশে বাবা। আর একটু দূরে দরজার কাছে নীরু দাঁড়িয়ে…. ওইটুকু মেয়েটাকে এখানে আসতে দিচ্ছে কেন? ও হ্যাঁ ও তো আবার ‘নেই” হয়ে থাকতে পারে… কেউ বোধহয় ওকে লক্ষই করছে না… বেশ মজা কিন্তু, ওর কাছ থেকে এটা শেখা যায় না? নীরু আস্তে আস্তে ওর মুখটা ওপর দিকে তুলল, সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। কী… নীরু কী যেন একটা বলেছিল না…. খুব ভয়ের কিছু? চোখ খুলে তাকাতে পারছি না, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মাথা… মাথার ভেতর আয়না… সিলিং থেকে কেউ কী আমায় দেখছে?

এখন অনেক রাত বোধহয়। জানলার বাইরে অন্ধকার। সব নিঃঝুম। একটু আগে কী যেন ওষুধ খাইয়েছে কেউ। আর গরম কী একটা তরল খানিকটা, চামচে করে। বিশ্রী খেতে। মা আমার মাথার কাছে বসে। হালকা আলোয় ছায়ার মতো নীরু এসে দাঁড়িয়েছে।

“ওমা নীরু, তুই জেগে আছিস কেন রে?”

“এমনি, ঘুম আসছে না। মামিমা, আমি তিতিদির কাছে একটু বসি? তুমি গিয়ে একটুখানি বিশ্রাম করো না।” “না না…।”

“তিতিদির জ্বর এখন তো একটু কম, ওষুধ দিলে তুমি, এখন ঘুমোচ্ছে দ্যাখো। তুমি যাও, একটু পরে আবার এসো।” “কিন্তু, তোরও যদি আবার… না না, তুই যা ঘুমো গিয়ে মা।”

“মামিমা, আমার কিচ্ছু হবে না, তুমি যাও।” নীরুর নীচু গলায় এক আশ্চর্য রাজি করিয়ে ফেলার ক্ষমতা, কেমন একটা প্রত্যয়, এরকমভাবে কথা বলতে শুনিনি ওকে কখনও। “তোমরা সবাই তো সবসময় আছ তিতিদির কাছে, এখন আমি একটু থাকি।”

“আমি… আচ্ছা, তাহলে… একটু পরেই আসব…।”

আধো ঘুমে ডুবে গেলাম আবার। ঘোরের মধ্যে মনে হল নীরু খুব নীচু গলায় কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। মা ? না না। অন্য কে একজন, আবছা মতো। সাদা কাপড়, মুখচোখ বোঝা যাচ্ছে না।

“ঠাকুমা, প্লিজ, তিতিদির সুতোর গিটটা বেঁধে দাও আবার, খুলে যাচ্ছে যে… “

উত্তর যে দেয় তার গলাটা কেমন ধরা-ধরা, জড়ানো, যেন অনেক দূর থেকে বলছে। স্বরটা ঢেউয়ের মতো ওঠে পড়ে। “কী করে বুঝলি?”

“আমি দেখলাম যে। ওই ওপরে… সিলিং-এ, সেই তাক-এ। চেয়ে আছে।”

‘…তুই কি আমাকে শাস্তি দিবি না রে মেয়ে! ওভাবে কি বেঁধে দেওয়া যায় । ”

“আমারটা খুলে দাও ঠাকুমা, তাহলেই হবে তো। দুবার তুমিই বেঁধেছিলে, এবার তুমিই খুলে দাও।”

“খুলে দিলে তোর কী হতে পারে জানিস না? ” “জানি।”

অবয়বটা আরও ঝাপসা… এটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন… সত্যি হতে পারে না। টুকরো টুকরো কথা, কেমন যেন অর্থহীন।

“আমি তো এমনিতেই থাকব না, অন্য জায়গায় চলে যাব, তুমিই শিখিয়েছ। এটা তো আমার জায়গাই নয়। আয়না ভেঙে যাবে একদিন।”

অন্য কণ্ঠস্বর কী যেন বলে, আওয়াজটা ওঠে-নামে, কাছে

আবার দূরে, দূরে…

“… তিতিদি বড্ড ভালো যে! ও যে আমার দিদি। ওর গিটটা বেঁধে দাও তারাঠা মা, তোমার পায়ে পড়ি।” “…তুই এমন করে বললে আমি না করি কেমন করে! দেখি, হ্যাঁ, এই তো….!”

ওদের গলাগুলো কেমন ওঠে নামে, একসঙ্গে জড়িয়ে আবার খুলে যায়, বিনুনির মতো, সুতোর মতো, চোখের সামনে দেখি একটা জাল দুলছে সমস্ত আকাশ ছেয়ে, ঘন-নীল আকাশ, মাঝরাতের মতো নীল, আর দুটো চাঁদ… কে যেন আমার কপালে হাত রেখেছে, খুব ঠান্ডা হাতটা।

চোখ খুলি যখন, জানলার বাইরে আলো।

“এই তো জ্বর কমে গেছে অনেকটা।” বাবার গলায় গভীর স্বস্তি।

জেঠিমা কপালে জোড়হাত ঠেকাচ্ছেন, “ঠাকুর, ঠাকুর। উঃ কী যে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল মেয়েটা।”

মা আমার মুখের ওপর ঝুঁকে, চোখে জল। আমি বলি, “মা!” মা কিছু না বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

“আমিও কাল রাতে এমন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ! ঝুমু, তোকে বলেছিলাম আমায় ডেকে দিতে খানিক পরে … তুই কী সারারাত বসে ছিলি?”

“সারারাত? নৃ-না…. কী জানি, তিতিকে একটা ওষুধ খাইয়ে, তারপর… মাঝে উঠে গেলাম যেন…।” মা’র গলায় অনিশ্চয়তা, যেন ঠিক মনে করতে পারছেন না।

“তুমি রাতদিন জেগে ক্লান্ত তাই অমন মনে হচ্ছে।” বাবা বললেন। “এবার গিয়ে মুখেচোখে জল দিয়ে একটু বিশ্রাম করো।”

জেঠিমা বললেন, “আয় ঝুমু। আমি তিতির জন্য হরলিকস বানিয়ে আনি।”

বাবা আমায় বললেন, “আমি চট করে ডাক্তারবাবুকে একটা ফোন করে আসি।”

নীরু এসে আমার কাছে বসল। আমি ক্ষীণকণ্ঠে বললাম, “কাল রাত্তিরে কী হয়েছিল রে? তুই কার সঙ্গে কথা বলছিলি?”

“ওই তো, একবার এসেছিলাম তোমায় দেখতে, মামিমার সঙ্গে কথা বললাম একটু, তোমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বুঝি?”

“মা নয়। তুই অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছিলি, আমি জানি।”

“তুমি জ্বরের ঘোরে ভুল দেখেছ তিতিদি।”

আমি হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ধরি। “নীরু। তুই আমার জন্যে…।”

“ওসব স্বপ্ন। মনে থাকবে না। তুমি একদম ভালো হয়ে যাবে।”

“আর তুই?”

“আমিও… ভালো থাকব। আমার জন্যে ভেব না।” নী….. নৈঋতি হাসছে। স্বচ্ছ নির্মল হাসি। জানলা দিকে সকালের আলো এসে পড়েছে ওর আয়নার মতো কপালে।

End

Read bangla books pdf

Be the first to comment

Leave a Reply