হিজু – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী Hiju by Smaranjit Chakraborty

হিজু - স্মরণজিৎ চক্রবর্তী Hiju by Smaranjit Chakraborty
হিজু - স্মরণজিৎ চক্রবর্তী Hiju by Smaranjit Chakraborty

স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর হিজু পড়ুন। Read Hiju by Smaranjit Chakraborty

হিজু - স্মরণজিৎ চক্রবর্তী Hiju by Smaranjit Chakraborty
হিজু – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী Hiju by Smaranjit Chakraborty

হিজু Hiju পড়ুন

পাশ থেকে ফোঁস শব্দটা শুনেই বুঝলাম, মক্কেল এসে গিয়েছে।
আজ একটা কেলাের কীর্তি না করে ছাড়বে না ছেলেটা! আমি বললাম, “এই হিজু, বাড়ি যা বলছি। চয়ন কিন্তু তােকে কেস খাওয়াবে।”
হিজু পাত্তা দিল না আমায়, “তাের হিংসে হচ্ছে না? আমি পাব আর তুই পাবি না বলে হিংসে হচ্ছে? জানিস, ওরা কানাডা থেকে এসেছে? ফরেনার। গায়ের রং দেখেছিস? তুই পারিস। ইংরিজিতে কথা বলতে? আর চয়ন! ও ক্লাসের ফাস্ট বয়। ভূগােলে দারুণ। কানাডার লোকেদের কী ভাল লাগে, সেটা ও জানবে না তাে কি তুই জানবি?”
“আরে ভূগােলে এসব লেখা থাকে নাকি?”

“থকে থাকে,” হিজ মুখ বাঁকাল, “জানিস, চয়ন কত বই পড়ে! তাের মতাে নাকি যে শুধু ভায়ানা পামারের ছবি খুঁজে বেড়ায়?”
এই বােকাটাকে নিয়ে তাে মহা মুশকিল। কথা শােনে না! আমি শেষবারের মতাে বললাম, “পেঁদিয়ে না প্রদ্যুম্ন বানিয়ে দেবে! আজ বিজয়া দশমীর দিন, ভাসান করে দেবে পুরাে। বলছি ওসব করিস না।”
“ভাগ,” হিজু আমায় পাত্তা না দিয়ে প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে গেল। আমি মাথা নাড়লাম। কোলাকুলির বদলে আজ ক্যালাকেলি লাগবেই।

॥১॥
দশ বছর পর, আবার পুজোর সময়ে

মেজাজ খারাপ করেই বেরােলাম বাড়ি থেকে। কাল সারা রাত প্যান্ডেলে বসে থাকতে হয়েছিল আমায়। সকাল ছ’টা নাগাদ বাড়িতে শুতে গিয়েছি। কিন্তু শান্তি করে যে একটু ঘুমবাে তার উপায় আছে? রাস্তায় বুলান দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেজেগুজে একদম পােস্টার হয়ে আছে মেয়েটা। হবেই, ওকে তাে রাত জেগে প্যাঁচাগিরি করতে হয়নি। বললাম, “ডাকলি কেন? মা বলেনি ঘুমোচ্ছি?”
বুলান খুর চোখে তাকাল, “তােকে তাে শাহরুখ খানের মতো দেখতে নয় যে, দর্শন করব বলে তুলেছি। একটা ঝামেলা হয়েছে, তাই প্যান্ডেল থেকে চয়ন ডাকতে বলল আমায়।”

আধ-খেচড়া ঘুম থেকে উঠে এমনিতেই মাথা ব্যথা করছে, তার মধ্যে মহারানির বাক কথাগুলাে আরও জ্বালিয়ে দিল। বললাম, “তুই কী বুঝবি বল? তাের রাত জাগা মানে নেটে চ্যাট করা। ছেলেদের না খাওয়া। কাজ করতে হলে বুঝতিস?”
“মানে?” বুলান কটমট তাকাল আমার দিকে। তারপর বলল, “পান্ডেলে মা। আমার মাথা গরম করাস না একদম। আমি তেমন মেয়ে হলে এতদিন ছেলেদের মুণ্ডমালা পরে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। করিনি জাস্ট…”।
“কেন করিসনি বল?” আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “কে বারণ করেছে করতে?”

বুলান যেভাবে তাকাল, তাতে সত্যযুগ হলে নিশ্চিত এ বাবার বিস্তৃতি হয়ে যেতাম। ও ওড়নার ঝাপটা মেরে চলে গেল দূরে পাড়া মােড়ে তৈরি করা স্টেজটার দিকে। আমি তাকিয়ে দেখলাম শুধু। কেমন একটা লাগল যেন। সপ্তমীর সকালটাই এভাবে শুরু হল! কেন খারাপ কথা বললাম ওকে। ওর কী দোষ? মুখটা তেতাে হয়ে গেল। বুলান যেমন জেদি, আমার সঙ্গে আর কথাই বলবে না। গােটা পুজোটা গোল্লায় গেল। পান্ডেলে গিয়ে দেখলাম, বড় বড় দুই নৌকা খিচুড়ি আর দুই ডেচকি লাবড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছ’-সাত জন। আমাকে দেখে তার মধ্যে থেকে চয়ন এগিয়ে এল, “এই যে সেক্রেটারি, ঝামেলা সামলাও। সারাদিন ঘুমােলে চলবে?”

“কেন?” আমি বুঝতে পারলাম না কী হয়েছে? পাড়ায় পুজোর ভোগ দিতে বেরবি, এতে প্রবলেমটা কী?”
“তাের বেস্ট ফ্রেন্ড!” চয়ন বলল, “হিজু মালটা আবার ঝুলিয়েছে। হরিদার বাড়িতে কী একটা হয়েছে, আসবে না। তাই হিজুকে বললাম, একটা ভ্যান জোগাড় করে আনতে। শালা দু’ঘন্টা হল গিয়েছে, এখনও ফেরার নাম নেই। ও কি ভ্যান তৈরি করছে?”
“আর লেক পাসনি?” আমি বিরক্ত হলাম, “ওকে পাঠালি কেন?”
“সবাই কাজ করছে, আর ও করবে না?’ চয়ন বিরক্ত হল, “বললাম, কাছে থেকে একটা ভ্যান আনতে। আর শালা…”
“মােবাইলে কল কর।”

“সে মাল প্যান্ডেলে মােবাইল ফেলে গিয়েছে, চয়ন বিরক্ত হল, “এমন কাটপিস নিয়ে মাইরি কী করি বল তাে? সেক্রেটারি হয়েছিস সামলা। কাটুমের বাড়িতে ঘুরতে আসা লােকজন সব চলে যাবে। যদি তার আগে ভােগ না পৌছতে পারি…”

কাটুম এই পাড়ার শ্রুতি হাসান। চয়নের প্রচুর ব্যথা ওর উপর। কাটুমও যথেষ্ট প্রশ্রয় দেয় চয়নকে, কিন্তু সেটা নিজের বাড়ি থেকে লুকিয়ে। কাটুমের বাবা হিসেবে হিটলারের যে পুনর্জন্ম হয়েছে, সেটা পাড়ার সকলেই খুব ভাল করে জানে। মানুষ তাে দূরের কথা, পড়ার হুলাে পর্যন্ত ওদের বাউন্ডারি ওয়ালে ওঠে না। চয়ন, বিদেশী বাইকের মতাে ছেলে। দেখতে, পড়াশােনা, খেলাধুলা সবেতেই ভাল। কিন্তু তবু হিটলার কি আর অত সহজে চ্যাপলিন হয়? চন মাঝে-মাঝে ফ্লাস্টেটেদ্র হয়ে বলে, “কাটুনকে একটু দেখব তার উপায় নেই। জানিস, কলেজেও গাড়ি দিয়ে পাঠায়। মাঝে-মাঝে মনে হয়, ব্যাটাকে ওয়ার ক্রিমিনাল হিসেবে আমেরিকার হাতে তুলে দিই। গত লাইফে তাে সুইসাইড করে পার পেয়ে। গিয়েছিল, এই লাইফেও পার পেয়ে যাবে।”

বললাম, “আমি ভ্যান পাব কোথায়? আর এ জন্য আমার ঘুম ভাঙালি?” চয়ন আরও কিছু বলত হয়তো, কিন্তু তার আগেই একটা গাড়ির শব্দ শুনলাম। পুজোটা আমাদের পাড়ার গলির ভিতরে হয়। আর মােড়ের কাছে হয় স্টেজ। এই সময় গোটা রাস্তা বন্ধ থাকে। কেউ গাড়ি কেন, মোটরবাইকও ঢােকায় না। শুধু দরকারে সাইকেলভ্যান আনাই আমরা। সেখানে কে ঢোকাচ্ছে গাড়ি? আমরা পান্ডেলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলাম বাইরে। বুলানরাও স্টেজ ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। দেখলাম, একটা বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তার দরজা খুলে লাফিয়ে নামল হিজু। চয়ন খিচুড়ির হাতা নিয়ে দৌড়ে গেল, “কী রে ভ্যান কই?”

হিজু হেসে বলল, “কেন এই তাে!” আমরা কী বলব বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে। দেখলাম, জাল লাগানো পুলিশের বড় গাড়ির মতাে দশাসই ভ্যানটাকে।। “এটা করে পাড়ায় খিচুড়ি দিতে বেরব?” চয়ন কী বলবে যেন ভেবে পেল না।
হিজু ওর হাই পাওয়ারের চশমাটা ঠিক করে বলল, “তুই তাে বললি তাড়াতাড়ি দিতে হবে। তাই নিয়ে এলাম। হরিদার ভ্যানের চেয়ে জোরে ছােটে। আর ভাড়াও বেশি নয়, মােটে দু’হাজার টাকা।”
“তােকে আজ মেরেই ফেলব, চয়ন আর সহ্য করতে না পেরে হাত সমেত লাফিয়ে পড়ল হিজুর উপর।
আমি আটকাতে গেলাম চয়নকে। আর শুনলাম দূর থেকে বুলান বলছে, “মার চয়ন, মেরে মাথা ভেঙে দে কুম্ভকর্ণটার।”

চতুরঙ্গের অশ্বারোহী pdf – সিদ্দিক আহমেদ Chaturanger Asharohi pdf – Siddique Ahmed

ছােটবেলা থেকে আমরা সকলেই একসঙ্গে বড় হয়েছি এ পাড়ায়। এক ঠেক, এক স্কুল, এক কোচিং… সবটাই কেমন যেন কমন আমাদের। শুধু কলেজে উঠে উদ্ধ পিণ্ডগুলি ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। বড় হতে হতে আমরা প্রায় সকলেই অল্প-বিস্তর পালটে গিয়েছি। প্রায় বললাম, কারণ হিজু। ও পালটায়নি একটুও। হিজু ওর নাম নয়, এর আসল নাম মলবিকাশ গুহরায়। ছোট থেকেই ওর বুদ্ধিটা নড়বড়ে। ক্লাস ফাইভে চয়ন একদিন ওকে অন্ধ দেখিয়ে দিতে গিয়ে, শয়তানি করে শিখিয়েছিল, “ইজ ইকোয়্যাল টু’ নয় রে বােকা, ওটা তাে ইংলিশ। অঙ্কে কি ইংলিশ মানায়?”

“মানায় না?” হিজু গােল-গােল চোখ করে তাকিয়েছিল।
“না রে বাবা,” ছােট্ট চয়ন দুষ্টুমি করে বলেছিল, “ভূগােল কি বাংলায় মেশে?”
“না তাে! তবে?” হিজু যেন বুঝতে পারছিল যুক্তিটা। চয়ন বলেছিল, “স্যার যখন ক্লাসে জিজ্ঞেস করবেন, তখন বলবি হিজুকা, বুঝেছিস? এটা আরবি। ওরাই ঠিকঠাক অল্প করত বাবা বলেছে।” আমরা সকলেই চুপ করে শুনছিলাম আর হাসছিলাম। তবে সত্যি বলতে কী বুঝতে পারিনি, হিজু ওটা ক্লাসে বলেই দেবে! স্যার বাের্ডে অঙ্ক করতে করতে যেই না বলেছেন, “ইজ ইকোয়াল টু’ সঙ্গে-সঙ্গে সদা ব্যগ্র হিছু উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘স্যার ভুল বললেন, এটা হবে হিজুকান্টু।”

“কী কান্টু? হিজু!” স্যার ঘাবড়ে গিয়েছিলেন প্রথমে। তারপর বুঝতে পেরে চ্যাওাব্যাঙা করে পিটিয়েছিলেন হিজুকে। সেই থেকে একে সকলেই হিজু বলে ডাকে।

আজ অষ্টমী। আমাদের বাড়িতে ঘুরতে আসা ছােট মামিমাকে পুরনাে অ্যালবাম দেখাচ্ছিলাম। সেখানে আমাদের ছােটবেলার ছবি দেখে মনে পড়ে গেল সবটা। হিজু বােক। মানে, খুবই বোকা। ছোট থেকেই এমন সব কাজকম্ম করে যে, ওকে নিয়ে মাঝেমাঝে আর পারা যায় না। চয়ন তো ওকে দেখলেই কোনও না কোনভাবে হেনস্তা করে। আর এখানেই খারাপ লাগে আমার। একমাথা কোঁকড়া চুল, চোখে মাইনাস টেন চশমা পরা রােগা-বেটে। হিজুকে দেখলে, আমার কেন জানি না কষ্ট হয় খুব। মনে হয়, চারিদিকে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা। টাইপ ক্লাবের ভিড়ে এ যেন ছােট পাড়ার এ যুগের যাত্রী ক্লাব। বুলান খুব ভালবাসে হিজুকে। নিজের ভাইয়ের মতাে রাখি পরায়, ফোঁটা দেয়।

বুলানের মতাে রাগী, গম্ভীর মেয়ে যে ওকে সাপাের্ট করে, এটা দেখে সকলেই অবাক হয়। আমি অবশ্য হই না। বুলানের আপাত-রাগী মুখটার পিছনের নরম মেয়েটাকে তো আমি দেখতে পাই। তা বলে সেই রাগটা কিন্তু এখনও ওর ভাঙেনি। আমার উপর ওর রাগ সবসময় টাইটেনিয়াম কোয়ালিটির হয়। পুজোয় আমি একদম ঘােরাঘুরি করি না। কলকাতার রাস্তায় ভিড় দেখলেই দম আটকে আসে আমার। তাই পাড়ার প্যান্ডেলেই বসে থাকি। আজও সেখানেই গেলাম। এখন সন্ধে, একটু আগে আরতি হয়ে গিয়েছে। প্যান্ডেল বেশ ফাঁকা। আসলে সকলেই বাড়িতে মাঞ্জা মারতে গিয়েছে। ঘুরতে বেরবে যে! এখন থেকে রাত এগারোটা অবধি প্যান্ডেলের চার্জে আমি আর হিজু। দেখলাম, ঢাকটার পাশে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে রয়েছে ও। সেই উসকোখুসকো চুল।

আর একটা সাধারণ জামা। হিজুদের বাড়ির অবস্থা খুবই ভাল। কিন্তু কেন কে জানে, ও সেখানেও একটু কোণঠাসা হয়ে থাকে। বললাম, “কী রে, এমন জামা পরে বসে আছিস।
হিজু চশমাটা ঠিক করে বলল, “বাড়ি ঢুকলে বাবা মারবে। সকালে বলেছিল, পিসির বাড়িতে নাড়ু দিয়ে আসতে। আমি ভুল করে মাসির বাড়িতে দিয়ে এসেছি। আমাদের সঙ্গে মাসিদের খুব খারাপ সম্পর্ক তাে! যাক গে শােন না, বুলান তাের উপর খেপে আছে।”
“বুলান!” আমি ভুরু কুচকে বললাম, “কেন তোকে কিছু বলেছে?
“তুই মদ খাচ্ছিস নাকি রে?”

“মানে? বুলান, মদ… কেসটা কী?” আমি উঠে দাঁড়ালাম, “কী বলতে চাইছিস?”
ষষ্ঠীর রাতে নাকি প্যান্ডেলে বসে মদ খেয়েছিস। তাই পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারিসনি? বুলানকে কাটুম বলেছে।”
“মানে?” আমি উঠে দাঁড়ালাম, “কাটুম? আমি মদ খাই? চা পর্যন্ত খাই না। ইয়ার্কি মারছিস?”

“মাইরি। চুয়ন কাটুমকে বলেছে। আমি কী বলব বুঝতে না পেরে বসে পড়লাম আবার। এই চয়ন ছেলেটা বহুত ফালতু। এবার পুজায় ওর সেক্রেটারি হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সকলে আমায় সিলেক্ট করেছে বলে ওর জ্বলছে। আমি চোয়াল শক্ত করলাম। জানি, এই নিয়ে কিছু বলতে গেলে ঝামেলা হবে। হিজুর থেকে জেনেছি বললে হিজুর বিপদ বাড়বে। বললাম, “দাঁড়া যাচ্ছি ওর কাছে।”
আমি উঠতে যাব, কিন্তু সামনেই ঝোরাকাকুকে দেখে বসে পড়লাম। ঝােরাকাকু মানে কাটুমের বাবা। ঝােরাকাকু জিজ্ঞেস করল, “কাটুমকে দেখেছিস?” “হ্যাঁ, আমি কিছু বলার আগেই ফস করে বলে বসল হিজু। “কোথায় ও সেই দুপুরে বেরিয়েছে। এখনও একবারও বাড়ি আসেনি?”

হিজু বলল, “সকালে তাে অঞ্জলি দিল।”
“গাধা, তখনকার কথা বলছি? কোথায় ও? যা খুঁজে আন একে বল, আমি বাড়ি আসতে বলেছি, যা।” ঝােরাকাকু চলে গেল।
হিজু বলল, “কী করি বল তাে?”
“কেন?” আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
“কাটুমকে কোথায় পাব? ঝােরাকাকু তো আমাকে বকবে, না খুঁজলে!”

“কে বকবে?” পিছন থেকে চয়নের গলা পেলাম আমি। “ওই হিটলার? শালা এমন লােকে এমন মেয়ে হয়?” চয়ন পকেট থেকে একটা চুলের ক্লিপ বের করল, বলল, “সারা বিকেল পলাশদের বাড়িতে ছিলাম ওকে নিয়ে। পাগলের মতাে কিস করে নাইরি। দেখ না চুলের ক্লিপটা ফেলে গিয়েছে।” কথা শেষ করে চয়ন ক্লিপটা আচমকা ঢুকিয়ে দিল হিজুর পকেটে, বলল, “এটা রাখ। মা আমার জামা-প্যান্ট তল্লাশি করে। পরে তার থেকে নিয়ে দিয়ে দেব ওকে।” হিজু থতমত খেয়ে গেল।
“ও কেন রাখবে?” আমি বিরক্ত হলাম। চয়ন বলল, “সেক্রেটারির রংবাজি শুধু পুজোতেই দেখা ব্লা। এটা আমার আর হিজুর ব্যাপার। মাঝখানে দালালি করবি না।”

এরপরের ঘটনাটা ঘটল নবমীর বিকেলে। আমি আর হিজু বসে প্রাইজ গোছাচ্ছিলাম। নবমীর সন্তোবেলা মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করা পাড়ার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইজ দেওয়া হয়। পুজো কমিটি থেকেই আয়ােজন করি আমরা। কিন্তু পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে দু’-তিন জনের উপর। এবার আমি, হিজু আর বুলান। প্রাইগুলাে ভাগ করছিলাম। বুলানের সঙ্গে এত কাছে থেকে কাজ করলেও ও এমন মিউট মােডে চলে গিয়েছে যে, আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি নানা অছিলায় কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু ও পাত্তাই দিচ্ছিল না। তাই আর উপায় না দেখে, আমি আচমকা হাতটা আলতাে করে ধরেছিলাম ওর। আর বাস! হয়তাে এটুকুরই দরকার ছিল।

বােমার মতাে ফেটে পড়েছিল বুলান, বলেছিল, “লম্পট, মাতাল, রেপিস্ট। আমার গায়ে হাত দেওয়া হচ্ছে!” আমি কোনওমতে বলেছিলাম, “চয়ন মিথ্যে বলেছে, আমি মদ খাইনি। তুই জানিস তাে ওসব। আমি ছুই না। আমার অ্যালকোহলে অ্যালার্জি আছে। জানিস না?”
কানের গোড়ায় দেব তােকে,” বুলান চিৎকার করে উঠেছিল, “আমার গায়ে হাত দিচ্ছিস?”
আমি মাথা নিচু করে নিয়েছিলাম। এটা নতুন নাকি? কে কথায় কথায় আমার গাল টিপে দেয়? একা পেলে জড়িয়ে আদর করে? আমি?

বুলান রাগ করে বলেছিল, “রইল তােদের প্রাইজ। আমি এমন একটা ইভটিজারের সঙ্গে কাজই করব না।” প্যান্ডেল থেকে রাগ করে বেরুতে যাচ্ছিল বুলান, আর ঠিক তখনই রে-রে করে আজও এসে সামনে দাঁড়াল কোরাকাকু। হিজুর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “আজও বাড়িতে ফেরার সময় নেই? আজও? কোথায় গিয়েছে হ্যাঁ, আমার মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় গিয়েছে জানােয়ারটা?”
হিজু প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে মােটা কাচে চাপা পড়া বড় বড় চোখগুলােকে আরও বড় করে বলল, “ওরা? কাকু, ওরা তাে ইয়ে মানে, পলাশদের ফাঁকা বাড়িতে মানে, ইয়ে করছে…”

“ইয়ে করছে? মানে? ইয়ে করা মানেটা কী?” ঝােরাকাকু কলার চেপে ধরল হিজুর।
হিজু ভয়ে ঘেমে-নেয়ে তুলে বলল, “প্রেম। করছে কাকু। মাইরি বলছি, চুল খুলে খুব প্রেম করছে। এই যে ক্লিপ?” ক্লিপটা কেড়ে নিয়ে ঝােরাকাকু হিজুকে বাজে কাগজের মতাে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ল পলাশদের বাড়িতে।
আমি বিরক্ত হয়ে তাকালাম হিজুর দিকে, “গাধা তুই? বলে দিলি প্রেম করছে। এখন কী হবে?”
হিজু কী বলবে বুঝতে না পেরে ঠোট চাটতে লাগল। দেখলাম, বুলানও চলে না গিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের সঙ্গে।

এর একটু পরেই বিস্ফোরণটা হল। ঝোরাকাকু সারা পাড়া মাথায় তুলে চিৎকার করতে করতে কাটুমকে নিয়ে চলে গেল নিজেদের বাড়ির দিকে। শুনলাম ঝােরাকাকু বলছে, “হারামজাদা চয়ন, তােকে জুতিয়ে সারা শরীরে ফোস্কা ফেলে দেব। কী ভেবেছিস, ড্রেন পাইপ বেয়ে নেমে পার পাবি? পুলিশে দেব তােকে। দেখিস, তোদের গুটিশুদ্ধ যদি জেলে না ঢোকাই, তবে আমার নাম ঝোরা নয়।
সব ঠান্ডা হওয়ার মিনিট পনেরাে পর প্যান্ডেলের পিছন দিয়ে চয়ন এসে ঢুকল।
আমি বললাম, “কী? গুছিয়ে কেস খেয়েছিস তো?”
“শালা, এই মালটার জন্য হয়েছে সব,” চয়ন এসে আচমক থাপ্পড় মারল হিজুকে, “পলাশদের বাড়িতে আছি কেন বলেছিস? গােরু তুই? ঘাস খাস বাড়িতে?”

হিজু বলল, “গুরুজন মানুষ, জিজ্ঞেস করলেন…”
“কে রে মালটা?” চয়ন হাত পা ছুড়ে বলল, “ঠিক আছে। কাল তােকেই তবে ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে হবে।”
আ-আমি?” হিজু কী বলবে বুঝতে পারল না।
“জানিস, ধরতে পারলে ওই হিটলা আমায় কেলিয়ে লাট করে দিত!”
“তাই পালালি ড্রেন পাইপ বেয়ে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“মন্দি বেদীকে দেখার বয়সে শহিদ বেদি হব নাকি? কাটুম রেগে লাল হয়ে আছে আমার উপর। বলছে, আমি ব্যাওয়ার্ড। আমার মুখ দেখবে না।”
বুলান বলল, “তাতে হিজু কী করবে?” ও যেমন আমায় বাশ দিয়েছে, এই ব্যাপারটা না হলে?”
হিজু ঠোট চাটল।
চয়ন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “দু’পায়ে নয়, বাকি জীবনটা চার পায়ে হাটবি।”

ঠাকুর বরণের জন্য এখন প্যান্ডেলের সামনে বেশ ভিড়। পুজোর চারটে দিন যে কোথা দিয়ে বেরিয়ে যায়, বুঝতেই পারি না। দুর্গাপুজো থেকে কালিপুজোর মাঝখানের ফাকটা কেমন যেন। লােডশেডিং-লােডশেডিং লাগে আমার। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। শরতের থেকে এবার শহর হেমন্তে বাক নেবে। লােকে বলে, অটম কি বােঝা যায় না আর। কিন্তু আমি তাে বেশ বুঝতে পারি। গাছে গাছে ব্রোঞ্জের পাতা গজিয়ে ওঠে। রাস্তায় ওড়ে ব্রোঞ্জ রংয়ের সব প্রজাপতিরা। শহরের মাথায় কে যেন নিঃশব্দে টাঙিয়ে দিয়ে যায় ব্রোঞ্জ রংয়ের একটা আকাশ। হেমন্ত কাল যেন তৃতীয় স্থান পাওয়া প্রতিযােগী। “কী ভাবছিস রে?” হিজু আলতো খোঁচাল আমায়। আমি একটা জুতসই কাব্যি টাইপের উত্তর দেব ভাবলাম, তার আগেই চয়ন এসে দাঁড়াল পাশে।

বলল, “এই যে গোরু, মনে আছে তাে কথাটা?” প্যান্ডেল থেকে একটু দূরে একটা ফাঁকা জায়গায় দাড়িয়ে রয়েছি আমরা। ঠাকুরের সামনে এখন ব্যাপক ভিড়। পাড়ার নানা বয়সি মহিলারা এসে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার ভিড়ে বুলাকেও দেখলাম। শাড়ি পরেছে আজ। আমাকে মারবে বলেই পরেছে। মেয়েরা ঠিক বােঝে, কী করে ছেলেদের মেরে ফেলতে হয়। হিজু চয়নের পাশ থেকে সরে এসে আমার পাশে দাঁড়াল।

“পালাচ্ছিস কোথায়?” চয়ন ছাড়ল না ওকে। বলল, “তােকে বলেছিলাম না, ঝামেলা মেটাতে হলে। নে, এই চিঠি আর চকোলেটবারটা দিয়ে আয় ওকে। ভিড়ের মধ্যে কাটুমও দাঁড়িয়ে আছে, তবে একটু একা। ওর মায়ের বরণ করা শেষ। এবার ওরা বাড়ির দিকে এগোবে। হিজু ভয় পেয়ে তাকাল আমার দিকে। আমার খারাপ লাগল। চয়নকে বললাম, “কেন ও যাবে? মােবাইলে কথা বলে ঝামেলা মিটিয়ে নে। এখানে ফালতু ক্যাচাল করিস না।”

“কাটুম মােবাইল সুইচ অফ করে রেখেছে। এমনি এমনি কী আর এসব ট্রাই করছি, চয়ন দাত পিষল, “তুই আবার দালালি করছিস? বলছি না, এটা হিজুর কেস। এই হিজু, যা বলছি।” হিজু পানসে মুখে জিনিসগুলাে নিয়ে এগিয়ে গেল সামনে।

চয়ন বলল, “চিঠিটা পকেটে ঢোকা রে গাধা।” হিজু পকেটে চিঠিটা ঢুকিয়ে হাতে চকোলেটটা নিয়ে এগিয়ে গেল। আমিও গেলাম পিছন-পিছন। কী করতে কী করবে ঠিক আছে। ম্যানেজ করতে হবে না। হিজু গিয়ে দাঁড়াল কাটুমের সামনে। কাটুমের মুখটা নিমেষে লাল হয়ে গেল ওকে দেখে। এই সেরেছে। আমি আরও একটু এগিয়ে গেলাম। হিজু বলল, “চকোলেট।”
“আমি কী করব?” ধমক দিল কাটুম।
“খাবে,” হিজু দাঁত বের করে হাসল।

“আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি? জানােয়ার একটা। কাল আগুন লাগিয়ে এখন চকোলেট দেওয়া হচ্ছে?” কাটুম ছোঁ মেরে চকোলেটটা নিয়ে ছুড়ে মারল রাস্তায়। তারপর হনহন করে হাটা দিল বাড়ির দিকে। হিজু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। কাটুমের মা মেয়ের হঠাৎ চলে যাওয়া দেখে পিছন-পিছন এগোল। আর ঠিক এই মাহেন্দ্র ক্ষণেই হিজুর মনে পড়ল চিঠির কথা! ও আধ হাত জিভ কেটে পকেট থেকে বের করল কাগজটা। তারপর এগিয়ে গেল কাটুমের মায়ের দিকে। সর্বনাশ! ভয়ে জমে গেলাম আমি।

হিজু বলল, “কাকিমা, কাটুম তো চয়নের দেওয়া চকোলেটটা নিল না। ছুড়ে ফেলে দিল। বলুন, আমাদের মতাে গরীব দেশে কেউ এমন করে খাবার নষ্ট করে? যাক গে, আপনি ওকে এই চিঠিটা দিয়ে দেবেন তাে। চয়ন কীসব লিখেছে এতে মনে করে দিয়ে দেবেন কিন্তু।”
“কী” কাকিমা চিৎকার করে বলে উঠল, “কালকের ঘটনার পরও জানোয়ারটা আমার মেয়েকে চিঠি দিয়েছে?” এবার যে বিশাল একটা কেস হবে, সেটা তো স্পষ্ট। দেখলাম, কাকিমা এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভিড়ের ভিতরে ঠিক দেখে ফেলল চয়নকে।

তারপর ওই মােটা শরীর নিয়ে সাংঘাতিক একটা দৌড় দিয়ে গিয়ে পড়ল ওর উপর। ঘটনার আকস্মিতায় চয়ন এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছে যে, পালাতেও পারল না। পরের তিন মিনিট এক অদ্ভুত ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা দেখলাম আমরা। কাকিমা মারতে চাইছে আর চয়ন বাঁচতে। ওদের ছোঁয়াছুঁয়ি অলিম্পিকসে পুরো প্যান্ডেল মুগ্ধ হয়ে গেল। শেষে কাকিমা হাঁপাতে হাঁপাতে হাতে জুতাে নিয়ে বলল, “আর যদি কোনওদিন আমার মেয়ের পিছনে লেগেছিস, তবে তােদের ফ্যামিলি শুদ্ধু গারদে পুরব।” নাে কনফ্লিক্ট, নাে ড্রামা। সাহেবদের কথা যে আমাদের মতো এ কলােনি গুলােতে এখনও কতটা প্রযােজ্য, সেটা বুঝলাম। বিনি পয়সার এমন জম্পেস ড্রামা দেখতে বরণ করার মহিলারা ছাড়াও বহু লােক জুটে গিয়েছে।

আশপাশে বাড়ির জানালাগুলাে ড্রেস-সার্কলের মতো ভর্তি হয়ে গিয়েছে নিমেষে। আমি দেখলাম চয়নের চোখ মুখ লাল। এত অপমানিত হয়েছে, যে কোনও সময়ে কেঁদে ফেলবে।
কাকিমা চলে যেতেই ও প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল হিজুর উপর, “তুই…তুই…তাের জন্য…”।
হিজু পিছিয়ে গেল ভয়ে, বলল, “আমি বুঝতে পারিনি, মাইরি। দশমীর দিনে এমন করিস না। আমার জীবনেও তাে নানা কিছু হয়েছে,..

চয়ন কথা শেষ করতে দিল না হিজুকে। চোখ গোল-গােল করে বলল, “ও তাই! তাই তুই প্রতিশােধ নিলি! সেই দশ বছর আগের ব্যাপারটার প্রতিশােধ নিলি! তুই বােকা? কে বলে তােরে বােক। ”
“মানে?” ভিড়ের থেকে বুলান এগিয়ে এল, “কী বলছিস তুই?

“ওকে জিজ্ঞেস কর, চয়ন পায়ে পায়ে এগিয়ে এল হিজুর দিকে, “সেই ঘটনার জন্য এভাবে আমায় বাঁশ দিলি। বােকা সেজে থেকে তুই… যে তােকে বােকা বলে সে নিজে গাধা। তুই শুধু চালাক নােস, খচ্চর চালাক। তােকে আমি…” চয়ন লাফিয়ে পড়ল হিজুকে মারবে বলে। আমি হাত বাড়িয়ে আটকাতে গেলাম। চয়ন রাগের চোটে ঘুষি চালাল। মনে হল, কানের গোড়ায় বোমা ফাটল যেন। মাটিতে পড়ে গেলাম আমি। চয়ন আবার হাত তুলল। ঠাস। ইডেন যেন, লেদার অন উড’-এর শব্দ শুনল।

বুলান কষিয়ে একপিস থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে চয়নের গালে। “অসভ্যতা করলে আবার মারব… মেরেই ফেলব,” বুলান চয়নের দিকে তাকিয়ে হিসহিসে গলায় বলল। চয়ন সকলের দিকে তাকাল একবার। তারপর কেঁদে ফেলল আচমকা বলল, “তুই. দশ বছর আগের প্রতিশোধ এভাবে নিলি মলয়!”

দশ বছর আগে, দশমীর সেই দিন

দেবীকরণের জন্য ঠাকুরের স্টেজের সামনে খুব ভিড়। তবু সেই দিকে এগিয়ে গেল হিজু। আমি ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইলাম। কানাডা থেকে আসা দু’টি মেয়ে অবাক হয়ে দেখছে দেবীবরণের প্রথা। ওরা কোনওদিন এসব দেখেনি যে! বাঙালি তাে আর নয়। হিজু গিয়ে সামনে দাঁড়াল ওদের, বলল “এক্সকিউজ মি!” একটি মেয়ে ফিরে তাকাল। গোলাপি মােম কেটে তৈরি করা মুখ। বড় বড় বাদামি চোখ। এমন মেয়ে দেখলে হার্টের সমস্ত কপাটিকার দাঁত কপাটি লেগে যাওয়া নিশ্চিত। হিজু দু’হাত বাড়িয়ে বলল, “টুডে বিজয়া। কাস্টম কোলাকুলি। ক্যান আই কোলাকুলি?”

“হােয়াট?” মেয়েটা সন্ত্রস্ত মুখে তাকাল হিজুর মােটা কাচ চাপা বড় বড় চোখ দুটোর দিকে।
“কোলাকুলি, হিজু বােঝাতে পারল না ঠিক।
নিজের মনে বলল, “ধ্যাত্তেরি। ইংরেজিতে কী হবে? হ্যাঁ… না-না, কোল মানে ল্যাপ আর কুলি তো কুলিই…” মেয়েটা তখনও বুঝতে পারছে না, “মিনিং হােয়াট?” “মানে দিস,” হিজু আচমকা এগিয়ে গিয়ে জাপটে ধরল মেয়েটাকে। মেয়েটা ভয়ে চিল চিৎকার করে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল হিজুকে। আর ওরা যাদের বাড়িতে। ঘুরতে এসেছে তারা চিৎকার শুনে দৌড়ে এল। পরের দশ মিনিট কী যে মার খেল হিজু। ও বলার চেষ্টা করেছিল চয়নের কথা, কিন্তু কেউ শোনেনি।

আমি অসহায়ের মতাে আটকাতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। জামা ছিড়ে গিয়েছে হিজুর। চশমাটা পড়ে চুরমার। পায়ের স্যান্ডেল উধাও। সকলে সরে যাওয়ার পর দেখলাম, মাটিতে বসে হাতড়ে হাতড়ে চশমা খুঁজছে হিজু। আমি পাশে গিয়ে তুলে দিলাম চশমাটা। ও আমার দিকে তাকিয়ে আবছা গলায় বলল, “ঠিক বলেছিস রাজা।। ভূগােল বইতে সত্যি এসব লেখা থাকে না?”

দশ বছর পর। এখন।
সকালের জমজমাট পাড়াটাই রাতে কেমন যেন একা আর মনমরা হয়ে যায়। ভাসান হয়ে গিয়েছে। প্যান্ডেলে ফিরে মিষ্টিমুখও শেষ। কিন্তু কোথাও আমি হিজুকে খুঁজে পাইনি। সেই ঝামেলার পর থেকেই পুরো গায়েব হয়ে গিয়েছে। সব সেরে তাই ওদের বাড়িতে এসেছি দেখা করব বলে। তিনতলার চিলেকোঠার ঘরটায় হিজু থাকে।। দেখলাম, বিছানায় বসে কমিক্স পড়ছে। আমাকে দেখে বইটা নামিয়ে তাকাল। আমি গিয়ে বসলাম ওর পাশে। হেসে বললাম, “দারুণ দিয়েছিস কিন্তু। আমি তাে ভুলেই গিয়েছিলাম দশ বছর আগের কেসটা। সত্যি, সেদিনও বিজয়া দশমী ছিল। সলিড করেছিস।

পুরাে বাম্বু ডট কমে চালান করে দিয়েছিস চয়নকে, কে তােকে বােকা বলে।” আমি পিঠ চাপড়ালাম ওর। হিজু চশমা ঠিক করল হাত দিয়ে। “আসলে কী জানিস রাজা,” হিজু তাকাল আমার দিকে, “আমি কিন্তু বােকাই। মানে, আজ যা করলাম, সেটা বােকামাে করেই করে ফেলেছি।”

“হ্যাঁ রে। দশ বছর আগে কী হয়েছিল, আমাদের মতে ছেলে কি সেসব মনে করে রাখে, বল? তা ছাড়া নিজেকে বড় করার জন্য কারও কোনওদিন কোনও ক্ষতি করতে দেখেছিস আমায়?” আমি অবাক হলাম। বললাম, “তা হলে চয়নের কথার প্রতিবাদ করলি না কেন তখন? সকলেই কী ভাবল বল তাে!” হিজু স্লানভাবে হাসল, বলল, “’সারা জীবন সকলেই তো বােকা, গাধা বলে গালাগালিই করে গেল আমায়।

মুরগি করে গেল। একদিন না হয় বুদ্ধিমান হলাম। কেউ না হয় সকলের সামনে চেঁচিয়ে বলল সেটা। হােক খারাপভাবে, তবু বুদ্ধিমান তাে! আমারও তাে কখনও কখনও ইচ্ছে হয়, লােকে আমাকেও বুদ্ধিমান বলুক। বলুক, আমিও মাথার খেলায় অন্যকে নাস্তানাবুদ করতে পারি। তাই না? সবসময়ে বােকা হয়ে হারতে কি আর ভাল লাগে, বল?” আমি তাকালাম হিজুর দিকে। বােঝার চেষ্টা করলাম, জেতা আর হারার মধ্যের ফারাকটা!

সমাপ্ত

Read or download bangla books pdf

Be the first to comment

Leave a Reply