গ্রেভ ইয়ার্ড শিফ্ট – সৌম্য সাহা Grave Yard Shift pdf by Soumya Saha

গ্রেভ ইয়ার্ড শিফ্ট - সৌম্য সাহা Grave Yard Shift pdf by Soumya Saha
গ্রেভ ইয়ার্ড শিফ্ট - সৌম্য সাহা Grave Yard Shift pdf by Soumya Saha

সৌম্য সাহার গ্রেভ ইয়ার্ড শিফ্ট সম্পূর্ণ হরর গল্পটি পড়ুন এখান থেকে। Grave Yard Shift pdf গ্রেভ ইয়ার্ড শিফ্ট গল্পটি বিভা ভূত ভুতুম উৎসব সংখ্যা ১৪৩০ (২০২৩) পিডিএফ Biva Bhut Bhutum Utsav Sankhya 1430 pdf থেকে নেওয়া হয়েছে।

গ্রেভ ইয়ার্ড শিফ্ট - সৌম্য সাহা Grave Yard Shift pdf by Soumya Saha
গ্রেভ ইয়ার্ড শিফ্ট – সৌম্য সাহা Grave Yard Shift pdf by Soumya Saha

Grave Yard Shift pdf গ্রেভ ইয়ার্ড শিফ্ট গল্পটি পড়ুনঃ

(জোনাথন ডব্লিউ ব্লেক-এর প্রতি আর্থার উইলিস-এর চিঠিপত্র)

প্রিয় জোনাথন,
প্রভু জিশুর কৃপায় আশা করি ভালোই আছ। জুডি আর এডনও আশা করি, ভালো আছে। আমি ঈশ্বরের কাছে সর্বক্ষণ তোমাদের মঙ্গল চেয়ে প্রার্থনা করি। জানোই তো, আমার আপন বলতে একমাত্র তুমিই আছ। সেই ছোটোবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আর গত বছর আমার একমাত্র বোন জুলিয়েটও আমায় ছেড়ে চলে গেল। সেই সময় তোমরা আমার পাশে না থাকলে আমি যে কোথায় ভেসে যেতাম, ঈশ্বর জানেন। কিন্তু ভাগ্যের ফের দ্যাখো, জুলিয়েট মারা যাওয়ার কয়েক মাস পরেই চাকরিসূত্রে তোমরা চলে গেলে। যা-ই হোক, তুমি শুনে খুশি হবে, আমি একটা কাজ জুটিয়েছি। আহামরি কিছু নয়, একটা রোডসাইড রেস্তোরাঁর পার্ট টাইম কাজ, ওই খদ্দের এলে তাদের কফি সার্ভ করা বা টুকটাক স্ন্যাক্স জাতীয় কিছু গরম করে দেওয়া।

এই কাজটা পাওয়ার পর আমার দুটো সুবিধা হয়েছে। প্রথমত, মাইনে যা দেয়, তাতে একা মানুষের পেট দিব্যি চলে যায়, ‘বস’ লোকটাও ভালো। আর দ্বিতীয়ত, আমার ইনসমনিয়াকে দিব্যি বুড়ো আঙুল দেখাতে পারছি।
জানোই তো, রাতে আমার খুব ভালো ঘুম কোনোদিনই হত না। এইজন্য কম কথা শুনতে হয়েছে আমায়। রাতে বিছানায় শুয়ে খালি এপাশ-ওপাশ করতাম, অনেক সময় থাকতে না পেরে ঘরময় পায়চারি করতাম… তাতে কমবেশি কিছু-না-কিছু শব্দ হতই, আর পাশের ঘর থেকে জুলিয়েট উঠে আসত, বেচারির ঘুম এইভাবে যে কতবার ভেঙেছে, তার ঠিক নেই।

আহা, জুলিয়েট। ও মারা যাওয়ার পর ঘুম যেন আমার চোখ থেকে একেবারেই বিদায় নিয়েছে। খাওয়াদাওয়ার পর সিগারেটে টান দিতে দিতে খানিকক্ষণ টিভি দেখে, কিংবা কম দামি হুইস্কির আনুকূল্যে গলা ভিজিয়ে তারপর ঘুমোতে যেতাম। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকার পর একটু তন্দ্ৰামতোও আসত কিন্তু তার পরেই হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যেত। ব্যাস, তারপর সারারাত আর ঘুম আসে না।

বাংলার কিংবদন্তি pdf – শীলা বসাক Banglar Kingbodonti pdf – Shila Bosak

জোনাথন, একটা গোটা রাত! একটা গোটা রাত ঘুমহীন অবস্থায় কাটানো যে কী অসহ্য, তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। কোনো কাজ নেই করার মতো, টিভিতেও বিশেষ কিছু হয় না আর রাতের বেলা পরিচিত কেউই জেগে থাকে না যে তার সঙ্গে গল্প করে কাটানো যাবে।
আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি পাশের লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই নিয়ে এসে পড়ার। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি, তুমি তো জানোই, পড়াশোনার থেকে আমি চিরকাল শতহস্ত দূরেই ছিলাম। অতএব, নতুন করে যে কিছু পড়াশোনা করব বা কিছু লেখালিখি করব, তারও প্রবৃত্তি হয় না।

কিন্তু আমার যাবতীয় সমস্যার সমাধান ঘটল এক মাস আগে। খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল আমার—একটা রেস্তোরাঁয় কর্মচারী নেওয়া হবে কিন্তু তাকে কাজ করতে হবে ‘গ্রেভইয়ার্ড শিফ্ট’-এ।
গ্রেভইয়ার্ড শিট মানে বোঝো? রাত বারোটা থেকে সকাল আটটা অব্দি কাজ করার যে সময়সীমা, তাকে কর্মক্ষেত্রে বলা হয় ‘গ্রেভইয়ার্ড শিফ্ট’। আমার জন্য একেবারে আদর্শ কাজ।

সাইকেল আছে, অসুবিধা নেই, রাতের খাওয়া সেরে দিব্যি চলে যাওয়া যাবে। সারারাত কাজ করে সকালের দিকে ফেরা, তারপর সারাদিন অবসর। আমি ওইদিনই রেস্তোরীর মালিকের সঙ্গে দেখা করে কাজের কথা পাকা করে নিয়েছিলাম। সেই থেকে টানা এক মাস কাজ করেছি। আমিও খুশি, আমার বসও খুব খুশি।

বিশ্বাস করো, রাত জাগার সামান্য ক্লান্তিটুকুও আমার থাকে না আর আশ্চর্যের ব্যাপার, আজকাল দুপুরে চমৎকার একটা ঘুম দিচ্ছি। কাজ থেকে বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমোতে যাই আর সেই উঠি বিকেলে, তারপর শহরতলির আনাচকানাচে ঘুরে সন্ধ্যার পরে পরেই বাড়ি ফিরে আসি।
সত্যি জোনাথন, চমৎকার আছি। আমি হলফ করে বলতে পারি, তুমি মনে মনে আমার এই দায়সারা জীবনযাপনকে ঈর্ষা করছ। যা-ই হোক, আজ এই পর্যন্ত… এবার আমি ডিনার সেরে নিই।

— ইতি
২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০
আর্থার

…………………………………………………………………………….

প্রিয় জোনাথন,
তোমার চিঠি পেয়েছি গত পরশু। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এর কৃপায় ভালোই আছ জেনে খুব খুশি হয়েছি। আমারও সময় দারুণ কাটছে! কাজের ওখানে সবাই আমায় খুব পছন্দ করে, বসের কাছেও আমি একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী হয়ে উঠেছি।
নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পেয়েছি। বিকেলে বেড়াতে গিয়ে বেশ কিছু বন্ধুও হয়েছে আমার। এখন আর নিজেকে একা মনে হয় না।

ও মনে পড়ল, তুমি জানতে চেয়েছিলে, রাতের বেলা ফাঁকা রেস্তোরায় আমার সময় কাটে কী করে? তা আন্দাজ মন্দ করোনি। প্রথম প্রথম বেশ নিঃসঙ্গ লাগত নিজেকে। মনে হত, পৃথিবীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, শুধুমাত্র এই রেস্তোরাঁ আর আমি… এখান থেকে বেরোলেই যেন গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাব। বিশেষ করে বারোটা থেকে ভোর চারটে এই চার ঘণ্টা… এই চারটে ঘণ্টার এক বিশেষ মায়া আছে, বুঝলে, সে আমি তোমায় লিখে বোঝাতে পারব না।

মেইন গেটের সামনে আলো জ্বলা পোস্টারের নীল-লাল আভার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নেশা ধরে যায় যেন। মাঝে মাঝে লেট নাইট ড্রাইভে বেরোনো কয়েকজন এদিক আসে ঠিকই… কিন্তু তাও খুব সামান্য। সেজন্য আমি কিছুদিন হল, একটা ছোটো রেডিয়ো কিনেছি।
সন্ধে থেকে যার ডিউটি থাকে সে বেরিয়ে যাওয়ার পর টাকাপয়সার হিসেব দেখে নিয়ে আমি রেডিয়ো চালিয়ে দিই। তারপর চোখ বন্ধ করে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিই আর কানে ভেসে আসে পুরোনো দিনের গান অথবা কোনো ঘোষকের শান্ত গলায় দেশ-বিদেশের খবর। এই করেই রাতের পর রাত কাটছে আমার।

আজকের চিঠিটা পোস্টকার্ডেই সারলাম। আর লেখার বিশেষ কিছু নেই। ভালো থেকো। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুক।
পুনশ্চ: একবার এসে ঘুরে যেয়ো। বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি।
— ইতি
১ মার্চ, ১৯৯০
আর্থার

…………………………………………………………………………………………..

প্রিয় জোনাথন,
আগের চিঠিটা মনে হয়, পৌঁছোয়নি তোমার কাছে বা তুমি তার উত্তর পাঠিয়েছ, আমার কাছে এসে পৌঁছোয়নি এখনও। কিন্তু আমি আর অপেক্ষা করতে পারলাম না…. তোমায় ঘটনাটা না বললেই নয়।

মনে আছে, স্কুলে পড়ার সময় তুমি কী পরিমাণ ভূতুড়ে গল্প পড়তে ভালোবাসতে? সারাক্ষণ স্টিফেন কিং কিংবা ব্ল্যাকউড-এর লেখা ছোটো গল্পে মুখ ডুবিয়ে রাখতে ? আশা করি, এখনও সেই মোহ কাটেনি তোমার… যা-ই হোক, আর বেশি দেরি না করে ঘটনাটা লিখে ফেলি।

তোমায় আমার কেনা রেডিয়োর কথা বলেছিলাম, মনে আছে? এতদিন সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল কিন্তু গতকাল একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল-কাল রাতের দিকে আবহওয়া খুব একটা ভালো ছিল না। খবরের কাগজে হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথাও পড়েছিলাম কিন্তু আমি সেসবের তোয়াক্কা না করেই কাজে উপস্থিত হলাম ঠিক পৌনে বারোটার সময়। বাইরে আকাশে তখন মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে… মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আভাসও দেখা দিচ্ছে। স্যামসন, মানে আগের শিটের ছেলেটা আমায় সব হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বারোটা পাঁচ নাগাদ বেরিয়ে গেল। আমিও রেডিয়ো চালিয়ে ক্যাশবাক্সে টাকাগুলো গোছাতে শুরু করলাম।

কিছুদিন থেকেই আমি একটা নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির নিয়মিত শ্রোতা হয়ে পড়েছিলাম, বেশ সুন্দর সুন্দর গান হয়। কিন্তু আজ যেন প্রথম থেকেই নেটওয়ার্কের ছন্দপতন চলছিল — শব্দ কেটে কেটে আসছিল, মাঝে মাঝে একটানা ঘ্যাড়ঘাড় আওয়াজ হচ্ছে ইত্যাদি।
হঠাৎ এমন বিচ্ছিরি আওয়াজ শুরু হল যে আমার মনঃসংযোগ নষ্ট হয়ে টাকা গোনায় ভুল হয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে আমি সজোরে স্টপ বাটনটা টিপে দিলাম। আবার চারদিক নিঃশব্দ। এতক্ষণ বুঝিনি, কিন্তু বাইরে টিপটাপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

সাপ্তাহিক বর্তমান ১৫ জুলাই ২০২৩ পিডিএফ Saptahik Bartaman 15 July 2023 pdf

ঠিক তখন সাড়ে বারোটা, আমি টাকা গুছিয়ে নিয়ে আবার চালু করলাম রেডিয়োটা। কিন্তু, এইবার একটানা মৃদু যান্ত্ৰিক শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ ভেসে এল না।
ফ্রিকোয়েন্সি চেঞ্জ করলাম… নাহ্, কোনো পরিবর্তন নেই। সব ক-টা চ্যানেলের ওই একই অবস্থা। ব্যাটারি খুলে আবার লাগিয়ে অথবা হাত দিয়ে চাপড় মেরে দেখলাম … কিন্তু কিছুই হল না, কোনো নেটওয়ার্কই নিচ্ছে না।
শেষমেশ গায়ের জোরে টেবিলের ওপর ফেলে দিলাম রেডিয়োটা আর সঙ্গে সঙ্গে আমায় অবাক করে দিয়ে একটা চিঁ… শব্দ ভেসে এল।
আমি খুশি মনে চ্যানেল পালটানোর নবটা বেশ কয়েকবার ঘোরালাম।
কিছুক্ষণ পর একটা পুরুষকণ্ঠ ভেসে এল যন্ত্রের ওপার কাটায়, তাদেরকে।

কিন্তু কিছু ব্যাপার আমার বোধগম্য হয়নি, হয়তো প্রোগ্রাম পুরোটা শুনলে বুঝতে পারতাম। যেমন ধরো, সত্তাগুলোর আসল উদ্দেশ্য কী? শুধুই কি সহানুভূতিলাভ? আর এদের থেকে এত সাবধানে থাকতেই বা কেন বলা হচ্ছে?
এ ব্যাপারে তোমার কী মত, সেটা অবশ্যই জানিয়ো। যা-ই হোক, অনেক বেশি লিখে ফেলেছি… উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক।
— ইতি
১৫ মার্চ, ১৯৯০
আর্থার

……………………………………………………………………………………….

(2)
(জোনাথন ব্লেক-এর ডায়েরি থেকে)

৫ মার্চ, ১৯৯০ :

অনেকদিন পর আর্থার-এর চিঠিপত্র পেয়ে ভালো লাগছে। বহু ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে ও নিজেকে সামলে অনেকটা সামলে নিয়েছে। স্কুলে পড়াকালীন দুর্ঘটনায় বাবা-মা-কে হারানো, তারপর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে ওর আর বোন জুলিয়েটের পড়াশোনা চালানো, কর্মসূত্রে আরও পশ্চিমে চলে যাওয়া—এসব গুছিয়ে লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। তবু এত কিছুর পরেও আর্থার আর আমার যোগাযোগ চিঠি চালাচালির মারফত রয়েই গেছে। জুলিয়েট চলে যাওয়ার পর একদিন হঠাৎ করেই পুরোনো ভাড়াবাড়ি ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছিল আর্থার, তারপর এদিক-সেদিক ঘুরে শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে জাতীয় সড়কের পাশে গড়ে ওঠা সস্তা কলোনিতে একটা বাড়ি নিয়েছে। এসব কথাই জানতে পেরেছিলাম ওর লেখা চিঠির মাধ্যমে। চাক্ষুষ দেখার ভাগ্য আমার হয়নি। যদিও ও মাঝে মাঝেই যাওয়ার জন্য লিখেছে; ঠিক করেছি, একবার যাব। শহরের ওই অংশটায় যাইনি কোনোদিন।

২৫ মার্চ, ১৯৯০ :

আর্থার-এর দুটো চিঠি এসেছে। ওর স্মৃতির তারিফ না করে থাকা যায় না। আমি স্কুলে পড়াকালীন প্রচণ্ড ভাবে অলৌকিক সাহিত্য বা গোয়েন্দা কাহিনির ভক্ত ছিলাম। সেটাও মনে রেখেছে, দেখছি। ও নিজেও ওই ধরনের – সাহিত্য পছন্দ করত। তবে আর্থারের মধ্যে যে কল্পনাশক্তিও যে রয়েছে—এ খবর আমার অজানা ছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় চিঠিটায় যে ঘটনার কথা ও লিখেছে, ওরকম লেখা আমি আজ পর্যন্ত কোনো গল্পে পড়িনি। একজন অজানা রেডিয়ো ঘোষকের কথা লিখেছে, যে কিনা একটি সম্প্রচারের মাধ্যমে শ্রোতাদের সাবধান করছে, রাত বারোটার পর কোনোমতেই বাড়ি ফাঁকা রাখা যাবে না।

কারণ, ওই সময় এক অজানা সত্তা টহল দেয়, যাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল মানুষের সহানুভূতি অর্জন করা। কিন্তু অজানা ঘোষক, ওই আপাত নিরীহ সত্তাকে ভয় পেতে বলছেন, অন্তত যতদিন না তাদের সঠিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হচ্ছে। কল্পনার কথা বাদ রেখে যদি আর্থার-এর কথাকে সত্যি হিসেবে ধরে নেওয়া যায় তবে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসে—প্রথম, ওই সত্তাটি কি সংখ্যায় একজন?

দ্বিতীয়, ওদের চলন বা গমন কীভাবে হয়? হঠাৎ করেই ম্যাজিকের মতো তাদের আবির্ভাব নাকি অন্য কিছু?

তৃতীয়, মানবজাতির সঙ্গে সঙ্গেই সত্তাটিরও সমান্তরাল বিবর্তন হয়েছে এমন দাবি করা হয়েছে ওই অনুষ্ঠানে, তাহলে ইতিহাসে এই ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই কেন?

আর চতুর্থ, অজানা রেডিয়ো ঘোষক ভদ্রলোকটি কে? তাঁরাই বা এই তথ্য পেলেন কোথা থেকে? আর গবেষণা চলছে কথাটির অর্থ কী? কারা গবেষণা করছেন?

যা-ই হোক, আমার যতদূর পড়াশোনা বা আগ্রহ, তার উপর ভিত্তি করে বলতে পারি, আর্থার-এর লেখা কথাগুলোর এক আশ্চর্য অলৌকিক মাত্রা রয়েছে। মনে হচ্ছে, অলৌকিকের ঘাঁটাঘাঁটি পুনরায় শুরু করতে হবে। এমন লেখার মতো আরও কিছু পাওয়া যায় কি না যাচাই করে নেওয়া দরকার।

২৮ মার্চ, ১৯৯০ :

অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর কয়েকটা বই জোগাড় করতে পেরেছি। এগুলো নাড়াঘাটা করলে হয়তো কিছু পাওয়া যাবে। কেমন করে বইপাড়ার পুরোনো দোকানগুলো খুঁজে বইগুলো পেয়েছি, সে নাহয় না-ই বললাম। কিন্তু বইগুলো বাছাইয়ের সময় দোকানিদের মুখে বিভিন্ন রকমের অভিব্যক্তি খেলা করছিল। তবে সব থেকে আশ্চর্য হয়েছিলাম একজন মুসলিম বৃদ্ধ দোকানির কাছ থেকে একটা বই কেনার সময় পুরোনো পোকায় কাটা মলাটের ফাঁকফোকর দিয়ে বইটার নাম পড়েছিলাম—’আরগথ ক্রনিক্‌স’ বা ওই জাতীয় কিছু। নামটা অচেনা ঠেকতে বইটা তুলে নিই। উলটে-পালটে দেখার সময় মনে হয়েছিল, এ বই রহস্যের জট কাটাতে যতটা না সাহায্য করবে, তার থেকে বেশি জটিল রহস্যের জালে আমায় আবদ্ধ করবে। দাম মেটানোর সময় বৃদ্ধ দোকানদারের কুঞ্চিত নাক আর ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতের মিশেলে তৈরি মুখাবয়ব থেকে যে কথাগুলো বেরিয়েছিল, সহজে ভুলতে পারব না।

“স্যার, আমি জানি না আপনি হঠাৎ কী কারণে বইটা নিচ্ছেন, আমি জানি না, তবে আপনার ভালো চেয়ে বলব, এ বইটা যদি ফায়ারপ্লেসের আগুন উসকে দেওয়ার জন্য নিয়ে থাকেন তাহলেই এর সঠিক ব্যবহার হবে…” যা-ই হোক, একটু পড়াশোনা করা দরকার।

২৯ মার্চ, ১৯৯০ :
কাল সারারাত পড়ার ঘরে কাটিয়েছি। বইগুলো পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা নিজেই জানি না। ঘুমের ঘোরে কিছু বিচ্ছিরি স্বপ্নও দেখেছিলাম, কিন্তু সন্দেহ হয়, সত্যিই তা স্বপ্ন ছিল নাকি বাস্তবের ভিন্ন মাত্রায় বিচরণ করছিলাম। ঈশ্বরের আশীর্বাদে সেসব এই মুহূর্তে মনে নেই।

যে বইগুলো জোগাড় করেছি, তাদের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় ভাষাগত ও চিহ্নগত মিল লক্ষ করা গেছে। যেমন নেফ্রস গোষ্ঠীর লোককথা নিয়ে লেখা প্রবন্ধে, নৃতত্ত্ববিদ টিউনিস কার্টার এক জায়গায় বলেছেন- মহাজাগতিক বিস্ফোরণের বহু আগে অতিমাত্রিক ধোঁয়াটে জগতে বসবাস করত কিছু দুঃস্বপ্নের জীব, তারা নিজেদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিজেরাই সন্দিহান ছিল। ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তাদের। কিন্তু মহাজাগতিক বিস্ফোরণের সময় তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন মাত্রায়। তারই কিছু কিছু টিকে যায় পৃথিবীর জমাট বাঁধার সময়। এখনও নাকি বিশেষ কিছু মুহূর্তে তাদের আসল রূপ ধরা পড়ে মানুষের চোখে।

এই বিষয়ে, প্রত্নতাত্ত্বিক ড. রিচার্ড ডার্লেথ-এর কিছু লেখালেখির উদাহরণ পেয়েছি ‘স্ট্রেঞ্জ মিথ অব সাঁঝোরা-দ্য ফরবিন শেলটার’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে। ভারতবর্ষের ছোটোনাগপুরের সাঁঝোরা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা কিছু গুহামুখকে ভালো চোখে দেখেননি তিনি, সাবধান করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিক ও প্রাবন্ধিকদের “ফরবিন শেলটার’ সম্বন্ধে যত কম জানা যায়, ততই মঙ্গল।”

যা-ই হোক, এইরকম আরও অবাস্তব ও খাপছাড়া ত্য পড়ে উন্মাদপ্রায় হয়ে পড়েছিলাম। বইগুলো সরিয়ে রেখে বেরোবার উদ্যোগ করছি এমন সময় আমার চোখ পড়ল “আরাথ ক্রনিক্‌স’ বইটার দিকে। কী মনে হতে বইটার কয়েকটা পাতা উলটে-পালটে দেখা শুরু করলাম এবং একটা নাম হঠাৎ করেই চোখে পড়ল – ড. থেনিস ব্রেক। নামটা -আর্থার-এর লেখা চিঠিতে পড়েছিলাম। প্রায় একশো বছর আগে লেখা বিতর্কিত গবেষক ড. থেনিস ব্রেক-এর লেখা ডায়েরির কিছু অংশ লেখা রয়েছে বইটিতে। অত্যন্ত কঠিন ইংরেজি ও অসংলগ্ন তথ্য এড়িয়ে সহজ তরজমা দাঁড়ায় এইরকম—

“আরগথের প্রাচীন বাসিন্দাদের রাজত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল মহাজাগতিক বিস্ফোরণের সময়। এরপর ওদের শরীরের কিছু অংশ ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। তার কিছু কিছু বর্তমান পৃথিবীতে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু সেসব নিয়ে মানবজাতির ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আমি দেখতে পাই না। নিজে থেকে কেউ তাদের খুঁজতে না চাইলে তারা ধরা দেয় না। সে পদ্ধতি বেশ কঠিন ও ভয়াবহ। আরগথের বাসিন্দাদের অধীনে যে সমস্ত সত্তা প্রজার ভূমিকা পালন করত, তাদের অক্ষত শরীর টিকে গিয়েছিল মহাজাগতিক বিস্ফোরণের প্রলয়ংকর শক্তি অতিক্রম করে।

ঠিক যেমন করে প্রকৃতির খামখেয়ালে পৃথিবীতে বৃহৎ সরীসৃপদের অবলুপ্তি ঘটে কিন্তু বহু নিকৃষ্ট জীব ও কীটপতঙ্গ অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়। মানবজাতির ভয় পাওয়া উচিত সেই সমস্ত নিকৃষ্ট জীবকে। যদিও আমাদের ত্রিমাত্রিক জগতের সঙ্গে তাদের বিচরণপদ্ধতি খাপ খায় না। তবুও মাঝে মাঝে তাদের অনুপ্রবেশ ঘটে আমাদের স্বাভাবিক ছন্দের জীবনে। তখনই মানবজাতির অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে দাঁড়ায়। কারণ, তারা একসময় পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল ছিল আরগথের প্রাচীন দেবতাদের জীবনীশক্তির উপর, দেবতাদের মৃত্যুর পর কয়েক কল্পকাল ধরে তারা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে বিভিন্ন মাত্রা বা ডাইমেনশনে. তারপর হঠাৎ করেই খুঁজে পায় মানুষদের।

শারীরিকভাবে দুর্বল অথচ আবেগের দিক থেকে শক্তিশালী এই দু-পেয়ে প্রাণীরা হয়ে ওঠে আরগথ প্রজাদের শক্তির প্রধান উৎস। এখন মজার ব্যাপার হল, মানুষের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সত্তাগুলোরও পরিবর্তন ঘটেছে, তাদের আকার বদলেছে, বদলেছে তাদের প্রাণশক্তি সংগ্রহের পদ্ধতি। তবে আশার কথা এই যে, কোনো এক অজানা কারণে এরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে বিভিন্ন মাত্রায়, তাই এদের একত্রিত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। কিছু উদাহরণের উপর নির্ভর করে বলা যায় এদের আবির্ভাব অনেকটা জাদুবিদ্যার মতো, কে বলতে পারে, হয়তো এই মুহূর্তে আপনার পেছনেই সে উপস্থিত হয়েছে বহুমাত্রিক জগতের মায়া কাটিয়ে। এ ছাড়াও সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, একাকী জীবনে অভ্যস্ত বা কম সংখ্যক লোকজন নিয়ে গড়ে ওঠা জনগোষ্ঠীর উপর এদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছে।

বৃষ্টি তোমার জন্য pdf – সুমন্ত আসলাম Brishti Tomar Jonno pdf – Sumanto Aslam

হয়তো সেই কারণেই, আজও তারা সকলের অলক্ষে রয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক দলিল বা নথিতে এদের উল্লেখ নেই। যে সমস্ত লেখালেখি হয়েছে তাদের নিয়ে, সেসব কোনো অজ্ঞাত আরণে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী এই নিয়ে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই জুটেছে উন্মাদ অথবা অবৈজ্ঞানিকের তকমা। ”

এত অব্দি পড়ার পর যুক্তি ও তর্কের বিষয় বাদ রেখে যদি কেবলমাত্র কল্পনার ডানায় ভর করা যায়, তাহলে বলতে হয়, আর্থার যে সত্তার কথা বলেছেন, সেটিও এইরকম কিছু একটা। যদিও বেশ কিছু প্রশ্ন এবং উত্তর এখনও ধোঁয়াশায় আবৃত, তাও এক অলৌকিক সমাপতনের আভাস লক্ষ করছি। এমনও হতে পারে, কোনোভাবে এই তথ্যগুলো আর্থার জানতে পেরেছে এবং আমায় চমকে দেওয়ার জন্য কাল্পনিক গল্প ফেঁদেছে। যদিও এমনটা ওর মুখচোরা স্বভাবের সঙ্গে খাপ খায় না। অতএব যে দ্বিতীয় সম্ভাবনা পড়ে থাকছে তা ভাবতেও ইচ্ছে করছে না।
এখন আমার করণীয় কী হতে পারে? ওর চিঠির জন্য অপেক্ষা করা নাকি সরাসরি ওর সঙ্গে দেখা করা?

২ এপ্রিল, ১৯৯০ :
সেই রাত্রে বইগুলো পড়ার পর একটা অমঙ্গলের ভাবনা যে আসেনি তা অস্বীকার করা ঠিক হবে না, আবার যুক্তিবাদী মনের একটা প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্বও কাজ করছিল। অবশেষে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি এখন বসে রয়েছি জাতীয় সড়কের ধারে গড়ে ওঠা একটা ক্যাফেতে। ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটার ঘর ছুঁয়েছে। দীর্ঘ সাত ঘণ্টার যাত্রাপথে কত গাড়ি আর ট্রেন বদল করতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সেসব কথা লেখা বাহুল্য মনে হচ্ছে। আপাতত একটু গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে সামান্য কিছু কথা লিখে রাখি-

সম্ভবত এই ক্যাফেতেই আর্থার চাকরি করত। এত রাতে ক্যাফের মালিক বা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মচারীর সঙ্গে কথা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যে ছেলেটি পরিচারকের কাজ করছে, তাকে জিজ্ঞেস করাতে জানাল—এক ভদ্রলোক কিছুদিন আগে পর্যন্ত এখানে কাজ করতেন, সম্ভবত অনিয়মিত এবং অমনোযোগী হওয়াতে তাঁর চাকরি যায়; ওঁর জায়গায় ছেলেটি কাজে নিযুক্ত হয়েছে এই কদিন আগে। অবশ্য আগের কর্মচারী গ্রেভইয়ার্ড শিফটে কাজ করতেন, ছেলেটির ডিউটি রাত এগারোটা অব্দি, এরপর ক্যাফে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। এর বেশি আর কিছুই জানা যায়নি।

আশ্চর্য! আর্থার যেমন লিখেছিল, তাতে তো ওর কাজকর্ম ভালোই চলছিল বলে মনে হয়েছিল, হঠাৎ এমন কী হল? আমার মন বলল, অবিলম্বে ওর সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন। চিঠিপত্র থেকেও আশপাশে কিছু খোঁজ নেওয়ার পর আর্থার-এর বাড়ি যাওয়ার রাস্তার একটা সম্ভাব্য নকশা তৈরি করেছি। এলাকাটা কোনো কারণে মূল শহর থেকে এখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। এত রাতে পথঘাটও নির্জন। কিন্তু এখন পিছিয়ে আসার কোনো উপায় নেই।
ক্যাফে বন্ধের সময় হয়েছে। অতএব আর্থার-এর খোঁজে যাওয়া যাক।


(জোনাথন ডব্লিউ ব্লেক-এর প্রতি আর্থার উইলিস-এর শেষ চিঠি

জোনাথন,
আজ সারাদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি, আমার শরীর বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। মানসিক অবস্থাও নেই লেখার মতো। গত কয়েকদিন ধরে আমার সঙ্গে যা যা ঘটেছে, সেগুলোর মানে এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। একেকবার মনে হয়েছে, আমি হয়তো অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়েছি, আবার পরক্ষণেই মনে হয়েছে, না… সব বাস্তব…..

স্কুলে পড়াকালীন, তুমি একটা বই আমায় জোর করে পড়িয়েছিলে, মনে আছে? কোনো এক পাদরির জীবনে ঘটে-যাওয়া কিছু অলৌকিক ঘটনা নিয়ে লেখা গল্পসংকলন ? যদিও বইটার গল্পগুলো ছিল খাপছাড়া ও বিচ্ছিরি ধরনের এবং গল্পে বর্ণিত ঘটনা ও চরিত্রগুলোর সত্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম তবুও বইটার ভূমিকায় লেখা একটা কথা আমার বেশ মনে লেগেছিল… এতদিন পরে আবার সেটা ভীষণভাবে মনে পড়ছে….

“কল্পনা অতি ভয়ংকর শক্তি। বাস্তববোধ ও অলীক জগতের মেলবন্ধন ঘটায়। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের খোলনলচে পালটে দেয়। কল্পনায় আক্রান্ত মানুষ আনন্দ উপভোগ করে অথবা নির্ভেজাল ভয় পেতে পারে।”
আমিও মনে হয়, এইরকম কোনো কল্পনার শিকার হয়েছি আর এসবের মূলে রয়েছে বেশ কিছুদিন আগে রেডিয়োয় শোনা সেই অস্বাভাবিক প্রোগ্রাম। আমার কথাগুলো বোধহয় হেঁয়ালির মতো শোনাচ্ছে, তা-ই না?
কতটা পারব জানি না কিন্তু চেষ্টা করছি, সব ঘটনা এক-এক করে গুছিয়ে লেখার-

দিনটা ছিল শনিবার, তারিখ বোধহয় ১৭ মার্চ, আমি নিয়মমাফিক সাড়ে এগারোটায় হাজির হলাম আমাদের রেস্তোরাঁয়। ঢুকে দেখি, আমাদের বস, তাঁর মিসেস এবং সকালের শিফটে যারা কাজ করে, তারা সবাই মিলে পুরো ডাইনিং হলটা বেলুন, রঙিন কাগজ আর হ্যাপি বার্থডে লেখায় সাজিয়ে তুলছে। আমি তো বেশ অবাক। কার জন্মদিন?

কিছুক্ষণ পর আচমকা মনে পড়ে গেল— আজ রাত বারোটার পর, মানে আগামীকাল বসের একমাত্র ছেলের আঠারো বছরের জন্মদিন। আমাদের কাল থেকেই বলা ছিল যে, আজ রাত বারোটার সময় আমরা সবাই থাকব রেস্তোরাঁয়…. বসের ছেলেকে নিয়ে ওর বন্ধুরা আসবে এখানে… তারপর সারপ্রাইজ।
আমি সামান্য কর্মচারী। আয় বেশি নয়, তাও কিছু জমানো টাকা খরচ করে একটা উপহার কিনেও রেখেছি। কিন্তু সমস্যা হল, সেটা আনতেই ভুলে গিয়েছি। এদিকে বেশি সময় নেই; আমি আর দেরি না করে বসকে বলে চটপট সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। ঘরে ঢুকে গিটটা নিয়ে বেরোনোর সময় লক্ষ করলাম, দেওয়ালঘড়ি জানান দিচ্ছে এখন রাত বারোটা পাঁচ। যা-ই হোক, না হয় একটু দেরিতেই পার্টিতে যাব।
আমি তাড়াতাড়ি মেইন গেটে তালা লাগিয়ে সাইকেলের লক খুলে রওনা দেব, ঠিক সেই সময় কী খেয়াল হতে একবার নিঝুম বাড়িটার দিকে তাকালাম, তখনই ব্যাপারটা চোখে পড়ল-

আমার বেডরুমের জানালাটা প্রায় রাস্তার দিকেই, পর্দা না-দেওয়া থাকলে জানালার কাচ দিয়ে ঘরের ভেতরটা প্রায় স্পষ্ট দেখা যায়। অন্যান্য দিন, আমি বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটা ছোটো টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাখি, যার হলুদ আলোর ক্ষীণ আভাস দেখা যায় জানালা দিয়ে…. কিন্তু আজ আর সেটা চোখে পড়ল না…..
ল্যাম্পটা খারাপ হল নাকি?
আমি জানলার কাছে এগিয়ে এসে ঘরের ভিতর উঠি দিলাম আর সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল….. টেবিল ল্যাম্পের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা অবয়ব ! না ঠিক দাঁড়িয়ে নেই, বলা ভালো, দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সে…..

প্রথমে মনে হল চোর, কিন্তু আমার মতো হতভাগ্যের বাড়িতে চুরি করবার কিছুই নেই। তা ছাড়া আমি দীর্ঘদিন এই এলাকায় বাস করছি, কোনোদিন চোরের উৎপাত হয়েছে বলে শুনিনি।
এই সময় কী করা উচিত ভাবছি, আচমকা রেডিয়োয় শোনা সেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল—

“যতদিন না সত্তাটিকে প্রয়োজনীয় ‘নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হচ্ছে, ততদিন রাত বারোটা থেকে চারটে এই সময়ের মধ্যে সজাগ থাকুন, কোথাও তাদের উপস্থিতি টের পেলে সেই জায়গা পরিত্যাগ করুন আর ফাঁকা বাড়িতে কখনোই রাতের বেলা একা থাকবেন না।”
তবে কি সে এসে উপস্থিত হয়েছে?

রেডিয়োয় বলা হয়েছিল, এমন সত্তার উপস্থিতি টের পেলে সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থান পরিত্যাগ করা মঙ্গল। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ওই মুহূর্তে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমার ঘরের মধ্যে কোনো জাদুকর তার ইন্দ্রজালের প্রভাব বিস্তার করে আলোছায়ার খেলা দেখাচ্ছে। রহস্য ও আকর্ষণের সেই অদ্ভুত মেলবন্ধনে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ছি।

কী মনে হতে জানলার কাচে দুবার টোকা দিলাম। শব্দ হতেই ছায়ামূর্তির মুখ আমার দিকে ঘুরল। এখন সামান্য কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। আলো-আঁধারির মধ্যেও প্রাণীটার চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। কিন্তু সেই চোখ দেখে আমার ভয় করল না, বরঞ্চ কৌতূহল হল যেন প্রাণীটা কিছু বলতে চাইছে আমায় ৷

কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলতে পারব না, সময়ের হিসেব গুলিয়ে গিয়েছিল… যখন সংবিৎ ফিরে পাই, ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু ঘরের মধ্যে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ল না।
পুরো ব্যাপারটাই দৃষ্টিভ্রম হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেত, যদি না মেঝের উপর অদ্ভুত এক আঠালো তরল পড়ে থাকতে দেখতাম… সেই সঙ্গে একটা বিশ্রী আঁশটে গন্ধও নাকে এসে লাগল।

কোনোমতে বাকি সময়টা কাটিয়ে সকালে রেস্তোরাঁয় পৌঁছোলাম। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম—এই অজুহাতে পার্টিতে না-আসার জন্য ক্ষমা চাইলাম। এমনিতে আমি খুব কর্মঠ ও নিয়মনিষ্ঠ কর্মচারী আর চোখ-মুখে একটা ক্লান্তির ভাব ছিলই তাই মালিক আমার কথা অবিশ্বাস করলেন না, উলটে আজ রাতটাও ছুটি দিলেন।

কেন জানি না আমি কিন্তু মনে মনে বেশ খুশিই হলাম, আগের রাতে যা ঘটেছিল তা আদৌ বাস্তব না আমার কল্পনা—সেসব চিন্তাভাবনার লেশমাত্রও ছিল না মাথায়… শুধু এটাই ভাবছিলাম, আজ রাতেও কি সে আসবে?
সারাদিন কাটল একটা আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে। খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত ঠিকঠাক হল না। আমি অধীর আগ্রহে বসে রইলাম রাত্রির অপেক্ষায়।

রাত ঠিক বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে একটা পচা জলজ গন্ধে ঘর ভরে গেল। বুঝতে পারলাম, সে আসছে। কিছুক্ষণ পর টেবিল ল্যাম্পের আলো খানিকটা কেঁপে উঠল। স্বাভাবিক কারণে সেইদিকে চোখ চলে গিয়েছিল আমার কিন্তু পরক্ষণেই অনুভব করলাম, পেছন থেকে কেউ আমায় নিঃশব্দে দেখে চলেছে।
সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল প্রাণীটার অবয়ব! কী বীভৎস এবং কুৎসিত তার উপস্থিতি—লিখে বোঝানোর ক্ষমতা নেই। অস্বাভাবিক রকমের রুগ্‌ণ, বিবস্ত্র শরীরটা দেখে মনে হয়, পাতালের কোনো নিষিদ্ধ গহ্বর থেকে সে উঠে এসেছে; হাত দুটো অনেকটাই লম্বা, প্রায় হাঁটু ছাড়িয়েছে; চামড়া জুড়ে সূক্ষ্ম উল্কির মতো ছড়িয়ে রয়েছে নীল বর্ণের অগুনতি শিরা।

আর সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়-প্রাণীটার মাথা বলে কিছুই নেই, তার বদলে রয়েছে গলার কাছে একটা গর্ত, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা ভাঁজ-খাওয়া গোলাকার উপবৃদ্ধি আর দুটো অনুভূতিশূন্য চোখ। সেই চোখে এমন কিছু একটা রয়েছে, যার দ্বারা সহজেই বলা যায়, এই প্রাণী
কিছুতেই জীবিত অস্তিত্ব হতে পারে না।

জোনাথন, আমি কিন্তু একফোঁটা ভয় পেলাম না প্রাণীটাকে দেখে, বরং মনে হল, আমার কোনো ক্ষতি এ করবে না। কী-ই বা আর করবে ওই রুগণ শরীর নিয়ে?
প্রাণীটা এগিয়ে এল আমার দিকে। ঠিক যেমন সারাদিনের অভুক্ত ভিখিরি করুণ চোখে তাকায় দোকানে সাজানো সুস্বাদু খাবারের দিকে, তেমনি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে।

কেমন যেন মায়া হল ওর উপর। মন বলল, ওর খিদে পেয়েছে। হাতের কাছে কিছু বিস্কিট ছিল… এগিয়ে দিলাম প্রাণীটার দিকে।
দুর্বল কাঁপা কাঁপা হাতে একটা বিস্কিট তুলে নিল সে কিন্তু কিছুক্ষণ পর প্রবল আক্রোশে ছুঁড়ে ফেলে দিল সেটা। ব্যাপারটা স্পষ্ট হল, ও খাবে কী করে? ওর তো মুখই নেই। আমার যে কী কষ্ট হয়েছিল সেই সময়, তুমি অনুমান করতে পারবে না, জোনাথন। বারবার মনে হচ্ছিল, যদি ওর জন্য কিছু করতে পারতাম।

আমাদের মুখ আছে, ওর মুখ নেই… ওর মুখ নেই… ও খেতে পারছে না… ও খেতে পারছে না…
সম্মোহিতের মতো এই এক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল আমার মাথায়। আমি কে? কোথায় রয়েছি? কিছুই আয়ত্তে নেই তখন। এতক্ষণে প্রাণীটা অনেকটা কাছে চলে এসেছে। একবার মনে হল, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমার দিকে…. আর, ভুল দেখলাম কি না জানি না কিন্তু মনে হল, ওর হাতের শিরাগুলো জীবন্ত, যেন চামড়া থেকে খুলে আসবে…..

খানিকটা তন্ত্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। পাখির ডাক কানে আসতে ঘোর কাটল… ভোর হচ্ছে…। দু-হাতে চোখ মুছে আবার তাকিয়ে দেখলাম ঘর ফাঁকা, আমি ছাড়া আর কেউ নেই… শুধুমাত্র জলজ গন্ধটা রয়েই গেছে….
ওইদিন থেকে পরপর কয়েক রাত ডিউটি ছিল। রেস্তোরাঁয় যেতাম ঠিকই কিন্তু মন থাকত বাড়ির দিকে, হয়তো সে এসেছে… আমায় খুঁজছে… খাবার খুঁজছে… এইসব উদ্ভট চিন্তায় মশগুল হয়ে থাকতাম।

একদিন টাকার হিসেবে গরমিল হল। আর-একবার একজন খদ্দেরকে কফির বদলে শুধুমাত্র গরম জল দিয়ে ফেললাম। এইরকম টুকটাক ভুল হতেই থাকল; সেই সঙ্গে বাড়ছিল অভিযোগের তালিকা। আমার বস সন্দেহ করলেন, আমি হয়তো অতিরিক্ত মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, ওই অস্তিত্বের দেখা পাওয়ার পর থেকে রাত্রিকালীন

সুরাপানের অভ্যেসটাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। এমনকি কিছুই খেতে ইচ্ছে করত না, খালি মনে হত –ও না খেয়ে আছে….. ও খেতে পারছে না….
উফ! খালি এক চিন্তা! এমনকি এই চিঠি লিখতে বসেও ! জোনাথন, একেকবার আমার মনে হয় এসব আমার ভাবনা নয়, আমার মন আর চিন্তাশক্তির উপর কোনো দ্বিতীয় সত্তা ভাগ বসিয়েছে; চালনা করছে তার নিজের ইচ্ছেমতো। দিনের বেলা তবুও খানিকটা সামলাতে পারি নিজেকে কিন্তু সূর্য ডোবার পর থেকেই মনে হয়, একজোড়া ক্ষুধার্ত চোখ সারাক্ষণ আমায় নজরে রেখেছে, তার কথা অনুযায়ীই আমায় চলতে হবে…। কাজে মন বসানোর চেষ্টা করাও বৃথা। এইরকম মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে সপ্তাহ শেষ হল।

রবিবার। ছুটির দিন। সেদিন রাতে আমার ডিউটি নেই। রাত এগারোটার মধ্যে সামান্য কিছু খেয়ে চলে এলাম আমার বেডরুমে। প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে প্রবল উত্তেজনায়। বারবার মনে হচ্ছে, আজ বিশেষ কিছু ঘটতে চলেছে। সেইদিনের রেডিয়োয় শোনা সতর্কবার্তার প্রায় কিছুই মনে নেই। অজানা কৌতূহলে মজে গিয়েছি আমি। ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘর স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে অপার্থিব গন্ধটা নাকে এল। তার আসার সময় হয়েছে।
এক মিনিট… দু-মিনিট… পাঁচ মিনিট…..

সময় বয়ে যাচ্ছে অথচ অলৌকিক প্রাণীটার উপস্থিতি নজরে এল না। এদিকে অস্বাভাবিক রকমের স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছে ঘরের আবহাওয়া। সেই সঙ্গে জলীয় গন্ধ।

এমন সময় হঠাৎ প্রচণ্ড সুখানুভূতিতে শরীর কেঁপে উঠল। খুব হালকা মনে হল নিজেকে। এত আরামদায়ক অনুভূতি আগে কখনো অনুভব করিনি। অসংখ্য ছোটো ছুঁচের মতো কিছু আমার মাথা আর শিরদাঁড়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে কিন্তু তার জন্য যন্ত্রণা হচ্ছে না বরং জন্ম নিচ্ছে এক অবর্ণনীয় সুখ। হয়তো এক মুহূর্তের জন্য আমার চোখ চলে গিয়েছিল ঘরের দেয়ালে টাঙানো মাঝারি আয়নাটার দিকে, সেদিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম-
আয়নায় আমার মাথা থেকে বুক অব্দি প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। আর মাথার পেছন দিয়ে উকি দিচ্ছে একটা ডিম্বাকার মাংসল উপবৃদ্ধি, যার সঙ্গে সরু সরু তত্ত্বর মতো কিছু দিয়ে আটকানো রয়েছে ভাসমান দুখানা চোখ। নিষ্পলক অথচ প্রাণবস্তু। আর কাঁধ, মাথা, পিঠ বেষ্টন করে আছে কদিন আগের দেখা সেই অলৌকিক সত্তা।

লিকলিকে শিরা বহুল হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে আমার মাথা, কয়েকটা নীলচে শিরা খুলে এসেছে চামড়া থেকে প্রবেশ করেছে আমার নাক ও কানের ছিদ্র দিয়ে।
যতটা সম্ভব শরীরটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম….. আমার পিঠ থেকে ঝুলে আছে একটা রুগ্‌ণ, ক্ষয়ে যাওয়া শরীর.. তাতে অবশ্য প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই।
ঠিক যেন জানলার চাপে মরে যাওয়া টিকটিকির অসাড় দেহের মতো তা লেগে রয়েছে আমার শরীরে।
কিছুক্ষণ পর শরীরটা হঠাৎ সরসর করে খসে পড়ে গেল। এতদিনে যেন তার কাজ ফুরিয়েছে। আর আমার শরীর জুড়ে প্রবেশ করেছে অসংখ্য শিরা…..

স্যাটা আসলে যে কী তা আমি বুঝতে পেরেছি। স্কুলে পড়াকালীন বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় একটা ছবি প্রায়ই চোখে পড়ত, ঠিক যেন সেই ছবিই জীবন্ত হয়ে উঠে এসে দখল নিয়েছে আমার শরীরের। মানুষের স্নায়ুতন্ত্র। ওই মাংসল উপবৃদ্ধি আর কিছুই নয়, মানুষের মস্তিষ্ক। যার সঙ্গে স্নায়ুর মাধ্যমে যুক্ত রয়েছে দুখানা চোখ আর নীচের দিকে নেমে এসেছে সুষুম্নাকাণ্ড! সেটাকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে অগুনতি স্নায়ু!

সুখানুভূতি না ভয় তা জানি না কিন্তু আমার শরীরটা আরও একবার কেঁপে উঠল। একজন মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের মতো দেখতে ওই সত্তা এতদিন ওই রুগ্ন দেহ অবলম্বন করে ছিল এবং কোনো কারণে ঐ দেহের মাথা ছিল না। তাই এতদিন অভুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়িয়েছে সে।
কিন্তু আজ আর সেই শরীরের প্রয়োজন নেই, আজ সে একটা সম্পূর্ণ সুস্থ দেহ পেয়েছে। আনন্দের কথা, সে আবার খেতে পারবে। একবার আড়চোখে মেঝেয় পড়ে থাকা দেহটার দিকে তাকালাম… তাতে খুব দ্রুত পচন ধরছে….
আমি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম।

বহুদিন পর রাত্রে ঘুম পেল আমার। এরপর ঠিক কী হয়েছিল তা খুব ভালো করে বলতে পারব না তবে ঘুমের মধ্যে কিছু অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলাম…. খণ্ড খণ্ড চিত্রের মতো। দেখলাম—রাত্রে অসংখ্য উল্কা বৃষ্টি হয়েছিল যেদিন আমি পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিলাম। আমার মতো আরও অনেকে। তাদের শরীরও আমার মতোই বিকৃত। তারা একে একে ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন মাত্রায়। তখন সবেমাত্র পৃথিবীর বুকে প্রাণের স্পন্দন দেখা দিয়েছে। স্পষ্ট দেখলাম, চোখের সামনে অজস্র কোষ বিভাজন হচ্ছে… স্বপ্নের অদ্ভূত রঙের মতো তাদের মহোৎসব!

আমাদের আরাধ্য দেবতাদের শরীর টুকরো টুকরো হয়ে অসংখ্য পীঠস্থানের রূপ নিয়েছিল সে রাত্রে। আমি যেখানে পঙ্গুর মতো পড়ে ছিলাম, তার থেকে কিছু দূরে এসে পড়েছিল আমার প্রিয় দেবতা-রেই-এর বিশাল বড়ো মুখমণ্ডল! তাঁর অপার্থিব শরীরটা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে তা আমার অজানা। কিন্তু তাঁর সুবিশাল মাথাটা! কী ভয়ংকর সুন্দর অথচ নিরুপায় মাথাটা। মরা মাছের মতো খাবি খেতে খেতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল যেন। যদিও আমি জানতাম ওঁর মৃত্যু এভাবে হয় না, আরও কত কল্পকাল লাগবে কে জানে ? বলা যায় না এর মধ্যেও হয়তো কোনো উপায়ে জীবনীশক্তির উর্জা লাভ করবেন আরগথের অন্যতম মহান দেবতা-রেহ।

রেই-এই কথাটার সঠিক উচ্চারণ কী তা জানি না। তবে স্বপ্নের মধ্যে এমনই কিছু একটা উচ্চারিত হয়েছিল আমার মাথার মধ্যে।
যা-ই হোক, এই অপার্থিব অভিজ্ঞতার ঠিক পরেই আমিও প্রবেশ করলাম অদ্ভুত এক মাত্রায়, পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক জগতের সঙ্গে তার সঠিক মিল নেই। কীভাবে আমি প্রবেশ করলাম তার পদ্ধতিও অজানা। নিশ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক। এরপর বেশ কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলাম পৃথিবীর জগতে, ততদিনে পৃথিবীতে বনমানুষের আবির্ভাব হয়েছে। আমার চোখের সামনে একটা গোষ্ঠী। তাদের দুজন পুরুষের মধ্যে লড়াই চলছে, তাদের হাতে পাথরের অস্ত্র। রক্তক্ষয়ী সে সংগ্রামের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ আমার লক্ষ যুদ্ধের দিকে ছিল না। এমন সময় হঠাৎ করেই একটা বনমানুষ তার হাতের কুঠারজাতীয় অস্ত্রের মোক্ষম আঘাত হানল প্রতিপক্ষের মাথা লক্ষ করে…..

যুদ্ধ শেষ হল একটি বনমানুষের দেহ মাটি স্পর্শ করার সময়। তখনও হয়তো সেই শরীরে প্রাণের সামান্য স্পন্দন ছিল। আমার কানে কানে কে যেন বলে দিল- “যাও … ওই তো। ওটাই তোমার কাঙ্ক্ষিত বস্তু। দখল করো ওর শরীর। নইলে কতদিন আর ভিন্ন মাত্রায় ঘুরে বেড়াবে? আশ্রয় খোঁজো, আশ্রয়! যাও..