দেবারতি মুখোপাধ্যায় এর শুভঙ্করের ফাঁকি Subhangkarer Faki পড়ুন এখনই।
শুভঙ্করের ফাঁকি Subhangkarer Fhaki পড়ুন
প্রতিম ভয়ে ভয়ে বলল, ‘এই অচ্যুত, আর কদ্দূর যাবি তুই? এবার ফেরত চল। আর দেরি হলে ফেরার বাস পাওয়া মুশকিল হবে।
‘আর একটু গিয়েই ফিরব। কী সুন্দর জায়গাটা রে, আমি এত সবুজ কোনওদিনও দেখিনি!’ অচ্যুত মুগ্ধচোখে চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল, ‘আচ্ছা, তোর সেই পূর্বপুরুষের গল্পটা এবার বল তো। সকালে ট্রেনে আসার সময় তো ভালো করে শোনাই হল না। এখানে এসে তো দেখছি তিনি বেশ বিখ্যাত মানুষ। ‘
প্রতিম বলে, ‘তুই কী করে নাম শুনবি? এখনকার অর্ধেক ছেলেমেয়ে নামই জানে না। অথচ আজ থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও বাংলার প্রতিটা প্রাইমারি স্কুলে শুভঙ্করী পড়ানো হত। মনে করে দ্যাখ, পথের পাঁচালিতে অপু শুভঙ্করী মুখস্থ করত।’
‘হ্যাঁ সেটা মনে আছে। কিন্তু এরকম খুবলে খাবলে বললে বুঝতে পারব না। ভালো করে বল।’ অচ্যুত বলল, ‘তোদের বাড়িতে সকালে যে ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি তো দেখলাম তুই অঙ্ক নিয়ে পড়ছিস শুনেই বললেন, শুভঙ্করের বংশ বলে কথা, অঙ্ক নিয়ে অচ্যুত বিরক্ত হয়, ‘ক্লাস ফাইভের বাচ্চাদের মতো কথা বলিস না তো! বকাবকির কী আছে? কলকাতায় ফিরেই তো আবার কলেজে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। তখন সেই একঘেয়ে জীবন।’
গ্লানির্ভবতি ভারত pdf – দেবারতি মুখোপাধ্যায় Glanibhabati Bharat pdf by Debarati Mukhopadhyay
প্রতিম চুপ করে গেল। অচ্যুত ঠিকই বলেছে। কলকাতায় ফিরলেই সেই বৈচিত্র্যহীন রুটিনে ঢুকে পড়তে হবে।
মাঝে মাঝে প্রতিমের ভাবলে অবাক লাগে যে, অচ্যুতের মতো মেধাবী ঝাঁ চকচকে ছেলের সঙ্গে ওর এতটা বন্ধুত্ব কী করে হল! ওদের দুজনের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিল এতটাই বেশি যে এটা ওদের বন্ধুমহলের কাছেও বিস্ময়ের ব্যাপার।
কিন্তু তবু ওদের বন্ধুত্ব হয়েছে। আর এই তিন বছরে সেটা এতটাই গাঢ় হয়েছে যে এখন ওরা হরিহর আত্মা বললেও অত্যুক্তি হয় না। অচ্যুত উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান এবং বরাবর অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, পড়ে কলকাতার সেরা কলেজে। আর সেখানে প্রতিম খুবই সাধারণ পরিবারের ছেলে। তার ওপর নেহাতই মধ্যমেধার ছাত্র। উচ্চমাধ্যমিকে ওর নম্বরও ছিল গড়পড়তা, তবু একরকম জোর করেই ও অঙ্ক অনার্স পড়বে ঠিক করেছিল।
ভালো নম্বর পেয়ে ঝকঝকে কেরিয়ার গড়বে সেই আশায় নয়, অঙ্ককে আরো গভীরভাবে জানতে।
প্রতিমের বাড়ি এই বাঁকুড়া জেলারই কুন্ডপুষ্করিণী বলে একটা গ্রামে। চাইলে বাঁকুড়ার কোনও কলেজে ও পড়তে পারত। কিন্তু ও তখন ধনুকভাঙা পণ করেছিল যে কলকাতায় থেকেই পড়াবে। কলকাতা শহরে স্বাভাবিকভাবেই কোনও ভালো কলেজে ওর জায়গা হয়নি, ভর্তি হতে হয়েছিল শহরতলির এক সাধারণ কলেজে। মেস ভাড়া নিয়েছিল শিয়ালদা ষ্টেশনের কাছে।
আর তারপরেই এক নামজাদা প্রোফেসরের বাড়িতে অনার্সের টিউশন পড়তে গিয়ে ওর আলাপ হয়েছিল অচ্যুতের সঙ্গে। একটা বিষয়ে ওদের খুব মিল। সেটা হল, অঙ্কের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। অচ্যুতের নম্বর দুরন্ত। সে তো অঙ্কে দারুণ হবেই। কিন্তু নম্বর খুব বেশি না পেলেও অঙ্কের প্রতি প্রতিমের অনুরাগ ছিল চিরকালীন। সিলেবাসের বাইরের জটিল প্রবলেম সলভ করতে ও দারুণ ভালবাসে।
নীলকান্তপুরের হত্যাকান্ড pdf – মনোজ সেন Nilkantapurer Hatykanda pdf by Monaj Sen
আর এখানেই দুই বন্ধুর মধ্যে মিল। পাঠ্যক্রমের বাইরেও দুজনে দেশবিদেশের নানা অঙ্কের সমস্যা নিয়ে মেতে থাকে।
ওদের বন্ধুত্বও দিনদিন গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠেছে। কখনো ওরা মেতে থাকে মিলেনিয়াম প্রাইজ প্রবলেম নিয়ে। গোটা পৃথিবীতে সাতটা এমন অঙ্ক রয়েছে, যেগুলো আজ পর্যন্ত কেউ সমাধান করতে পারেনি। পারলেই তার জন্য রয়েছে অবিশ্বাস্য অঙ্কের পুরস্কার। আবার কখনো দিন রাত কাবার করেছে মিলেনিয়াম বাক প্রবলেম নামের বারোটা অঙ্ক নিয়ে। এই বারোটা অঙ্কের সমাধানও এখনো পর্যন্ত অধরা। তাই এবারে কয়েকদিনের ছুটিতে প্রতিম যখন বাড়ি আসছিল, অচ্যুতও ওর সঙ্গে চলে এসেছে। বন্ধুর বাড়ি ঘোরাও হবে, একসঙ্গে অঙ্ক করাও হবে।
প্রতিমের বাড়ি থেকে মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর ঘণ্টাদেড়েকের রাস্তা। আজ সকালে দুই বন্ধু ঘুরতে এসেছিল এদিকে। প্রতিম গাইডের ভূমিকায়। এখানকার টেরাকোটার মন্দিরগুলো সম্পর্কে বিশদে বোঝাচ্ছিল অচ্যুতকে।
তারপরই অচ্যুতের যে কী খেয়াল চাপল, জোর করে চলে এল বিষ্ণুপুর থেকে আধঘণ্টা দূরের এই জঙ্গলে। এসেও ওর শাস্তি হল না, জঙ্গলের এতটা ভেতরে চলে এল।
যতদূর পর্যন্ত পর্যটকরা আসে, সেই সীমানা ওরা অনেকক্ষণ আগেই পেরিয়ে এসেছে। বন্য প্রাণীদের জল খেতে আসা দেখার ওয়াচ টাওয়ার, ফরেস্ট ডিভিশনের অফিস, রিসর্ট কিংবা বহু বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির তৈরি পরিত্যক্ত এলাকা….সব ছাড়িয়ে ওরা ঢুকে এসেছে গভীর অরণ্যে।
এখন ওদের আশপাশে আদিম প্রকৃতি ছাড়া আর কিছুই নেই। এই পড়ন্ত বিকেলে জঙ্গলের এতটা গভীরে এইভাবে দুজন হেঁটে চলাটা যে শুধু ভয়ের তাই নয়, অত্যন্ত বিপজ্জনক।
মাথার ওপর আকাশ দেখা যাচ্ছে না। অতিকায় গাছগুলো আকাশ ঢেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনন্তকাল ধরে। অনেক উঁচুতে সেই গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে সূর্যের নরম আলো। আশপাশে এক জাতীয় পোকার গুঞ্জন ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
‘কিরে বল না।’ অচ্যুত আবার তাড়া দিল, ‘হু ওয়াজ মিঃ শুভঙ্কর?’ ‘শুভঙ্কর রায় ছিলেন আমার পূর্বপুরুষ। প্রতিম বলল, ‘এই যে বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলো দেখে এলি, সেগুলো সব বানানো হয়েছিল মল্লরাজাদের আমলে। এই অঞ্চলে মল্ল রাজারা প্রায় হাজার বছর শাসন করেছিলেন। । তো, পঞ্চান্নতম মল্লরাজ গোপাল সিংহদেবের সময় শুভঙ্কর রায় ছিলেন তাঁর ভূমিরাজস্ব সচিব।
একটা অল্প ফাঁকা জায়গা দেখে অচ্যুত এবার একটা গাছের তলায় বসে পড়ল। পকেট থেকে দুটো চ্যুইং গাম বের করে একটা প্রতিমের দিকে ছুঁড়ে দিল। অন্যটা মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, ‘তো ওঁর সঙ্গে অঙ্কের রিলেশনটা কী? উনি কি পার্ট টাইমে অঙ্কের টিউশনি করতেন?’
‘ইয়ার্কি মারিস না!’ প্রতিম ওর পাশে হাত পা ছড়িয়ে এবার বসে পড়ল, ‘শুভঙ্কর রায় ছিলেন সেইসময়কার নামকরা গণিতজ্ঞ । জন্মেছিলেন ১৬৭২ সালে। জন্মের পরই তাঁর বাবা অনন্ত রায় মারা যান। তাঁর এক ধনী আত্মীয় তাঁকে তখনকার বিখ্যাত পণ্ডিত ভৃগুরাম দাশের কাছে পড়তে পাঠান। সেখানে শুভঙ্কর আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্করাচার্য, লীলাবতীর লেখা প্রাচীন সমস্ত গণিতশাস্ত্র পড়ে মহাপণ্ডিত হন। পরে নিজের যোগ্যতায় রাজদরবারের সচিব হন। তখন দিল্লির মসনদে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। মল্লরাজারা শাসক হলেও তরফদার, জায়গিরদার, কটকিনাদার এদেরই সব গ্রামেগঞ্জে ছিল বাড়বাড়ন্ত।’
‘তরফদার, জায়গিরদার বুঝলাম, কোঁটকি না কী, সেটা আবার কী?’ অচ্যুত বাধা দিয়ে বলল।
‘তরফের মালিক ছিল তরফদার। আর তিন-চারটে তরফ যার থাকত, তাকে বলা হত কটকিনাদার। এরা সবাই জমিজায়গা নিয়ে অনেক অত্যাচার চালাত।’ প্রতিম বলল, ‘এদিকে সাধারণ মানুষ তো তখন শুধু জানত কৃষিকাজ। তারা না বুঝত জমিজমার হিসেব, না বুঝত টাকাকড়ি নিয়ে অঙ্কের জটিল মারপ্যাঁচ। তাই তারা সবদিক থেকেই ঠকত। তাঁদের বাঁচাতে শুভঙ্কর রায় তখন জটিল সমস্ত হিসেব সহজ ছড়ার আকারে বানিয়েছিলেন। তখন তো আর ক্যালকুলেটর ছিল না। মানুষকে বাজারহাটে জটিল হিসেব মুখে মুখে করতে হত। তাকে বলত মানসাঙ্ক । এই মানসাঙ্কের সঙ্গে জিনিসের দাম, জমির হিসেব, ভূমিরাজস্বের সব কঠিন অঙ্ক মিলিয়ে শুভঙ্কর রায় এমনভাবে ছড়া লিখেছিলেন, যে অশিক্ষিত মানুষও সেই ছড়া দিয়ে নির্ভুলভাবে হিসেব করে ফেলতে পারত। এগুলোকে বলত শুভঙ্করীর আর্যা।
তারপর থেকে প্রায় আড়াইশো বছর বাংলার ঘরে বাইরে শুভঙ্করীর আর্যা লোকে ব্যবহার করেছে। বুঝলি?”
অচ্যুত মন দিয়ে শুনছিল। বলে উঠল, ‘কী রকম। ‘
তখন তো অন্যরকম সব হিসেব ছিল। মণ, ছটাক, পোয়া এইসব। এদের মধ্যে নানারকম হিসেব কষার ছড়া। যেমন ধর।’ প্রতিম বলল, ‘ছটাকের দাম যদি জানিবারে চাও।
আধ পোয়ার দামের অর্ধেক মনে ধরি লাও।’
‘ইন্টারেস্টিং!’ অচ্যুত গোল গোল চোখে বলল, ‘এ তো আমাদের ফর্মুলার মতো রে।’
প্রতিম মাথা নেড়ে বলল, ‘একদমই। আরেকটা যেমন বাজারহাটে হিসেবের জন্য লিখেছিলেন,
মণ প্রতি যত টঙ্কা হইবেক দর।
আড়াই সেরের দাম তত আনা ধর।।
আনা প্রতি পাঁচ কড়া সিকি প্রতি পাই ।
গণ্ডা প্রতি এক কাক মনে রাখ ভাই।।
কড়া প্রতি ধরিতে হইবেক পঞ্চতিল।
শুভঙ্কর রায় কহে এই মত মিল ।।
অচ্যুত বলল, ‘ওয়ান্ডারফুল ! অঙ্ক, আবার কবিতাও। ‘
প্রতিম বলল, ‘ঐকিক নিয়মও উনিই মানুষের মধ্যে সহজসরল করে ছড়ায় শেখান জানিস তো? কেশব নাগের যে ওই বিখ্যাত তেলমাখানো বাঁশে বাঁদর চড়ার অঙ্কটা আছে না? ওটার মূল ভাবনাটাও কিন্তু শুভঙ্করীর আর্যা থেকেই নেওয়া।’
অচ্যুত বলল, ‘তাই নাকি! আশ্চর্য! বল তো শুনি?’
‘দাঁড়া। ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছিলাম, অতটা মনে নেই।’ প্রতিম থেমে থেমে বলতে লাগল,
“ত্রিশ হাত উচ্চ বৃক্ষ ছিল এক স্থানে
চূড়ায় উঠিবে এক কীট করে মনে।
দিবাভাগে দশ হাত উঠিতে লাগিল
নিশাযোগে অষ্টহাত নিচেতে নামিল
না পায় যাবত চূড়া করে সে অটন
কতদিনে উঠেছিল করো নিরুপণ ।
‘দারুণ!’ অচ্যুত বলল, ‘সত্যেন দত্তের মতো ছন্দ মেলাতেন ভদ্রলোক।’
প্রতিম এবার হাসল, ‘উনি যে শুধুই ছন্দ মিলিয়ে আর্যা লিখে গিয়েছেন তা কিন্তু নয়। শুভঙ্কর রায় উচ্চতর গণিতের ওপর অনেক গবেষণাও করেছিলেন।’
‘তাই?’
প্রতিম মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। তবে তা আর জানা যায় না। শুভঙ্কর রায় ছিলেন খুব অন্তর্মুখী। তাঁর সেই গবেষণাপত্র রাখা ছিল বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির মহাফেজখানায়। রাজা গোপাল সিংহদেব সেটাকে ছাপাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু তার আগেই মারাঠা দস্যু ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বর্গীরা বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে। সেটা ১৭৪৪ সাল। সেই সময়ে শুভঙ্কর রায় সহ অনেক পারিষদের ওপরে বর্গীরা অতর্কিতে হামলা চালায়। শুভঙ্কর রায় প্রাণভয়ে নাকি আশ্রয় নেন রাজধানীসংলগ্ন এক জঙ্গলে। সেখানেই সম্ভবত ওঁকে হত্যা করা হয়।’
‘ইস্! এমন লোকের কী পরিণাম!’ অচ্যুত মুখ দিয়ে আফসোসের শব্দ করল, ‘আর্কিমিডিসের মতো।’
প্রতিম বলল, ‘তার কিছুবছর পর বিষ্ণুপুরের রাজা হন। চৈতন্যসিংহদেব। তাঁর খুড়তুতো ভাই দামোদর সিংহদেব তাঁর বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদের নবাব মীরজাফরের সঙ্গে যড়যন্ত্র করেন। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদালতে মামলায় হেরে গেলে সেই রাগে দামোদর সিংহদেব ওই মহাফেজখানায় আগুন লাগিয়ে দেন। অন্য অনেককিছুর সঙ্গে গবেষণাপত্রটাও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।’
‘মাই গুডনেস! কীভাবে মানুষ হিংসার বশে বিজ্ঞানের গতি পিছিয়ে দেয় ভাব!’
‘হ্যাঁ। তবে এত ভালো কাজের অনেক অপভ্রংশও ঘটেছিল পরবর্তীকালে। শুভঙ্করী আর্যাকে বিকৃত করে ভেতরে গোঁজামিল ঢুকিয়ে অনেক ভুলভাল ছড়াও বের করা হয়। তাই বাংলায় ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ নামে একটা প্রবাদও আছে।’ প্রতিম বলল।
‘হুম।’ অচ্যুত মাথা দুলিয়ে বলল, ‘তবে এখন বুঝতে পারছি, তোর অঙ্কের প্রতি এত আগ্রহ কেন? যার জিনে এইরকম জিনিয়াস একজন ম্যাথমেটিশিয়ান রয়েছেন, সে তো অঙ্কপাগল হবেই!’
প্রতিম হেসে ফেলল, ‘ধুর! কার সঙ্গে কার তুলনা। তুই হাসালি।’ পরক্ষণেই হঠাৎই ও উপলব্ধি করল, ঝুপ করে যেন রাত নেমে এল জঙ্গলে। হঠাৎ করেই যেন সামান্য দূরত্বে বসে থাকা অচ্যুত অস্পষ্ট হয়ে উঠল ওর কাছে।
ও বলে উঠল, ‘অ্যাই অচ্যুত ! চারপাশ তো পুরো অন্ধকার হয়ে গেল রে!’
সত্যিই তাই। আশপাশে সামান্য হলেও যে আলো ছিল, তা কখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। জমাট অন্ধকার এখন চারপাশে। পোকার ডাকের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো কিছু অজানা প্রাণীর শব্দধ্বনি। তাপমাত্রাও নেমে গিয়েছে অনেকটা। শীত শীত করতে শুরু করেছে দুজনেরই।
অচ্যুত এবার সাদামুখে প্রতিমের দিকে তাকায়। মুহূর্তে মোবাইলের আলো জ্বালায়, ‘কী হবে প্রতিম?
প্রতিম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অচ্যুতের কথায় রেগে ও চিৎকার করে উঠল, ‘তোকে কখন থেকে বলছিলাম আমি ফেরার জন্য ?’ দুজনেই এই ঠান্ডাতেও দরদর করে ঘামছে।
“অ্যাই!” অচ্যুত ভয়ে প্রতিমের হাতটা আঁকড়ে ধরল, ‘এই জঙ্গলে বাঘ আছে রে?’
‘না। বাঘ নেই।’ প্রতিম ফিসফিস করে বলল, ‘কিন্তু হাতি আছে, বুনো শুয়োর আছে।’
অচ্যুতের গলা কাঁপতে থাকে, ‘কী হবে রে তাহলে?’
প্রতিম এমনিতে নরমসরম। কিন্তু বিপদে পড়লে ও মাথা ঠান্ডা রাখতে জানে। বলল, ‘ছ’টা বাজে। ফরেস্ট রেঞ্জারের অফিস অবধি গেলে কাউকে পেয়ে যাব। তারপর তেমন হলে ওখানেই রাতটা কাটিয়ে দিতে পারব। চল, আগে রেঞ্জারের অফিস অবধি পৌঁছই।’
চারপাশের মন মাতাল করা মহুয়ার গন্ধের মধ্যে ওরা দুজন দুরুদুরু বক্ষে হাঁটছে। অচ্যুত নিজের ফোনের আলো জ্বেলে প্রতিমের হাত শক্ত করে ধরে পা ফেলছিল। আচমকা কোনও অজানা শব্দে বুকের ভেতরটা ভয়ে হিম হয়ে আসছিল। পরক্ষণেই সে নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিল, আর তো একটুখানি।
কিন্তু ঘড়ির কাঁটা সাত পেরিয়ে আর্ট, আর্ট পেরিয়ে নয়ের দিকে চলতে লাগল, কিন্তু রেঞ্জার অফিসের আলো ওরা দেখতে পেল না। বিড়বিড় করল প্রতিম, ‘মনে হচ্ছে আমরা পথ হারিয়েছি।’ ‘কী বলছিস!’ অচ্যুতের গলাটা এবার কেঁপে গেল।
“ঠিকই বলছি।’ প্রতিম চাপা গলায় বলল, ‘তোর পাগলামির জন্যেই এই অবস্থা হল। কী করব জানি না?”
অচ্যুতের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সে জন্মাবধি শহরে মানুষ। সবুজ বনের সৌন্দর্য দিনের আলোয় দেখে সে মুগ্ধ হয়েছিল, কিন্তু সেই সৌন্দর্যই যে রাতের নিকষকালো অন্ধকারে এমন ভয়াল রূপ নেবে তা ও কল্পনাও করতে পারেনি।
পারিপার্শ্বিক সব কিছু ভুলে ওর কান্না পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ও মরে যাচ্ছে। আর বাবা-মা’কে দেখতে পাবে না।
এইসময় প্রতিম বলল, ‘চুপ! একদম চুপ কর!
প্রতিম আবার বলল, ‘কেউ একটা আসছে। শুনতে পাচ্ছিস পায়ের শব্দ?”
অচ্যুতের বুকের ভেতর কেউ যেন নির্দয়ভাবে হাতুড়ি পিটছিল। তবু তারই মধ্যে ও কান খাড়া করল। না। কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না।
আশ্চর্য একটা কাণ্ড হল। প্রতিম যন্ত্রমানবের মতো হঠাৎ সটান পেছনদিকে ফিরল। হাঁটতে শুরু করল।
‘কী হল? ওটা তো উল্টো দিক! ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?’ অচ্যুত আন্দাজে চেপে ধরল প্রতিমের হাত।
কিন্তু প্রতিম পরোয়া করল না, নিশি ডাকা মানুষের মতো চলতে শুরু করল পেছনদিকে। সঙ্গে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে যাচ্ছিল অচ্যুতকে।
অন্ধকারে গাছের ডালে অচ্যুতের পা কেটে দরদর করে রক্ত পড়ছিল। ও চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘কী হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?’
কিন্তু প্রতিমের কোনও হুঁশ নেই। রুদ্ধশ্বাসে সে ছুটে চলেছিল অশরীরী আলেয়ার পেছনে। অচ্যুতের বারংবার চিৎকারে ও শুধু মোহাবিষ্টের মতো বলল, ‘শুনতে পাচ্ছিস না? ওই যে, ওই যে এবার ডানদিকে বেঁকতে বলছে? এই যে! এই যে! এবার বাঁ দিকে ঘুরেই চার পা হেঁটে চলতে হবে সোজা!’
‘কে বলছে? কোথায় বলছে?’ অচ্যুত ফের চিৎকার করে উঠল। ছাড়িয়ে নিতে চাইল প্রতিমের বজ্রমুঠি। কিন্তু পারল না।
প্রতিমের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রতিম জ্বরো রুগির মতো কাঁপতে কাঁপতে ছুটছিল। আর ঘুম ঘুম গলায় বিড়বিড় করে বকে চলেছিল, “ওই যে! শুনতে পাচ্ছিস না?
‘ডাইনে হাঁটো আট পা পূবে রেখে পলাশ।
কম পথ কম শ্বাস, নাই কোনও অবকাশ ।।
এবার সোজা তেত্রিশ পা উত্তরে যাও ধেয়ে।
তেকোনা বনে আজ আলো গিয়াছে মিলায়ে ।।
শুভঙ্কর রায় কহে শুন জনগণ।
ইহাকে বুঝিলে হয় বুদ্ধি বিচক্ষণ।।
অচ্যুত আর পারল না। ছড়ার শেষ বাক্যটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র একটা হিমস্রোত নেমে গেল ওর মেরুদণ্ড বেয়ে। প্রচণ্ড ভয়ে আতঙ্কে জ্ঞান হারাতে হারাতে ও উপলব্ধি করল, সামনে যেন মহাপ্রলয় শুরু হয়েছে!
তখন ঘরময় খটখটে আলো। যে বিছানায় ওকে শুইয়ে রাখা হয়েছে, তার এককোণে এসে পড়ছে নরম রোদ।
অচ্যুত চোখ মেলে তাকাল। উঠে বসতে যেতেই অনুভব করল, গায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। মাথাও ভার হয়ে রয়েছে ভীষণ।
চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিল একটা খাকি উর্দির লোক। ওকে উঠতে দেখে বাজখাঁই গলায় বলে উঠল, ‘ওই যে, আরেক নবাবপুত্তুরের ঘুম ভেঙেছে। সুখলাল, যা স্যারকে খবর দে।’
তারপর লোকটা অচ্যুতকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, “তা মাঝরাতে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরছিলে কি গুপ্তধন খুঁজতে? কপালে ছিল তাই বেঁচে গেলে। কাল সারারাত হাতির দল দাপাদাপি করেছে জঙ্গলে। সামনে পড়লে এতক্ষণে মর্গের ঘরে শুয়ে থাকতে।’ অচ্যুত কিছুই বুঝতে পারল না।
লোকটা গজগজ করতে করতে উঠে বাইরে যেতেই পাশের বিছানায় ও প্রতিমকে দেখতে পেল। প্রতিমেরও মাথায় ব্যান্ডেজ, কপালে কালশিটে। চুপচাপ তাকিয়ে রয়েছে দেওয়ালের দিকে।
ওকে দেখে প্রতিম মৃদু হাসল। তারপর ক্ষীণগলায় বলল, ‘আমরা যেখানটায় ঘুরে মরছিলাম, কাল রাতে হাতিদের একটা দল সেই জায়গাটা আজ পুরো মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে, জানিস। শুভঙ্কর রায় আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। গোটা সময়টা শুধু কানের পাশে অদ্ভুত এক গলায় ছড়া শুনে গিয়েছি। শুনতে শুনতে কেমন ঘোরে চলে গিয়েছিলাম। ছড়া শুনছিলাম, আর সেইমত চলছিলাম। কীভাবে যে ফরেস্ট রেঞ্জারের এই অফিস পর্যন্ত এসে পৌঁছেছি, জানি না।’
অচ্যুত উত্তর দিল না। ওর মাথা প্রতিমের চেয়ে বরাবরই পরিষ্কার। কাল জ্ঞান হারানোর আগেই যে ছড়াটা প্রতিমের মুখে ও শুনতে পেয়েছিল, তাতে ও তখনই বুঝে গিয়েছিল, যুক্তির চোখে যত অলীকই হোক না কেন, এক অজ্ঞাত শক্তিতে মৃত্যুর সাড়ে তিনশো বছর পর নিজের বংশধরকে সমূহ বিপদ থেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। মল্লভূমির কিংবদন্তী গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর রায়।
তাঁকে সম্ভবত এই জঙ্গলেই হত্যা করেছিল বর্গীরা। হাতিরা যে একটু পরেই গোটা অঞ্চলটা তছনছ করবে তা জেনেই বোধ হয় শুভঙ্কর রায়ের সূক্ষ্মদেহ নিজের রক্তের টানে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছিল। ওই গভীর অরণ্যের মাঝে। আর রক্তের টানেই একমাত্র প্রতিমই শুনতে পাচ্ছিল সেই অপার্থিব ছড়ার দিকনির্দেশ!
অচ্যুত কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেলল, ‘কাল তুই সবশেষে যে ছড়াটা বলেছিলি, মনে আছে তোর?’
প্রতিম দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল, ‘আমার আর কিছুই মনে নেই, কী বলেছি, কী করেছি।’
অচ্যুত মনে মনে হিসেব করছিল, বলল, ‘কম পথ কম শ্বাস, নাই কোনও অবকাশ! মানে সবচেয়ে কম দূরত্ব সবচেয়ে কম সময়ে অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছনো। অঙ্কের ভাষায় মিনিমাইজেশন প্রবলেম!’
প্রতিম ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
অচ্যুত বলল, ‘বুঝতে পারছিস না? পরের লাইনটা ছিল, তেকোনা বনে আজ আলো গিয়াছে মিলায়ে। মানে জঙ্গলের আকার তিনকোণা।
প্রতিমকে এখনো হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অচ্যুত বলল, ‘আমেরিকান গণিতজ্ঞ রিচার্ড বেলম্যানের সেই প্রবলেমটা মনে পড়ছে তোর? লস্ট ইন অ্যা ফরেস্ট প্রবলেম? কেউ একটা জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেলে সেই জঙ্গলের আকার ও আয়তন জানা থাকলে সবচেয়ে কম সময়ে মিনিমাম ডিসট্যান্স পার করে সে কীভাবে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে? ১৯৫৫ সালে রিচার্ড বেলম্যান এই প্রশ্নটা তুলেছিলেন। ইউক্লিড জ্যামিতির প্রবলেম।’
প্রতিম বিস্ফারিত চোখে তাকাল, ‘কী বলছিস! এটা তো বিশ্বের যে বারোখানা মিলিয়ন বাক প্রবলেম এখনো সমাধান করা যায়নি, তার একটা!’
‘আরো কী কী মণিমুক্তো ছিল তা তো আর জানার উপায় নেই প্রতিম!’ ‘ঈস ! ছড়াটা শুনতে পেলাম, কিন্তু সমাধান বের করার সেই পদ্ধতিটা জানলাম না রে অচ্যুত!
‘দরকার নেই।’ অচ্যুত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর অনাবিল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল, ‘সেটা বের করবি তুই। শুভঙ্কর রায়ের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তুই-ই বেলম্যানের সেই লস্ট ইন দ্য ফরেস্ট প্রবলেমটা সলভ করবি। হয়ত শুভঙ্কর রায় নিজেও তাই চান! আমাদের প্রাণে বাঁচালেন, কিন্তু সমাধানে ফাঁকি দিলেন। যাতে তোর নাম পৌঁছে যায় বিশ্বের কাছে।
প্রতিম ছলছলে চোখে হাত বাড়াল বন্ধুর দিকে। সেই মুহূর্তে ওর মনে হল কেউ যেন ফিসফিসিয়ে ওর কানে কানে বলে উঠল, ‘পাশে আছি। এগিয়ে যাও।’
More bangla books pdf
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.